অবৈধ পথে মানবপাচার: মামলা হচ্ছে চৌদ্দ জেলার ৬০ দালালের বিরুদ্ধে

ovibasi
ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার প্রতিনিধি:
অবৈধ সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে মিয়ানমারের জলসীমা থেকে নৌ-বাহিনীর হাতে উদ্ধার হওয়া পঞ্চম দফায় ফেরত আনা ১২৫ বাংলাদেশীকে স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ৬০ দালালের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। এসব দালালদের বিরুদ্ধে দেশের ১৪ জেলায় সংশ্লিষ্ট থানায় পৃথক মামলা দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।

বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টা থেকে পুলিশ, রেডক্রিসেন্ট, আইওএম এর অধিনে এদেরকে আত্মীয় স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। দীর্ঘ ৪/৫ মাসের ভোগান্তির পর ৫ম দফায় মঙ্গলবার ফেরত আনা হয় ১২৫ বাংলাদেশীকে। এদের রাখা হয় কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। ওখানে আইনী প্রক্রিয়া শেষে ২৫ শিশুকে আদালতে নেয়া হয়।

আদালতের নির্দেশ মতে এদের রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে অভিভাবকদের কাছে ফেরৎ দেয় হয়। অপর ১০০ জনকে আইওএম এবং পুলিশের মাধ্যমে স্বজনের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সুবাহান জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে ফেরত আনা ১২৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ৬০ জন দালালের নাম পাওয়া গেছে। মানবপাচারকারী এসব দালালদের বিরুদ্ধে দেশের ১৪ জেলার সংশ্লিষ্ট থানায় পৃথক মামলা দায়ের করা হবে।

তিনি জানান, ১২৫ জনকে সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়ে দালালদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর তাদের অভিভাবক বা স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। এর মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ২৫ জনকে আদালতের নির্দেশনা মতে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে আভিভাবকদের কাছে এবং অপর ১০০ জনকে আইওএম ও পুলিশের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারের সহকারি পুলিশ সুপার ছত্রধর ত্রিপুরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন ভোগান্তি শেষে ফেরত আনা ১২৫ জন তাদের নির্যাতনের বর্ণনা দেয়ার পাশাপাশি ঘরে ফেরার আনন্দ প্রকাশ করেছে। পাচারের শিকার মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফেরত আসা এসব লোকদের বাদী করে সংশ্লিষ্ট থানায় দালালদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে মামলা দায়ের করার ব্যবস্থা করা হবে।
দালালদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন পাচারের শিকার হয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফেরত আসা এসব লোকজন। তারা জানান দালালদের প্ররোচণার কেউ যাতে পাচারের শিকার না হয়। দালাল কর্তৃক তাদের উপর নানা নির্যাতনের বর্ণনার পাশাপাশি ফেরত আসতে পারার আনন্দও প্রকাশ করেন তারা।

কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও ভাদীতলা এলাকার আনোয়ার আলীর ছেলে নুরুল আবছার মা নুর বেগমকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরা এ যুবক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় ট্রলারে ভেল্ট ও রশি দিয়ে তৈরী চাবুক দিয়ে নানা নির্যাতন চালানোর কথা বলে তিনি জানান, দালালের প্ররোচণায় কেউ যেন এ ভুল পথে পা না বাড়ান।

চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের নতুনপাড়ার রাজারবিল গ্রামের শামসুল আলমের ছেলে জসিম উদ্দিন জানান, ৪ মাসের অধিক পূর্বে এক দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় যাবার জন্য সমুদ্র পথে রওনা দেন। দালালরা রাতের বেলায় অন্যান্যদের সাথে তাকেও একটি ট্রলারে তোলা হয়। এক সপ্তাহ পর তাদের একটি বড় ট্রলারে তুলে দেয়া হয়। মিয়ানমার সমুদ্রে ওই ট্রলারে খেয়ে না খেয়ে নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে ভাসমান অবস্থায় মিয়ানমার নৌববাহিনী তাদের উদ্ধার করে। নির্যাতনের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি দালালের ফাসিঁর দাবী জানান। পাশাপাশি ফেরত আসার আনন্দও প্রকাশ করেন সে।

রামু উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের চিতা পাড়ার মনির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ ইসলাম জানান, দালালের প্ররোচণায় ৫ মাস পূর্বে মালয়েশিয়া যাবার উদ্দেশ্যে সমুদ্র পথে যাত্রা দিই। মাঝ সমুদ্রে অপেক্ষমান ট্রলারে যাবার পর থেকে শুরু হয় নানা নির্যাতন। দালালদের নির্যাতনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শরীরের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে তিনি শিউরে উঠে জানান, কেউ যেন দালালদের প্ররোচনায় প্রতারণার শিকার না হয়। তিনি দালালের কঠোর শাস্তি দাবীর পাশাপাশি মানবপাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ারও কথাও জানান।

ফেরত আনা এসব লোকজনের অনেকের পিতা, মাতা, ভাই, স্ত্রী, সস্তান সহ স্বজনরা ভিড় জমান কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন স্বজনকে পেয়ে। ফেরত আসা এসব লোকজনও কেউ সস্তান কুলে নিয়ে, কেউ মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

ফেরত আসা মোহাম্মদ ইসলামের মা ফরমুজা বেগম (৫০) প্রায় ৫ মাস পর তার বুকের ধনকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি জানান, ‘আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি, আমি আর কিছুই চাইনা’।

ফেরত আসা জসিম উদ্দিনের পিতা শামসুল আলম সন্তানকে পেয়ে খুশি । তিনি ৪ মাস পর ছেলেকে ফেরত পেয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন।

প্রসংগত , এর আগে ৮ ও ১৯ জুন, ২২ জুলাই ও ১০ আগস্ট ৪ দফায় শনাক্ত হওয়া ৫০১ জন বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হয়েছে। গত ২১ মে ২০৮ জন ও ২৯ মে ৭২৭ জন অভিবাসি প্রত্যাশীকে মিয়ানমারের জলসীমা থেকে উদ্ধার করেছিল সে দেশের নৌ বাহিনী। এরপর বাংলাদেশী হিসেবে দাবী করা তালিকা নিয়ে উভয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ওই তালিকায় শনাক্ত হওয়া বাংলাদেশীদের পর্যায়ক্রমে ফেরত আনা হচ্ছে। মিয়ানমারের জলসীমা থেকে সাগরে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত হওয়া পঞ্চম বারের মতো ১২৫ জন সহ ৬২৬ জনকে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে ফেরত আনা হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন