খাদ্য বিভাগে দরপত্র আটকে রেখে লুটপাটের মহোৎসব

fec-image

পার্বত্য বান্দরবান’সহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১১ জেলায় সরকারি খাদ্য পরিবহনে প্রায় দু’বছর ধরে কোনো দরপত্র আহ্বান করছে না চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরে চিঠি চালাচালিতে তিন মাস অন্তর সময় বাড়িয়েই সংঘবব্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খাদ্য পরিবহন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সরকারের এই সংস্থাটি। আর এতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা উপেক্ষা করে ব্যয় করা হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। এদিকে দরপত্র আহ্বান না করে গোপন আঁতাতে খাদ্য পরিবহন কাজ করায় বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামের খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারি আর স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গোপন আঁতাতে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের খাদ্য পরিবহন খাতটিকে কব্জায় নিয়ে সরকারি কোষাগাড় লুটে মেতে আছে। আর এই কাজটিকে সহজকরণে কৌশলে সরকারের এই সংস্থাটির খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান (টে-ার) বার বার আটকে দেওয়া হচ্ছে। যার মূলে রয়েছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং চলাচল ও সংরক্ষক কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা।

বিগত ২০২০-২০২১এবং চলতি ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কী পরিমান খাদ্য পরিবহন ও এইখাতে সরকারের কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে এই বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. জহিরুল ইসলাম খান। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, শশুর-শ্বাশুড়ি এবং সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারি খাদ্য বিভাগে ঠিকাদারী করা এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ি বিগত দু’বছর ধরে খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান না করার কারণ জানতে চেয়েও কোনো উত্তর মিলেনি এই খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে। চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের ভাষ্য, এসব বিষয়ে কথা বলতে হলে খাদ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে।

তবে তাঁর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ৪’শ ৬৯ প্রতিষ্ঠান পরিবহন ঠিকাদার হিসেবে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় অর্ধশত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই ও শশুর-শ্বাশুড়িসহ অন্যান্য স্বজন। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারি ঠিকাদার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। রয়েছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটও।

খাদ্য বিভাগের তথ্যমতে, দেশে সরকারিভাবে আমদানি করা খাদ্যশস্যের বেশির ভাগই আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে প্রান্তিক কৃষক ও চালকল মালিকদের কাছ থেকেও খাদ্যশস্য ক্রয় করে সরকার। এসব খাদ্যশস্য সংরক্ষণে চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাটে রয়েছে কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম। একইভাবে গম মজুদে নগরের পতেঙ্গায় রয়েছে সাইলো। পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর রেশনের চাল, গম এবং সরকারি খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের খাদ্যসহায়তা চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয় এসব ঠিকাদার। এ জন্য দূরত্ব আর যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনা করে ঠিকাদারদের মাইলপ্রতি পরিবহন ভাড়া দেয় খাদ্য বিভাগ। প্রতিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বছরে একাজে আয় করে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী এই ধরনের পরিবহন ঠিকাদার কাজের জন্য স্থানীয় খাদ্য বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। দূ’বছর পরপর প্রকাশ্য দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কর্মদক্ষতা ও অন্যান্য শর্ত বিবেচনায় নতুন ঠিকাদার নিয়োগ এবং লাইসেন্স ইস্যুর বিধান আছে। ২০১৮ সালে ইস্যু করা ৪’শ ৬৯টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের জুনে। এরপর দু’বছর গত হতে চলেছে নতুন কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে লাইসেন্স ইস্যুর উদ্যোগ নিচ্ছেন না খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বরং আগে নিয়োগ দেওয়া বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স তিন মাস অন্তর সাময়িক নবায়ন দেখিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তাঁরা।

অভিযোগ রয়েছে, এরআগে ২০১৪-২০১৫ ও ২০১৫-২০১৬ দু’অর্থ বছরের জন্য খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত চার বছর দরপত্র আহবান ঠেকিয়ে রেখে একইভাবে এই সিন্ডিকেট কাজ কব্জায় রেখে দেয়। পরে বিষয়টি সরকারের উচ্চ মহলে জানাজানি হওয়ায় সর্বশেষ ২০১৮-২০১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দরপত্রের মাধ্যমে পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ দেয়।

ব্যবসায়ী জাহেদুল হক জানান, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তিনি ঠিকাদার প্রতিনিধি হয়ে খাদ্য বিভাগে কাজ করছেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন ঠিকাদার হিসেবে অর্ন্তভুক্ত হতে চাচ্ছেন তিনি। তবে খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারিদের স্ত্রী, ভাই, শালী ও শশুড়-শ্বাশুড়িসহ স্বজনদের ঠিকাদার হিসেবে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার নতুন আর কেউ ঠিকাদারী সুযোগই পাচ্ছেন না।

একই কথা বলেন নগরের অক্সিজেন এলাকার রুম্মান সিকদার। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম হালিশহর কেন্দ্রীয় খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্রের (হালিশহর সিএসডি) একাধিক কর্মকর্তার স্ত্রীসহ স্বজনদের অর্ন্তভুক্ত করার ব্যাপারে খাদ্য অধিদপ্তরে অভিযোগও আছে। তবে সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে একাধিক স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা খাদ্য বিভাগে ঠিকাদারী করছেন। রুম্মান সিকদারের অভিযোগ, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের কারণে নতুন কেউই এই সংস্থাটিতে ঠিকাদারীতে অর্ন্তভুক্তের সুযোগ পাচ্ছেন না। রাঙামাটির ব্যবসায়ী আলমগীর মানিক, মঈন উদ্দিন বাপ্পী, খাগড়াছড়ির মো. সাইফুল ইসলাম ও বান্দরবানের ইসমাইল হাসানেরও একই অভিযোগ।

খাদ্য পরিবহন ঠিকাদারদের একটি সূত্র জানায়, সরকারি চাহিদাপত্র অনুযায়ি (ডিও) বিভিন্ন বাহিনীর রেশনের চাল, গম এবং সরকারি খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের খাদ্যসহায়তা চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১১টি জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চট্টগ্রামের দূ’কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদাম (সিএসডি) ও সাইলো থেকে বের করা হলেও তা গন্তব্যে পৌছানো হয় না। খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিবহন ঠিকাদার ও স্থানীয় ডিও ব্যবসায়ীরা গোপন আঁতাতে তা চট্টগ্রাম মহানগরের কোনো গুদামে খালাস করে নেয়। তবে সংশ্লিষ্ট খাদ্যগুদামে পৌছানো হয় শুধুমাত্র ইনভয়েস বা চলাচল রশিদ। আর এর বিপরীতে সরকারের অযথা কোটি কোটি টাকা পরিবহন ভাড়া ব্যয় দেখিয়ে লুটে নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট।

এই বিষয়ে জানতে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ মুজিবুর রহমান’র মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন