ত্রিপুরাদের গড়িয়া নৃত্যে উৎসবমুখর এখন পাহাড়ের পল্লীগুলো

fec-image

খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা পল্লিতে চলছে প্রধানতম সামাজিক উৎসব বৈসু, আর এই বৈসুর প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে খ্রেবাই (গরিয়া) নৃত্য। গরিয়া নৃত্যে এখন উৎসবমুখর পাহাড়ের পল্লীগুলোতে। বৈসু উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ের পাড়ায়-পাড়ায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী ফাতুং গোত্রের খ্রেবাই (গরিয়া) নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসু উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বির এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খ্রেবাই বা ‘গরিয়া নৃত্য।’ বৈসুর মূল আকর্ষণ এই খ্রেবাই/গরিয়া নৃত্য। পাহাড়ি জুম-জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই সংস্কৃতি। ত্রিপুরারা বিশ্বাস করেন যে, ভগবানের আরেক নাম বাবা ‘গরিয়া’। এই দেবতার কৃপাতে দেশে আসে সুখ শান্তি আর তাঁর অসন্তুষ্টিতে রোগ-শোক, দুর্ভিক্ষ, অতি বা অনাবৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে। তাই গরিয়া দেবতাকে তুষ্ট করতেই বছরের এই সময় জুমচাষের আগেই গরিয়া নৃত্য করা হয়।

ত্রিপুরাদের অন্যতম বড় সামাজিক উৎসব গড়িয়া পূজা ও নৃত্য। যেটাকে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের “ফাতুং”গৌত্ররা খ্রেবাই বলে থাকে। এ পূজার রীতিনীতি অনেকটাই অন্য সকল উৎসব বা পূজা থেকে ভিন্ন। ত্রিপুরারা গরিয়া পূজার পুরোহিতকে বলে থাকে অচাই নামে। গরিয়া-কে কাঁধে বহন করে ৭দিন ব্যাপী যিনি ঘুরেন তাকে হর্দার, পুরোহিতের সহকারী-কে তান-স্রাই ও গড়িয়া নৃত্যের শৃঙ্খলার রক্ষার দায়িত্বে থাকা টিম লিডারকে বলা হয় সিবাই। সিবাই টিমের সকল সদস্যদের দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন।

প্রতি বছর হারি বৈসুর সন্ধ্যা থেকে গড়িয়া দেবতাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে যান। গড়িয়া দেবতা বাড়িতে আসছেন দেখতে পেলে বাড়ির নারীরা উঠানে পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি পিঁড়ি বসান। নৃত্য শুরু করেন নৃত্য শিল্পীরা। নৃত্যশিল্পীরা প্রথম থেকে নৃত্য পরিবেশন করেন ২২তম মুদ্রা পর্যন্ত। নৃত্য পরিবেশন শেষে পর পরিবারের কর্তা, গৃহিণীসহ সব সদস্য ধূপ দিয়ে বরণ করে প্রণাম করে থাকে। মুরগি বলি দেন এবং মুরগি বলি দেয়ার পরে রক্ত ছিটিয়ে দেন গড়িয়া দেবতার শরীরে।

একইভাবে পহেলা বৈশাখ থেকে সাতদিন পর্যন্ত এভাবে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পরিক্রমা করা হয়।

বৈশাখ মাসের ষষ্ঠ থেকে সপ্তম দিনে মূল গরিয়া পূজা। এদিন গ্রাম ঘুরে যে চাঁদা সংগ্রহ হয়, তা দিয়ে পূজার আয়োজন করা হয়। ত্রিপুরাদের অন্য সব মূর্তি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা গড়িয়ার মূর্তি।

গড়িয়া পূজার জায়গা তৈরি করা হয় বাঁশ দিয়ে। পূজার দিন হাঁস, মুরগি, কবুতর, পাঠা ও ঘরের পালিত শূকর বলি দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ কবুতর বলি না দিয়ে গড়িয়ার কাছে উৎসর্গ করে ছেড়ে দেন। পূজাতে প্রয়োজন হয় বাড়িতে তৈরি বিশুদ্ধ মদ,তুলা ও মুরগির ডিম।

মূলত গ্রামের মানুষের মঙ্গল কামনা করে ও জুমে অধিক ফসল ফলনের প্রার্থনার আশায় গড়িয়া দেবতাকে সন্তুষ্টির আশায় যুগ যুগ ধরে ত্রিপুরার এ পূজার আয়োজন করে আসছেন। এতো গেল আদি গড়িয়া পূজার পদ্ধতি। তবে যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ পূজাতেও নানা পরিবর্তন এসেছে। এখন পাহাড়ের বিভিন্ন পাড়ার লোকজন এমনকি বিভিন্ন ক্লাবের উদ্যোগেও গড়িয়া পূজার আয়োজন করা হয়। এখন সাত দিনব্যাপী পাড়া না ঘুরা হলেও প্রতি বছর নিয়মনীতি মেনে ও পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে গড়িয়া পূজার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ের মধ্যে খাগড়াছড়িতে প্রায় এলাকায় সবচেয়ে বড় ধরনের গড়িয়া উৎসব পূজা করা হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে জেলা পরিষদের সদস্য খোকনেশ্বর ত্রিপুরা বলেন, সামাজিক উৎসব উদ্‌যাপন মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম নিজেদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সর্ম্পকে ধারণা পাবে। এ ধরনের উৎসব মানুষের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন আরো জোরালো করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি। নদীতে গরিয়া দেবতার বিসর্জনের মধ্যদিয়েই শেষ হয় ত্রিপুরাদের সপ্তাহব্যাপী বৈসু উৎসব।

গুইমারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেমং মারমা বলেন, গড়িয়া নৃত্য ও উৎসব ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব। আমি মনে করি এ উৎসবের মাধ্যমে আগামীর দিনগুলো আমরা শান্তিতে ও সম্প্রীতিতে যেন থাকতে পারি এই প্রত্যাশা করি।

বাইল্যাছড়ি এলাকার গড়িয়া পূজার উদ্যোগ গ্রহণকারী ভুবন ত্রিপুরা বলেন, গড়িয়া হচ্ছে জনজাতি অংশের মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এ পূজা করে থাকেন। মানুষ যখন থেকে সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকে এ পূজা হচ্ছে। পরিবারের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির লাভের জন্য আমরা পারিবারিকভাবে এই পূজা করে থাকি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামল কান্তি ত্রিপুরা বলেন, এ পূজা অনেক প্রাচীন। পূজা দিয়ে পরিবারের মঙ্গল ও শান্তির কামনা করে থাকি। পার্বত্য এলাকাগুলোর পাশাপাশি এ এলাকার ত্রিপুরা জনজাতি অধ্যুষিত প্রতিটি গ্রামে হচ্ছে এ পূজা। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও ত্রিপুরারা বিভিন্ন পাড়ায়-মহল্লায় এ গড়িয়া পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

মঙ্গলবার (১৬এপ্রিল) বিকেলে খাগড়াছড়ির গুইমারায় উপজেলা বাইল্যাছড়িতে আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী গরিয়া নৃত্য। এ অনুষ্ঠানে বাইল্যাছড়ি বৈসু উদ্‌যাপন কমিটি’র আহ্বায়ক হিলন ধামাই এর সভাপতি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদের সদস্য খোকনেশ্বর ত্রিপুরা। এতে নৃত্য পরিবেশন অংশ নেয় ১শ ৪৫ জন গরিয়া নৃত্য শিল্পী।

এ সময় বিশেষ অতিথি উপস্থিত ছিলেন গুইমারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্মল নারায়ণ ত্রিপুরা,বাংলাদেশ ব্যাংক-চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-মহাব্যবস্থাপক দিনময় রোয়াজা, বাইল্যাছড়ি মৌজা’র হেডম্যান ত্রিদ্বীপ নারায়ণ ত্রিপুরা,বাংলাদেশ ত্রিপুরা যুব কল্যাণ সংসদ -কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নবলেশ্বর ত্রিপুরা (লায়ন) প্রমুখ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন