টেকনাফে চলছে অপহরণ আতঙ্ক

fec-image

অপহরণ আতঙ্কে ভুগছেন কক্সবাজারের টেকনাফের পাহাড়ি এলাকা ও আশপাশে বসবাসকারী স্থানীয় ও রোহিঙ্গারা।

টেকনাফের গহিন পাহাড়-জঙ্গলে আস্তানা গড়ে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে সন্ত্রাসীরা। মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যার পর মরদেহ গুম করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

গত ছয়মাসে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্ধশত স্থানীয় ও রোহিঙ্গা অপহরণের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৩০ জন মুক্তিপণে ছাড়া পেয়েছেন বলে দাবি ভুক্তভোগী পরিবারের।

সবশেষ রোববার (৩০ এপ্রিল) সকালে টেকনাফের বাহারছড়ায় পানের বরজে কাজ করতে গিয়ে স্কুলছাত্রসহ দুজন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এসময় অপহরণে ব্যর্থ হয়ে আরও দুজনকে কুপিয়েছে অপহরণকারীরা।

রোববার অপহরণের শিকার দুজন হলেন টেকনাফের বাহারছরা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাহাজপুরার বাসিন্দা বাছা মিয়ার ছেলে রহিম উদ্দিন (৩২) ও মো. সরোয়ারের ছেলে কলেজছাত্র মো. রিদুয়ান (১৯)। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। আহতরা হলেন একই এলাকার বাসিন্দা দুই সহোদর আবদুল আমিন (২৫) ও আবদুল্লাহ (১৭)।

এর আগে গত ২৪ এপ্রিল দুপুরে টেকনাফের হ্নীলার জাদিমোরার নেচার পার্ক এলাকা থেকে পাঁচ রোহিঙ্গা কিশোরকে ধরে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা।

ভুক্তভোগী কিশোরদের স্বজনদের দাবি, ঈদ উপলক্ষে ওই কিশোররা ক্যাম্প থেকে ঘুরতে বেরিয়েছিল। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদের অপহরণের পর ফোন করে মুক্তিপণ হিসেবে জনপ্রতি চার লাখ করে মোট ২০ লাখ টাকা দাবি করে। পরে মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা।

তার আগে ১৬ মার্চ সকালে জাহাজপুরা এলাকা থেকে কলেজশিক্ষার্থী গিয়াস উদ্দিন (১৭), রশিদ আলম (২৬), জানে আলম, (৪৫), জাফর আলম (৪০), জাফরুল ইসলাম (৩০), ফজল করিম (৩০) ও আরিফ উল্লাহ (৩০) অপহরণের শিকার হন। ১৯ মার্চ জাদিমুড়ার জুম্মা পাহাড়ি এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন মোহাম্মদ ছৈয়দ। ২৪ মার্চ রহমত উল্লাহ নামের আরেকজন অপহরণের শিকার হন।

২ মার্চ টেকনাফ বাহারছড়ার মারিশবনিয়া এলাকা থেকে প্রবাসী হোসেন আলীর ছেলে মো. সালমান (৫) এবং মো. আলীর ছেলে ওবাইদুল্লাহ (১৩) অপহরণের শিকার হয়ে ৪ মার্চ ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণে ফিরে আসে।

২৮ জানুয়ারি বাহারছরা ইউনিয়নের চৌকিদার পাড়া এলাকায় নুরুল আমিনের ছেলে রহমত উল্লাহ (২৫) ও আলী আকবরের ছেলে আব্দুল হাফিজ অপহরণের শিকার হন। একইদিন উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন আবুল হোসেনের ছেলে আব্দু সালাম, গুরা মিয়ার ছেলে আব্দুর রহমান, রাজা মিয়ার ছেলে মুহিব উল্লাহ ও রাজা মিয়ার ছেলে আব্দুল হাকিম।

তথ্যমতে, টেকনাফ বাহারছড়ার জাহাজপুরা, হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নে বারবার অপহরণের ঘটনা ঘটছে। কখনো স্থানীয় আবার কখনো রোহিঙ্গারা অপহৃত হচ্ছেন। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এলেও অনেকে আর ফিরে আসেননি। এসব এলাকার কিছু চিহ্নিত অপরাধী রোহিঙ্গা অপরাধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন সময় অপহরণের মতো অপরাধ করছে।

বাহারছড়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হুমায়ুন বলেন, ‘আমরা শুনতে পেয়েছি আমাদের এক নারী ইউপি সদস্য এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চৌকিদার ইসহাক অপহরণ চক্রের সঙ্গে জড়িত। এরই মধ্যে অপহরণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন ইসহাক। এ বিষয়ে আমরা বারবার অভিযোগ করার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি আমরা।’

একাধিক সূত্র জানায়, হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এলাকার শাহ আলম গ্রুপ অপহরণের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তাদের অবস্থান পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় সহজে তাদের গ্রেফতার করতে পারে না পুলিশ। রয়েছে গিয়াস উদ্দিন নামের আরও একটি গ্রুপ। অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে গিয়াস উদ্দিন বর্তমানে কারাগারে। তাদের সঙ্গে রয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এসব গ্রুপের হাতে বিভিন্ন সময় কৃষক ও ছাত্রসহ ৬২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকি ২৮ জন রোহিঙ্গা।

ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে বাহারছড়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিনের মতো রোববার সকালে পাহাড়ের পাদদেশে পানের বরজে কাজ করতে যান চারজন। এসময় কয়েকজন সন্ত্রাসী অস্ত্রের মুখে তাদের ঘিরে ধরে অপহরণচেষ্টা করেন। তাদের সঙ্গে ওই চারজনের হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা দুজনকে কুপিয়ে জখম করে এবং অপর দুজনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে গহিন পাহাড়ে নিয়ে যায়।

অপহরণের শিকার শিক্ষার্থী রিদুয়ানের বাবা সরওয়ার আলম বলেন, পানের বরজে কাজ করা অবস্থায় আমার ছেলে অপহরণের শিকার হয়। এখন মুক্তিপণ দাবি করছে পাঁচ লাখ টাকা। এত টাকা আমি কীভাবে দেবো? আমরা তো পান বিক্রি করে কোনোরকম জীবিকা নির্বাহ করি। ছেলেকে উদ্ধারে প্রশাসনের সহায়তা কামনা করেন তিনি।

অপহরণকারীদের হাতে আহত আমিন ও আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সবাই মুখোশ পরা অবস্থায় ছিল। তারা কোনো রকমে পালিয়ে আসতে পারলেও রহিম উদ্দিন ও রিদুয়ানকে ধরে নিয়ে গেছে। ধারালো অস্ত্রের কোপে আমরা হাতে ও মাথায় আঘাত পেয়েছি।’

এ বিষয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মশিউর রহমান বলেন, জাহাপুরা পাহাড়ি এলাকায় কিছু বসতি আছে। তারা পানের বরজ, সুপারি, সবজি বাগান করেন। সেখান থেকে তাদের অপহরণের ঘটনা ঘটে। তাদের উদ্ধারে অভিযান চালানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘স্থানীয় কিছু চক্র জড়িত আছে বলে আমরাও শুনেছি। তাদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভুক্তভোগী কেউ সহজে তথ্য দিতে চান না।’

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, গত কয়েক মাসে আমার এলাকা থেকে অন্তত ২০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। রঙ্গীখালী এলাকায় কিছু অপরাধী রয়েছে। তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাও জড়িত। এসব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা গেলে অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধ কমে আসবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম বলেন, যেহেতু এলাকাটি দুর্গম তাই কৃষকদের আমরা বলেছিলাম তারা যেন পাহাড়ি এলাকায় সংঘবদ্ধ থাকেন। কিন্তু তারা বিষয়টি তেমন একটা আমলে নেন না। যে কারণে অপহরণকারীরা সুযোগ বুঝে তাদের অপহরণ করে। এতে আমাদেরকেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সব তথ্য নিয়ে এগোচ্ছি। অপরাধী চক্রকে সমূলে বিনাশ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে দুর্গম পাহাড় হওয়ায় কাজ করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।

সূত্র: জাগোনিউজ২৪

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপহরণ, আতঙ্ক, টেকনাফ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন