দুই মন্ত্রণালয়ের ‘উদাসীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন

ডেঙ্গুতে ১ হাজারের বেশি মৃত্যু

fec-image

সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার (১ অক্টোবর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে দেশে ডেঙ্গুতে এক হাজার ছয় জনের মৃত্যু হলো।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় আরো দুই হাজার ৮৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মোট আক্রান্ত হয়েছেন দুই লাখ ছয় হাজার ২৮৮ জন।

তবে দেশে ২২ বছরের মধ্যে বেশির ভাগ বয়সি মানুষ ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করছে। অন্যবছরের তুলনায় এবার মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আর ২০২২ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা যেখানে ৮৫৩ জন, সেখানে চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা এক হাজার ছয় জনে পৌঁছেছে।

এদিকে ‘গতানুগতিক’ পদ্ধতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ ও আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু ঠেকাতে সমন্বিত কোনো ব্যবস্থায় গড়ে তোলেনি এই দুই মন্ত্রণালয়। পুরো বিষয়টি তারা ‘পরিস্থিতির’ ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে কোনোকিছুই আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকেনি। এমন ‘উদাসীন’ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। এ বছর যে ডেঙ্গু বাড়তে পারে, তা চলতি বছরের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করা লার্ভা বা শূককীট জরিপেই আশঙ্কা করা হয়েছিল। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে পরিচালিত সেই জরিপে লার্ভার ব্যাপক উপস্থিতি পাওয়া যায়। পরে জুন মাসে পরিচালিত জরিপেও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে লার্ভার বেশি উপস্থিতি পাওয়া যায় ঢাকার বাড়িঘরে।

এ অবস্থায় মশক নিয়ন্ত্রণে কেবল ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ কিংবা ‘চিরুনি অভিযানের’ নামে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে ‘যৎসামান্য’ তৎপরতা চালানো হয়েছে, তা যথেষ্ঠ ছিল না বলে মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। মশা নিয়ন্ত্রণের অনেক পদ্ধতি আছে। এর কোনোকিছুই আমরা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারিনি। এখনো পারছি না। তারা (মেয়ররা) কাজ করতে পারেন না। আতিক (ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম) সাহেব হয়তো কোথাও কিছু একটা দেখলেন আর এখানে তা প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। কিন্তু আমাদের এখানে, আমাদের পরিবেশে সেটা কতখানি কার্যকর হবে তার কোনো ধারণাই হয়তো তাদের নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘এগুলো তো মুখে বললে হবে না। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। দেশকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে হবে। রাজনীতি খালি মুখের কথায় হয় না।’

সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কিংবা যতসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা ডেঙ্গু কন্ট্রোল করতে পারছি না। সফল হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। মানুষ মারা যাচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে হয়তো গণনার মধ্যেও আসছেন না।’

সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর উপচে পড়া ভিড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে মানুষ সিট পাচ্ছে না। ডিএনসিসি হাসপাতালে কিছু সিট পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষ সেখানে যায় না। মানুষ যায় ঢাকা মেডিকেলে, সোহরাওয়ার্দীতে, মুগদায়, সলিমুল্লায়। ঘোরাঘুরি করে। দেরি হয়ে যায়। পরে বলা হয়, খুব বেশি দেরি করে ফেলায় অবস্থার অবনতির কারণে মৃত্যু ঠেকানো গেল না।

‘দেরি হবে কেন? ঢাকা মেডিকেলে একটা আলাদা হলরুমই থাকতে পারে। শুরুতেই রোগীকে সেখানে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। যদি ভালো হয়ে যায় তাহলে ছেড়ে দেবো। যদি ভালো না হয় তাহলে মেইন ট্রিটমেন্ট ওয়ার্ডে নিয়ে আসব। তাদের বাড়িতে যেতে দেবো কেন? এটা কোনো কাজের কথা হতে পারে না। রোগীকে হাসপাতালে রাখার জায়গা থাকতে হবে।’ এ বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেনের ভাষ্য, ‘এখন স্বাস্থ্যবিভাগ বোধহয় একটা আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। তারা মনে করছে আমরা তো হাসপাতালে সেবা দিচ্ছি। কিন্তু সঙ্কটাপন্ন রোগী আসাটা তো ঠেকাতে হবে।’

ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঠেকাতে গতানুগতিক কর্মপদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘স্তরভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে না পারলে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব না। এখন গ্রাম-শহর সবজায়গায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খুলতে হবে। শহরে অস্থায়ীভাবে খুলতে পারে। গ্রামে তো কেন্দ্র আছেই। কিন্তু সেখানে যন্ত্রপাতি নেই। জনবল নেই। সেই জনবল দিতে হবে। ‘এটা পিরামিডের মতো হবে। একটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে থাকবে দুই-তিন-চারটা সেকেন্ডারি হাসপাতাল। সেকেন্ডারি হাসপাতালের সঙ্গে থাকবে ১০-১২টা প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টার।’

সরকারি খরচে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ কেবল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেই আছে মন্তব্য করে এই জনস্বাস্থ্যবিদ আরও বলেন, ‘এখন মানুষ টেস্ট করতে যাচ্ছে না। কারণ সরকারি রেটে টেস্ট করার সুবিধা কেবল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই আছে। বিশাল ভিড় ঠেলে পয়সা খরচ করে যাবে। রেজাল্ট নিতে আবার একই ঝক্কি। তাই মানুষ টেস্ট করতে যাচ্ছে না। অসুস্থ হয়ে পড়ছে কয়েকদিন পরেই। তখন সে সোজা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যাচ্ছে।’

বার বার বলা সত্ত্বেও নীতি-নির্ধারকরা বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ‘তারা ভাবছেন হাসপাতালে আমরা ডাক্তার বাড়িয়েছি, বেড বাড়িয়েছি, স্যালাইন বাড়িয়েছি। এতেই চলবে। কিন্তু চলছে না তো। একটা হাসপাতাল তার ক্যাপাসিটির বাইরে কতটুকু কাজ করতে পারে।

‘সবকিছু হাসপাতালের মধ্যে না ভরে এটাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি কেয়ারে করলে এই জনবল দিয়েই কাজ হবে। কিংবা জনবল কিছুটা বাড়াতে হবে। একজন ভলান্টিয়ারও কাজ করতে পারে পাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টারে। অল্প সময়ের প্রশিক্ষণেই। ডাক্তার সব জায়গায় লাগবে না। ছকের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ এদিকে এ সংক্রান্ত আলোচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ জোর দেন ঢাকার মশক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘অবৈজ্ঞানিক পন্থা’ অবলম্বন ও কারিগরি জ্ঞানের ঘাটতির ওপর।

তিনি বলেন, ‘যেকোনো রোগ প্রতিরোধ কিংবা তা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটা কারিগরি দিক থাকে। যেমন- কালাজ্বর বাংলাদেশে নির্মূল লক্যমাত্রা অর্জন করেছে। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফাইলেরিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। এ তিনটাই কিন্তু বাহকবাহিত রোগ। ওই রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যে কারিগরি দিকগুলো আছে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কিংবা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সেই কারিগরি দিকটার অনুপস্থিতি আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে কীটতত্ত্ববিদও নেই, রোগতত্ত্ববিদও নেই। এখন পর্যন্ত নেই। নিয়োগের তাগিদও নেই। সেই ক্যাপাসিটিও নেই। সুতরাং এটা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এভাবে চললে হবেও না। ওনারা (মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন) এটা বুঝতেও চান না।’

এ সময় মশক নিয়ন্ত্রণে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে ঢাকা এয়ারপোর্টে ভীষণ মশা বেড়েছিল। আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম মশা নিয়ন্ত্রণের। আমি প্রায় ২০-৩০ জন এন্টোমলজিস্ট ও অন্যান্য লোকবল নিয়ে কাজ করেছি। তখন ওখানকার মশার ঘনত্ব ছিল ৩৮৫। ১৫ দিনের মধ্যে তা কমিয়ে ১৫ তে নামিয়ে এনেছিলাম। ‘যদি আপনি পদ্ধতিগতভাবে না এগোন তাহলে চিরুনি অভিযান করেও কোনো লাভ হবে না।’

২০০০ সালে দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের বড় প্রাদুর্ভাব হয়। সে বছর ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছিল গত বছর, ২৮১ জন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ডেঙ্গু, মৃত্যু
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন