চকরিয়ায় ফিল্মি স্টাইলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিপদগামী কিশোর গ্যাং

fec-image

রাজধানী ঢাকা কিংবা বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের মতো কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার প্রতিটি জনপদে বর্তমান সময়ে অনেকটা ফিল্মিস্টাইলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উঠতি বয়সের বিপদগামী কিশোর গ্যাং। দিবারাত্রি তাঁরা মাদক বেচাকেনা, সেবন, ডিজে পার্টি ও চুরি-ছিনতাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই গ্যাংয়ের কিশোররা। বর্তমানে চকরিয়া শহর ছাড়াও উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের অবাধ বিচরণ। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দলবেঁ দিনের বেশিরভাগ সময় বিপনী বিতান এবং স্কুল-কলেজের সামনে অকারণে সময় কাটাচ্ছে। সুযোগ বুঝে গ্যাংয়ের সদস্যরা স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী ও বিপনী বিতানে আগত নারী ক্রেতাদেরকে উত্ত্যক্ত করছে। বাগে ফেলে নিরীহ মানুষকে আটকিয়ে সবকিছু লুটে নিচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত বেশির সদস্যের আছে মোটর সাইকেল। দামি মোটরসাইকেলে করে ঘুরে বেড়াতে তাঁরা বেশি পছন্দ করেন। অনেকে শোরুম থেকে কিনে ব্যবহার করলেও বেশির ভাগ কিশোর ব্যবহার করেন চোরাই মোটর সাইকেল। তাদের ব্যবহৃত বেশিরভাগ মোটর সাইকেলে বৈধ কাগজপত্রও নেই বলে নিশ্চিত করেছেন চকরিয়া ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা। গরিব ও ধনী-দুই শ্রেণির পরিবারের কিশোরদের মধ্যেই এই গ্যাং কালচারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গ্যাং চক্রে নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে শুরু করে নামী-দামি পরিবারের ছেলের রয়েছে। সদস্যদের মধ্যে অনেকে এখনো লেখাপড়া করলেও বেশিরভাগ আছেন বেকার। তাদের মুল পেশা হলো মাদক বাণিজ্য।

স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, কিশোর গ্যাং দলের সদস্যদের চলাফেরা দেখতে অনেকটা ভিন্নরকম। তাদের পরনে থাকে টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস। চুলে নিত্যনতুন স্টাইল। তাদের বিচরণ পাড়া, মহল্লা ও ফুটপাতের অলিগলি। সেখানে থাকা জড়ো হয়ে আড্ডা দেয় তারা। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দামি লাইটার দিয়ে ধরিয়ে হিরোদের মতো দেয় টান। উচ্চস্বরে গায় হিন্দি কিংবা ইংরেজি গান।
দিনের বেলায় যেমন তেমন রাত বাড়লেই চকরিয়া শহর ও আশপাশ এলাকা হয়ে যায় এমন ‘ডিসকো পোলাদের’ মোটর ও কার রেসিং। এলাকাভেদে এদের রয়েছে আলাদা আলাদা কিশোর গ্যাং গ্রুপ। এসব কিশোর গ্যাং বর্তমানে পুরো চকরিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যাদের অনেকেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অধিকাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়ায় দন্ডবিধি অনুযায়ী পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। তাদেরকে আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাতে হয়। সেই কারণে অযথা ঝামেলা এড়াতে পুলিশও কঠোর হচ্ছেনা। এ অবস্থায় কিশোরদের অপর্কম নিয়ে অভিভাবক মহলে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ-আতঙ্ক।

অবশ্য আশার কথা হলো, দাপিয়ে বেড়ানো এসব কিশোর গ্যাং চক্রের অপরাধ প্রবণত রুখতে চকরিয়া থানা পুলিশকে ইতোমধ্যে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন। তিনি চকরিয়া উপজেলা কমিউনিটি পুলিশের সমাবেশে বলেছেন, চকরিয়া উপজেলায় আগামীতে কোন ধরণের কিশোর গ্যাং থাকবেনা। বিপনী বিতান ও স্কুল কলেজের গেইটের সামনে অযথা ঘুরাফেরা অবস্থায় যেই কিশোরকে পাওয়া যাবে তাকে আটক করবে পুলিশ।

তিনি বলেন, আটকের পর অভিযুক্ত কিশোরের পরিবারকে খবর দেবেন। প্রথমে ওই কিশোরকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে বুঝিয়ে পরিবারের হাতে তুলে দেবেন। দ্বিতীয়বার ও ততৃীয়বার একইভাবে সুযোগ দেবেন। তারপরও ভালো পথে না আসলে ওই কিশোরের সঙ্গে তাঁর অভিভাবকের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনী প্রদক্ষেপ নেবেন।

চকরিয়া উপজেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট লুৎফুল কবির বলেন, সম্প্রতি সময়ে চকরিয়া উপজেলার প্রতিটি জনপদে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উঠতি বয়সের বিপদগামী কিশোর গ্যাং। নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে গত রোজার মাসে কিশোর গ্যাং চক্রের হাতে খুন হয়েছে মেধাবী ছাত্র আনাস ইব্রাহিম। এই প্রবণতা এখনই রুখতে হবে। সেইজন্য প্রশাসনের পাশাপাশি অভিভাবক এবং শিক্ষক সমাজকে দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করতে হবে।

তিনি বলেন, কিশোরদের মধ্যেই ‘এডভেনচার ফিলিং’ বা ‘হিরোইজম’ ভাব বেশি দেখা যায়। কিশোর বয়সে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তাকে অপরাধী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। তারা এই বয়সে এমন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে বা ফলো করে- সেখান থেকেই তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। তারা দেখে যে অপরাধ যারা করছে তারা সমাজে বেশি লাভবান হচ্ছে, সেটা কিশোররা অনুসরণ করে। তাদের ওপর পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিশোরদের গ্যাং কালচার থেকে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.হাবিবুর রহমান বলেন, কিশোর গ্যাং চক্রের সদস্যরা ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে বড়ো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাবে। তাই এদেরকে সংশোধন করতে সর্বপ্রথম অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকসমাজকেও দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করতে হবে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর রাখলে তাদের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে চকরিয়া উপজেলাকে কিশোর গ্যাং মুক্ত করা হবে। সেইলক্ষ্যে থানা পুলিশের পক্ষথেকে পরিকল্পিতভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রথমে তাদেরকে সুন্দর পথে ফিরিয়ে আসতে সহযোগিতা ও সুযোগ দেব। কিন্তু সেটির হিতে বিপরীত হলে পরবর্তীতে পুলিশ কঠোর আইন প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে। তখন অভিযুক্ত কিশোর ও তাঁর পরিবার কাউকে ছাড় দেবোনা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন