ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ১৯ বছর পূর্তি আজ

ইয়াসমিন

ডেস্ক নিউজ:

 দেশের ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরোচিত ঘটনা পুলিশ হেফাজতে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ১৯ বছর পূর্তি আজ ২৪ আগস্ট রোববার। ১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরের কয়েকজন কুলাঙ্গার পুলিশ সদস্য ওই কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। ওই ঘটনার পর থেকেই দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

ইয়াসমিনের মা শরিফা খাতুন দেশের সকল রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক সংগঠনের নেতাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিশু ও নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সামাজিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান।

১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সর্বস্তরের জনতা। তখন প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে দিনাজপুর শহরের সামু, সিরাজ, কাদেরসহ সাতজন নিরপরাধ ব্যক্তি নিহত হন। এরপর তৎকালীন দিনাজপুর সিআইডি জোনের এএসপি আফজাল আহমেদ বাদী হয়ে অভিযুক্ত ৩ পুলিশ  সদস্যের বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি মাহফুজার রহমান তদন্ত শেষে তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেবসহ নয়জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করেন। মামলাটি নিরাপত্তাজনিত কারণে দিনাজপুর থেকে রংপুরে স্থানান্তর করা হয়।

তৎকালীন রংপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মতিনের আদালতে ইয়াসমিন হত্যা মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে ২০০৭ সালের ৩১ আগস্ট ৩ পুলিশ সদস্যেকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের দেয়া রায় পরে উচ্চতর আদালতে বহাল থাকে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পুলিশের এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার এবং পিকআপ চালক অমৃত লালের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।

এ দিনটির স্মরণে মহিলা পরিষদ, বালুবাড়ী মহিলা উন্নয়ন সংস্থা, পল্লীশ্রীসহ বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়াসমিনের কবর জিয়ারত, দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এছাড়া ইয়াসমিনের মা শরিফা বেগম তার দিনাজপুর শহরের লালবাগ মহল্লার বাড়িতে কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন।

বর্বরোচিত সেই ঘটনা
দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার গরিব ঘরের শরীফা বেগমের মেয়ে ইয়াসমিন। গরিব পরিবারে জন্ম নেয়ায় চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে পেরেছিল সে। টাকা জমিয়ে আবার লেখাপড়া করার স্বপ্ন বুকে নিয়েই পাড়ি জমায় ঢাকায়। ঢাকায় এসে একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেয়। আট-নয় মাস কাজ করার পর নিজের বাড়িতে যেতে চায়। কিন্তু গৃহকর্তা তাকে দুর্গা পূজায় বাড়িতে যেতে বলেন। কিন্তু মায়ের জন্য মন ছুটে যায় ইয়াসমিনের। আর সে কারণেই হয়তো ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় ইয়াসমিন।

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিল কিশোরী ইয়াসমিন। ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে পড়ে সে। বাসটি রাত ৩টার পরে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় এসে পৌঁছায়। তিন রাস্তার মোড় বলে সেখানে রাতেও চায়ের স্টল, খাবারের দোকান প্রায়ই খোলা থাকে। বাসের সুপারভাইজার খোরসেদ আলম ও হেলপার সিদ্দিকুর রহমান ইয়াসমিনকে সেখানে নামিয়ে জনৈক চা দোকানদার জোবেদ আলীকে অনুরোধ করেন, যেন ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী কোনো গাড়িতে উঠিয়ে দেন।

সে সময় জয়ন্ত নামে একজন যাত্রীও বাস থেকে নামেন। বাস থেকে নেমে জয়ন্ত ও ইয়াসমিন জোবেদ আলীর চায়ের দোকানের পাশেই একটি দোকানে নাস্তা খায়। আবদুর রহিম নামে এক পান দোকানদার ইয়াসমিন কীভাবে দিনাজপুরের রামনগরে যাবে জানতে চাইলে জয়ন্ত তাকে পৌঁছে দেবে বলে জানান। এ সময় উপস্থিত কয়েকজন আপত্তি জানিয়ে ইয়াসমিনকে তারাই দিনাজপুরগামী গাড়িতে তুলে দিতে চান।

এর পর বীরগঞ্জ থেকে আসা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের (নং-ম-০২-০০০৭) চালক অমৃতলাল বিষয়টি জানতে চান। পিকআপ ভ্যানে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল এবং আব্দুস সাত্তার বসে ছিলেন। অমৃতলাল এ সময় ইয়াসমিনকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে ইয়াসমিন সকাল না হওয়ায় যেতে সাহস পায়নি। এরপর অমৃতলাল ধমক দিয়ে তাকে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যান।

যাওয়ার সময় ইয়াসমিন তাদের কুমতলব আঁচ করতে পেরে অন্ধকারে পিকাপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায়। এরপর পিকআপ ভ্যানটি আনুমানিক তিনশ গজ দূরে সাধনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে দাঁড় করিয়ে পুলিশ টর্চ দিয়ে তাকে খুঁজতে থাকে। এ সময় দুজন রিকশাচালকের কাছে পুলিশ জানতে চায়, তাদের পিকআপ ভ্যান থেকে যে মেয়েটি লাফ দিয়েছে, তাকে তারা দেখেছে কিনা? ঠিক ওই মুহূর্তে ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী একটি নৈশ কোচের হেডলাইটের আলোয় পুলিশ এবং রিকশাচালকরা ইয়াসমিনকে রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর পুলিশ আবার ইয়াসমিনকে পিকআপ ভ্যানে তুলে নেয়।

পরে ওই এলাকার লোকজন রাস্তায় রক্তের দাগ, পাশে ইয়াসমিনের জুতা, রুমাল, হাতপাখা ও ভাঙা চুড়িও পড়ে থাকতে দেখেন। এর ঘণ্টা তিনেক পরে গোবিন্দপুর সড়কে ব্র্যাক অফিসের সামনে ইয়াসমিনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর উত্তর গোবিন্দপুর এলাকায় পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশে কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) স্বপন কুমার প্রকাশ্যে লাশ বিবস্ত্র করে ফেললে উৎসুক জনতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং ঘটনার পরদিনই দিনাজপুরে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং হত্যা ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, দিনাজপুর কোতোয়ালি পুলিশ বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য ‘একজন অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা করে। লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বালুবাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের কোনো ধরনের গোসল ও জানাজা পড়ানো হয়নি।

২৫ আগস্টের বিক্ষোভে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সাতজন। ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে ইয়াসমিনের পরিবারকে হুমকিও দেয়া হয় অনেকবার।

এ ঘটনায় সম্মিলিত নারী সমাজের পক্ষ থেকে ‘২৪ আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন