কক্সবাজার সৈকতের ভাঙনরোধের উপায় বের করেছেন বিজ্ঞানীরা

fec-image

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে সমুদ্রসৈকতের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রের অধিকাংশ এলাকা এখন ভাঙনের কবলে। ইতোমধ্যে কলাতলী, সুগন্ধা, সিগাল, লাবণী ও শৈবাল পয়েন্ট ভেঙে গেছে। জোয়ারের পানি এখন ঝাউবাগানে ঢুকে পড়েছে। এতে পর্যটকদের কাছে সৌন্দর্য হারাচ্ছে সমুদ্রসৈকত। এ অবস্থায় ভাঙন প্রতিরোধে দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে উপায় বের করেছেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা।

ভাঙন রোধে কেয়া ও নিসিন্ধা গাছসহ সামুদ্রিক উদ্ভিদ প্রকৃতির গাছ রোপণের পরামর্শ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এতে সমুদ্রপাড়ে প্রাকৃতিকভাবে ডেইল তৈরি হবে। সেইসঙ্গে সৌন্দর্যবর্ধিত ঝাউবাগান রক্ষার পাশাপাশি হারানো জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। একইসঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রঙ তুলে ধরবে সমুদ্রসৈকত।

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বোরি) মহাপরিচালক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘সমুদ্রের ভাঙনরোধে একটি অসাধারণ গাছ হচ্ছে কেয়া। ভাঙনরোধ ও ঝাউগাছ রক্ষা করতে কেয়া গাছের বিকল্প নেই। কেয়া গাছের পাশাপাশি নিসিন্ধা ও নেন্টেনাসহ সামুদ্রিক উদ্ভিদ সাগরের ঢেউয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠবে বালুর ডেইল। মূলত সাগরের স্রোতে বালু এসে উপকূলে জমা হয়ে সৈকত তৈরি হয়। এসব গাছ লাগানোর ফলে বালুর ডেইল সমুদ্রপাড়ে বেড়িবাঁধ তৈরি করবে। এতে সমুদ্রের আকার বড় হবে, ফিরে আসবে জীববৈচিত্র্য।’

ঝাউগাছ সমুদ্রের ভাঙন প্রতিরোধ করতে পারছে না উল্লেখ করে বেলাল হায়দার বলেন, ‘সমুদ্রপাড়ের ঝাউগাছ সৌন্দর্য বহন করলেও ভাঙনরোধে কোনও কাজে আসছে না। কারণ ঝাউগাছ সমুদ্রপাড়ের বালু ধরে রাখতে পারে না। জোয়ারের পানি যখন ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে ঝাউগাছ হেলে পড়ে। তাই এই নান্দনিক গাছকে রক্ষা করতে হলে ঝাউবাগানের সামনে বালিয়াড়িতে প্রাকৃতিকভাবে ডেইল তৈরি করতে হবে। এজন্য কেয়া গাছ লাগাতে হবে।’

জিওব্যাগ ফেলে সৈকতের ভাঙনরোধ সম্ভব নয় জানিয়ে এই সমুদ্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সমুদ্রের যে প্রচণ্ড ঢেউ তা যেন সমুদ্রেই বিলীন করে দেওয়া যায় সে ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ঢেউ যাতে প্রচণ্ড গতি নিয়ে আছড়ে পড়তে না পারে সেজন্য উন্নত দেশের মতো আমাদের সমুদ্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য আরও বেশি গবেষণা করা প্রয়োজন।’

এদিকে, সমুদ্রসৈকতের ভাঙনরোধসহ নানা বিষয়ে সমুদ্রবিজ্ঞানীরা একের পর এক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, সমুদ্রপাড় ও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে কেয়াবন সৃষ্টি করলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। কারণ কেয়াগাছ সমুদ্রের বালুর বন্ধন তৈরি, মাটির ক্ষয়রোধ ও সামুদ্রিক বাতাসের তীব্র প্রবাহ ঠেকাতে ভূমিকা রাখে। এ কারণে উপকূলীয় অঞ্চল সুরক্ষায় কেয়াগাছের গুরুত্ব অপরিসীম। কেয়াবনই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপের জনবসতি রক্ষা করে চলছে।

গবেষকরা বলছেন, কেয়া গাছে রয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান পুষ্টি ও ঔষধিগুণ। সম্প্রতি এর ঔষধিগুণ কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি হচ্ছে মৃগীরোগ, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসসহ অন্তত ১৬টি রোগের প্রতিষেধক। তাই সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশের ব্লু ইকোনমি তথা সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতিতে কেয়া গাছ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

কেয়া গাছ নিয়ে সমুদ্র বিজ্ঞানীদের গবেষণা

কেয়া গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এটি লম্বায় তিন-চার মিটার পর্যন্ত হয়। এই গাছের কাণ্ড গোলাকার ও কাঁটাযুক্ত। কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়। গাছগুলো প্রায় বাঁকা হয়। গাছের নিচে থেকে মোটা শাখা পর্যন্ত বেশ কিছু মূল বের হয়ে মাটিতে ভিত্তি তৈরি করে। এগুলোকে ঠেসমূল বলা হয়। এই মূল গাছের কাণ্ডকে দৃঢ়ভাবে মাটির সঙ্গে যুক্ত করে এবং গাছের ভার বহনে সহায়তা করে। পাতা পাঁচ-সাত ফুট লম্বা, দুই থেকে তিন ইঞ্চি চওড়া, পাতার কিনারা করাতের মতো খাঁজ কাটা হয়। দেখতে অনেকটা আনারসের পাতার মতো। আশ্বিন-কার্তিক মাসে কেয়া গাছে আনারসের মতো ফল হয়। লম্বায় সাত-আট ইঞ্চি আকারের ফল দেখতে কমলা, পীত বা ধূসর রঙের মতো। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কেয়া ফুল দেয়। একে তাই বর্ষার ফুল বলা হয়। ফুল সাদা ও সুগন্ধিযুক্ত। স্ত্রী পুষ্পগুলো পুং পুষ্পের তুলনায় আকারে ছোট হলেও সুগন্ধ বেশি। ফুলে মধু না থাকলেও ভ্রমর বসে। প্রাচীনকাল থেকেই কেয়া ফুলের সুগন্ধ এবং ভেষজ গুণের কথা সুবিদিত হলেও মেধাস্বত্ব বা ঐতিহ্যগত জ্ঞান হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীন সাহিত্যেও লিপিবদ্ধ আছে কেয়ার কথা।

সেন্টমার্টিনের দক্ষিণপাড়ার ষাটোর্ধ্ব রশীদ মিয়া বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে দ্বীপের বাসিন্দারা ঘরের ছাউনি হিসেবে কেয়া পাতা, দড়ি হিসাবে এর শেকড় এবং খুঁটি ও অন্যান্য কাজে এর কাণ্ড ব্যবহার করতেন। কিন্তু গত প্রায় তিন দশকে এই দ্বীপে পর্যটন শিল্পের বিকাশের কারণে কেয়া গাছের ব্যবহার কমে গেছে। শিশুরা কৌতূহলবশত কেয়া ফলের শাস খেলেও বর্তমানে এর কোনও বাজারমূল্য নেই। দ্বীপের বাসিন্দারা সমুদ্রের ঢেউ ঠেকাতে ও জোয়ার থেকে মাটির ক্ষয়রোধে কেয়া গাছ ব্যবহার করছেন।’

একই এলাকার শামসুল আলম বলেন, ‘কেয়া গাছ সমুদ্র উপকূলে আসা বালুর বন্ধন তৈরি, মাটির ক্ষয়রোধ ও বাতাস বিরতি হিসেবে কাজ করে। উচ্চ লবণাক্ততা, খরা এবং জলাবদ্ধতা সহনশীল কেয়া গাছ। তীব্র লবণযুক্ত বাতাসের ঝাপটা ও বালুর বিস্ফোরণেও টিকে থাকে। উচ্চমাত্রার সৌর বিকিরণের জন্যও কেয়া গাছ সহনশীল।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন