আজ সেই ভয়াল ১৫ জুন: কক্সবাজারের পাহাড়ে এখানো লাখো পরিবারের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস

Cox 15 jun

আবদুল্লাহ নয়ন, কক্সবাজার:
আজ সেই ১৫ জুন। কক্সবাজারের ভয়াবহ পাহাড় ধ্বসের তিন বছর পূর্ণ হলো। বিগত ২০১০ সালের এইদিন ভোরে জেলাব্যাপী পাহাড় ধসের ঘটনায় সেনা বাহিনীর ৬ সদস্য সহ ৫২ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের ৩ বছরেও কক্সবাজার জেলায় পাহাড়ের পাদদেশে ঝূঁকি নিয়ে বাস করছেন প্রায় লক্ষাধিক পরিবার। একই সাথে চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। ফলে আবারো ভয়াবহভাবে পাহাড় ধ্বসের আশংকা করছেন স্থানীয়রা।

সুত্র জানায়, ২০১০ সালের ১৫ জুন ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় পুরো দেশ শোকাহত হয়ে উঠে। ওই দিন ভোরে টানা বৃষ্টির কারণে জেলাব্যাপী ব্যাপক জলাবদ্ধতার পাশাপাশি পাহাড় ধ্বসের ঘটনাও ঘটে। এতে রামু উপজেলার হিমছড়ি এলাকার ১৭ ইসিবি সেনা ক্যাম্পে মারা যান ৬ জন সেনা সদস্য। টেকনাফে মারা গেছে ৩৩ জন। উখিয়ায় ৯ জন ও হিমছড়িতে ৬ জন ও কক্সবাজার সদর উপজেলায় মারা যায় ২ জন। নাইক্ষ্যংছড়িতে পাহাড় ধ্বসে মারা গেছেন একই পরিবারে ৪ জন।

তারপরও কক্সবাজার জেলার ৭ উপজেলায় লক্ষাধিক পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। প্রতি বছর বর্ষায় পাহাড় ধ্বসে ব্যাপক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটলেও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস অব্যাহত আছে।
কক্সবাজার বন বিভাগ সূত্র মতে, কক্সবাজার জেলায় প্রায় ১০ হাজার একর বনভূমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। বর্ষা শুরুতেই কক্সবাজার জেলাব্যাপী চলছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা। ফলে একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে পানির সাথে কাটা মাটি এসে শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কক্সবাজার শহর ও আশপাশের এলাকায় নানা কৌশলে চলছে পাহাড় কাটা।

শহরের ঘোনার পাড়া, মোহাজের পাড়া, বৈদ্যঘোনা, বইল্যাপাড়া, জাদি পাহাড়, খাজা মঞ্জিল এলাকা, বাদশাঘোনা, ফাতেরঘোনা, ইসলামপুর, হালিমা পাড়া, লাইট হাউজ পাড়া, সার্কিট হাউজ সংলগ্ন এলাকা, আবু উকিলের ঘোনা, রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকা, পাহাড়তলী, বাঁচা মিয়ারঘোনা, হাশেমিয়া মাদ্রাসার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিডিআর ক্যাম্পের পিছনে, লারপাড়া, সদর উপজেলা কার্যালয়ের পিছনে, পাওয়ার হাউস, লিংকরোড, কলাতলী বাইপাস সড়কের দুই পাশের বিশাল পাহাড়ী এলাকা, হিমছড়িসহ জেলা শহরের বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকায় পাহাড়কাটা চলছে।
কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র রাজবিহারী দাশ জানান, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাসবাসকারিদের ব্যাপারে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও বন বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। যৌথ প্রচেষ্টা করা না হলে পৌরসভার পক্ষে তাদের সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র হেলেনাজ তাহেরা বলেন, বর্ষার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারিদের অন্যত্রে সরিয়ে নেয়ার জন্য পৌরসভার পক্ষে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

এছাড়াও রামু, মহেশখালী, উখিয়া, টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়ার বিশাল পাহাড়ি এলাকাজুড়ে জেলার হতদরিদ্র ভূমিহীন, রোহিঙ্গা পরিবার সহ প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ পাহাড়ের চুড়ায় ও পাহাড়ি পাদদেশে বসবাস করছে। আবার এসব উপজেলার বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারাও পাহাড় কেটে দখলে নিচ্ছে। তারমধ্যে টেকনাফ উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন ফকিরা মোরা, ধুমপেরাং ঘোনা, গিলাতলি, বৈদ্যর ঘোনা, নাজির ঘোনা, শিয়ালর ঘোনা, উরুমের ছড়া, পল্লান পাড়া, নাইট্যং পাড়া, কেরুনতলি, বরুইতলি, ব্যাটলিয়ান সংলগ্ন মাঠ পাড়া, জাহালিয়া পাড়া, রোজার ঘোনা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, লেচুয়া প্রুং, পানখালী, উত্তর সিকদার পাড়া, রোজার ঘোনা, মিনাবাজার, রক্ষ্যইম, লম্বা ঘোনা, দৈঘ্যাকাটা, আমতলি, নোয়াখালী, কচ্চপিয়া, বড় ডেইল, চাকমা পাড়া, হলবনিয়া, আছারবনিয়া ও শামলাপুর এলাকায় পাহাড় কেটে বসতি করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।

উখিয়ার পূর্ব মরিচ্যা, ভালুকিয়া, হাতিরঘোনা, জালিয়াপালং, ইনানী, মনখালী, রাজাপালং, উখিয়া সদরের মৌলভীপাড়া, সিকদার বিল, টাইংখালী, রাহমতের বিল ও ফালং খালীতেও চলছে পাহাড় কাটা। এছাড়াও পাহাড়ের পাদদেশে এবং ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে প্রায় ৫‘শ পরিবার। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রভাবশালীরা বন বিভাগের সহায়তায় পাহাড় কেটে, তা দখলে রাখতে রোহিঙ্গাদের জায়গা দিচ্ছে।

রামুর রাজারকুল, উখিয়ারঘোনা, খুনিয়াপালং, ঈদগড়, কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, চকরিয়ার সুরাজপুর, ফাঁসিয়াখালী ফরেস্ট বিট, বরইতলী, খুটাখালী, মহেশখালীর উত্তর নলবিলা, গোরকঘাটা-শাপলাপুর সড়কের বিভিন্ন জায়গা, হোয়ানকের বড়ঘোনা, রাজারঘোনা ফুছরা এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস এবং পাহাড় কাটা চলছে। এখানে পাহাড় কাটা বন্ধে বনবিভাগের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই  বলে জানান স্থানীয় লোকজন।

এছাড়াও ৭ টি উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কেটে সমতল করে বসতি নির্মাণ করছে। ফলে পাহাড় কাটার কারণে প্রতিবছরই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও ওইসব এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে বাসবাস করে আসছে লক্ষাধিক পরিবার।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উপ-বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস বলেন, জেলা প্রশাসকের সাথে আলাপ করে পাহাড়ে বসবাসকারিদের পুর্ণবাসন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। একই সাথে পাহাড়ে বসবাসকারিদের সচেতনতা বৃদ্ধি জন্য নানা কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, উচ্ছেদ করা যায়। তবে মানবিক কারণে উচ্ছেদ না করে স্থায়ীভাবে অন্যত্রে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে।

জেলাব্যাপী পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের সত্যতা স্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন বলেন, আশ্রয়ন প্রকল্পের অধিনে জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারিদের পুর্ণবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জেলার সকল ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারিদের সরিয়ে নেয়া হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। এরজন্য একটু সময় প্রয়োজন রয়েছে। তবে চলতি বর্ষার মৌসুমে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারিদের নিরাপদে সরিয়ে যেতে মাইকিং সহ নানা প্রচারণা চালানো হবে বলেও তিনি জানান।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, কক্সবাজারে শীঘ্রই একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তারা পাহাড় কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া নিবে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতেও ভূমিকা রাখবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন