খাগড়াছড়িতে সবার নজর এখন সোনা মিয়ার টিলায়

fec-image

টিলাটির নাম বর্তমানে দুটি। একটি হচ্ছে সোনা মিয়ার টিলা আর অন্যটি সাধনা টিলা। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার এ দুটি নাম পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যে ভূমির অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধের পরিচয় বহন করছে। এ ধরনের বিরোধই পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য এলাকাগুলোতেও শান্তির পথে মূল বাধা হিসেবে চিহ্নিত।

খাগড়াছড়ির অনেকের কাছেই সোনা মিয়ার টিলা একটি আতঙ্কের নাম। সেখানে গেলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের খপ্পড়ে পড়তে হতে পারে এমন ভীতি অনেকেরই। বিশেষ করে সেখান থেকে উচ্ছেদ হওয়া বাঙালিদের জন্য এটি এখন নিষিদ্ধ এলাকা।

সোনা মিয়া ঢাকার বিক্রমপুর থেকে প্রায় ৩৮ বছর আগে ওই টিলার জঙ্গল কেটে বসত গেড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল দেশের অন্যান্য এলাকার নদী ভাঙনে বসতভিটা হারানো মোট ৮২২টি বাঙালি পরিবার। ওই টিলা এবং এর আশেপাশের চারটি মৌজার মোট ৮১২টি পরিবারক মোট চার হাজার ৬০ একর খাসজমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল পরিবারগুলোকে। মৌজাগুলো হচ্ছে- ৩৩ নম্বর নুনছড়ি, ৪৯ নম্বর জারুলছড়ি, ৫০ নম্বর বাঘাইছড়ি এবং ৫১ নম্বর দিঘিনালা। কিন্তু সেখানে বসতি স্থাপন ও চাষাবাদ শুরু করার ১৪ বছর পরই শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র হামলার মুখে তাদেরকে উচ্ছেদ হতে হয়।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিরাপত্তার জন্য সেখান থেকে সরিয়ে আনে। বাঙালিদের এ সমস্ত এলাকা এখন সোনা মিয়ার টিলা নামেই পরিচিত। সেখানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও আছে সোনা মিয়ার নামে। কিন্তু সোনা মিয়ার নামটি এখন আর মানতে রাজি নয় পাহাড়িদের একাংশ। স্কুলের কাছেই টিলার প্রবেশমুখে সাইন বোর্ড লাগিয়ে লিখে রেখেছে ‘সাধনা টিলা বনবিহার। উচ্ছেদ হওয়া বাঙালি পরিবারগুলোর আপত্তি উপেক্ষা করে টিলায় গড়ে তোলা হচ্ছে প্রায় ৪০ একর জমির ওপর বৌদ্ধ মন্দির। সেখানে কিছু বসতবাড়িও গড়ে তুলেছে পাহাড়িরা।

৮১২ পরিবারের নেতা সোনা মিয়া উচ্ছেদ হওয়া টিলায় না ফিরতে পারার কষ্ট নিয়েই গত বছর গত হয়েছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন ‘গুচ্ছগ্রাম’ নামের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। ৮১২ পরিবার গত বছরে বেড়ে এখন ১৫/১৬ হাজার পরিবারে পৌঁছেছে। কিন্তু সরকারি সহায়তা হিসেবে মাসে ৮৪ কেজি চাল আর গম পাচ্ছে ৮১২-এরও কম পরিবার। ভুক্তভোগী এ পরিবারগুলোর ভরসা ৩৮ বছর আগে পাওয়া জমি বরাদ্দের সরকারি কাগজ। প্রতিবছর সেসব জমির খাজনাও দিয়ে আসছে তারা।

জানা যায়, বাঙালি পরিবারগুলো সোনা মিয়া টিলা এলাকা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর শান্তিচুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ (প্রসিত) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে পাহাড়ি কিছু পরিবার ২০১৬ – ১৭ সালে বসতবাড়িগুলো গড়ে তোলে। এতে স্থানীয় পাহাড়ি জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজসও ছিল। এক্ষেত্রে আদালতের আদেশেরও তোয়াক্কা করা হয়নি। উচ্ছেদের পর বাঙালি পরিবারগুলোর গড়ে তোলা বাগানের সুফল এখন ভোগ করছে পাহাড়িরা। বাঙালি পরিবারগুলো এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বারবার আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পায়নি। সর্বশেষ গত বছর ১ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে ওই জমি উদ্ধারের ব্যবস্থা নিতে বললেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

গত শুক্রবার বিকেলে ওই টিলায় সরেজমিনে দেখা যায় সেখানে গড়ে ওঠা ছনে ছাওয়া ও বাঁশের চাটাই ঘেরা ঘরের বেশ কয়েকটি খালি। টিলা থেকে ট্রাক্টরে নিয়ে আসা হচ্ছে ছন এবং কাঠ। একটি ঘর থেকে উঁকি দিলেন এক বৃদ্ধা। তিনি কোনো কথা বললেন না। সন্ধ্যার কিছুটা আগে বৃদ্ধার ওই বাসায় ফিরল জয়ন্তি চাকমা নামের এক কিশোরী। সেও কোনো কথা বলতে রাজি হলো না। টিলায় দেখা মিলল আবু চাকমা নামের এক মোটরসাইকেল চালক যুবকের। বললেন, বাঙালিদের কথা জানি না। এখানে আমার দাদা-দাদির জমি আছে। হিমেল চাকমা নামের আরেক যুবক বললেন, ‘এখানে আমার বোন জামাইয়ের বাড়ি। আমি বেড়াতে এসেছিলাম।’ শ্যামল মনি চাকমা নামের আরেক যুবকের দেখা মিলল ধারাল দা হাতে। সেটি উঁচিয়ে তিনি বললেন, ‘এই টিলা আমাদের।’

শ্যামল মনি চাকমা জানিয়ে দিলেন এ টিলা তাদের

অন্যদিকে শুক্রবার দুপুরে দিঘিনালার মধ্য বোয়ালখালী গুচ্ছগ্রামে কথা হয় মো. শাহজাহান ফরাজির সঙ্গে। তিনি বর্তমানে সোনা মিয়ার টিলা থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা বাঙালি পরিবাবারগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন। বললেন, আমরা এখানে পাহাড়ি বাঙালি সকলে মিলে সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করতে চাই। ওই টিলা আমাদের। ওখানে আমাদের স্বজনদের কবরের ওপরেও অত্যাচার হচ্ছে। ওই জমিতে আমাদের আইনসঙ্গত অধিকার রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কোনো আলাদা দেশ নয়। এদেশের আইন সবার জন্য প্রযোজ্য। পহাড়ে কোনো একটি সশস্ত্র দল নিজেদের ইচ্ছে মতো যা খুশি করবে তা হতে পারে না।

শাহজাহান ফরাজি যখন এসব কথা বলছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে প্রয়াত সোনা মিয়ার ছোট ভাই ইমতাজউদ্দীনসহ আরো অনেকেই ছিলেন। ছিলেন ১১৫ বছরের বৃদ্ধ রতন আলী ফরাজিও। তাঁদের অভিযোগ, রহস্যজনক কোনো কারণে জেলা প্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নের কোনো চেষ্টা করছে না। কোন কোন তারিখে তাঁরা এবিষয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছেন প্রমাণসহ তাও জানালেন।

কিন্তু গত শুক্রবার সকালেই খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস তাঁর নিজ কার্যালয়ে সোনা মিয়া টিলা নিয়ে এই বিরোধ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি এখানে আসার পর গত ১৫ মাসে ওই টিলার বিষয়ে আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ বা আবেদন করেননি। কোনো নির্দেশের কথাও আমার জানা নেই।

এদিকে স্থানীয় অনেকেই বলছেন, খাগড়াছড়িতে শান্তির প্রয়োজনে সোনা মিয়া টিলার সমস্যাটির সমাধান দরকার। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ বাস্তবায়নের সেখানে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহসহ বসবাসের প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: খাগড়াছড়ি, শান্তিচুক্তি, সোনা মিয়ার টিলা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন