সপ্তম তারাবির বিষয়বস্তু: জাকাতের ৮ খাত ও মুনাফিকদের ১১ বৈশিষ্ট্য
আজ থেকে তারাবিতে প্রতিদিন ১ পারা করে তিলাওয়াত করা হবে। আজ পবিত্র কোরআনের দশম পারা তিলাওয়াত করা হবে।
সূরা আনফালের ৪১ থেকে সুরা তওবার ৯৩ নম্বর আয়াত পর্যন্ত। এই অংশে রয়েছে
*জিহাদ
*বদর যুদ্ধের ঘটনা ও শিক্ষা
*যুদ্ধবন্দী
*গনিমত
*জাতীয় জীবনে উত্থান-পতনের মূলনীতি
*মক্কা বিজয়,
*হুনাইন যুদ্ধ
*তাবুক যুদ্ধ
*তওবাসহ নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। এখান থেকে অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো—
গনিমতের সম্পদ বণ্টন
আজকের তারাবির শুরুতে গনিমতের সম্পদে অংশীদারত্ব এবং বণ্টনের নীতিনির্ধারণ বিষয়ে আলোকপাত রয়েছে। কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর যে সম্পদ পাওয়া যায়, সেটা হলো গনিমত। মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের জন্য এই গনিমতের সম্পদ আল্লাহ হালাল করে দিয়েছেন। আগের উম্মতের জন্য তা হালাল ছিল না; যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কাফেরদের কাছ থেকে পাওয়া সব মাল-সম্পদকে এক জায়গায় জমা করলে আসমান থেকে আগুন এসে সেগুলো জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিত।
যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদ রাষ্ট্রের কাছে জমা দিতে হয়। কোনো সৈন্যের জন্য তা থেকে বণ্টনের আগে কোনো বস্তু রেখে দেওয়ার অনুমতি নেই। রাষ্ট্রপ্রধান সেই সম্পদ বণ্টন করবেন। বদরের যুদ্ধে গনিমতের সম্পদ মুসলমানদের হাতে আসে এবং রাসুল (সা.) সেগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। অতঃপর যু-কারদা যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গনিমতের সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হয়। কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী এর এক-পঞ্চমাংশ (২০ হাজার দিনার) মহানবী (সা.) গ্রহণ করেন এবং তা তিনি জনসাধারণের কল্যাণে ব্যয় করেন। বাকি চার-পঞ্চমাংশ তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বিলিয়ে দেন।
তাফসিরে ইবনে কাসিরে এসেছে, যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদ ৫ ভাগে ভাগ করা হবে। এর ৪ ভাগ যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আর বাকি এক পঞ্চমাংশ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। এই পাঁচ ভাগ যারা পাবেন—
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য। এই অংশ মুসলিমদের সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যয় হবে।
২. মুহাম্মদ (সা.)-এর স্বজনদের জন্য নির্ধারিত। তাঁরা হলেন—ওই সব লোক, যাঁদের ওপর সদকা খাওয়া হারাম। অর্থাৎ বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব।
৩. এতিমদের জন্য সুনির্দিষ্ট।
৪. ফকির ও মিসকিনদের জন্য।
৫. মুসাফিরদের জন্য।
বান্দার তওবা কবুলের সূরা: সূরা তওবা
সুরা তওবা মদিনায় অবতীর্ণ। এই সুরার আয়াত সংখ্যা ১২৯। কোরআনের ৯ম সুরা এটি। এটি ‘সুরা বারাআত’ নামেও প্রসিদ্ধ। এটিই একমাত্র সূরা, যার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখা হয়নি।
তওবা অর্থ প্রত্যাবর্তন, ফিরে আসা। এ সুরায় মুমিনদের তওবা কবুল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য এটিকে সুরা তওবা বলা হয়। বারাআত বলার কারণ হলো, বারাআত অর্থ সম্পর্ক ছিন্ন করা। এতে কাফেরদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের ব্যাপারে দায়িত্বমুক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে।
আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত তাবুক যুদ্ধ
আল্লাহ তাআলা সুরা তওবার ৩৯ নম্বর আয়াতে মুসলমানদের তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের নবম হিজরিতে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাবুক মদিনা ও দামেস্কের (সিরিয়া) মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। মদিনা থেকে এটি ৬৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের কাফের ও মুনাফিকদের শেষ চেষ্টা ছিল এই যুদ্ধ।
রোমানদের দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দূত হারেস বিন উমায়ের (রা.)কে হত্যার মধ্য দিয়ে তাবুক যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। রাসুল (সা.) দূতের মাধ্যমে জানতে পারলেন, ‘মুতা যুদ্ধে’র প্রতিশোধ নিতে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে পরাশক্তি রোম। শাম ও আরব সীমান্তে তারা বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেছে।
মদিনায় তখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। নবীজি আদেশ করলেন, হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের আগে তিনি আক্রমণ করবেন। মদিনার সব মুসলমানকে তৈরি হতে বললেন। এর আগে এমন রাজকীয় বাহিনীর মুখোমুখি তাঁরা কোনো দিন হননি। মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধও করেননি।
এদিকে মদিনায় তখন খেজুর পাকার মৌসুম চলছে। সময়মতো খেজুর ঘরে না তুলতে পারলে মুশকিলে পড়তে হবে। মদিনায় খাদ্যাভাবও দেখা দিয়েছে এর মধ্যে। তীব্র গরমে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তাবুক প্রান্তরে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হবে দুর্গম মরুভূমি। যুদ্ধের রসদও তেমন নেই। এসবের মধ্যে শহর ছেড়ে এমন রাজকীয় বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করতে যাওয়া; বিরাট কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপারই বটে।
কিন্তু রাসুলপ্রেমী সাহাবিরা সবকিছু পেছনে ফেলে ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নবীজির হাতে যুদ্ধের বাইয়াত নেন। অনেকে যুদ্ধে যেতে চাইলেন না। আল্লাহ তাদের মুনাফিকির পরিচয় সুস্পষ্ট করে দেন। রাসুল (সা.) ৩০ হাজার যোদ্ধা সাহাবির কাফেলা নিয়ে চললেন তাবুক প্রান্তের দিকে। হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের এমন দুঃসাহসিক অভিযানের সংবাদ পেয়ে ময়দান ছেড়ে ভেগে যায়।
সুরা তওবায় মুনাফিকদের ১১ বৈশিষ্ট্য:
সুরা তওবার ৪২ থেকে ৫৯ নম্বর আয়াতে তাবুক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধে অংশ না নেওয়া মুনাফিকদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা—
১. মিথ্যা অজুহাত পেশ করে।
২. টালবাহনা করে।
৩. হাস্যকর আপত্তির কথা বলে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি আদায় করে।
৪. মুসলিম সমাজে অনিষ্ট ছড়ায়।
৫. মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ায় ও মুসলমানদের বিপদে আনন্দ প্রকাশ করে।
৬. মিথ্যা শপথ করে।
৭. সম্পদ পেলে আনন্দ পায়, না পেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
৮. আল্লাহর মহব্বত, আল্লাহর জিকির ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ শূন্য অন্তর।
৯. নবীজিকে গালমন্দ করে।
১০. একে অপরকে মন্দ কাজের আদেশ দেয়, ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে।
১১. কৃপণ।
জাকাত প্রদানের ৮ খাত
সুরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা জাকাত প্রদানের খাত বর্ণনা করেছেন। যথা—
১. গরিব—যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই।
২. মিসকিন—যার মালিকানায় কোনো সম্পদ নেই।
৩. ইসলামি সরকারের পক্ষ থেকে জাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তি।
৪. ইসলামের দিকে চিত্ত আকর্ষণের জন্য জাকাত দেওয়া।
৫. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি।
৬. নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ দাস-দাসী।
৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী।
৮. মুসাফির—সফর অবস্থায় অভাবগ্রস্ত মানুষ।
এ ছাড়া মুসলমানদের বিজয়ে আল্লাহর সাহায্য, বন্ধু গ্রহণের নীতি, আনসার, মুহাজির এবং মুজাহিদদের পুরস্কার ও মর্যাদা, মুশরিকদের কাবাঘর তাওয়াফে নিষেধাজ্ঞা, কাফেরদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল, মতানৈক্য ও অহংকার পরিহার, পূর্ববর্তী জাতিদের ভয়াবহ পরিণামসহ ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা রয়েছে এ অংশে।
বিষয়বস্তুর বিশদ আলোচনা বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থে বিদ্যমান।
আর এই রমজানে প্রতি তারাবিতে তিলাওয়াতকৃত আয়াতের বিষয়বস্তুর সারকথা ধারাবাহিকভাবে থাকছে।