নাইক্ষ্যংছড়ির মাঠ এখন সোনালি ফসলে ভরপুর, চলছে নবান্নের আমেজ

fec-image

কুয়াশা ভেদ করে যখন সূর্যের আলো প্রকৃতিতে আসে, তখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে দিগন্তবিস্তৃত আমনের খেত। সোনামাখা রোদে মাঠে মাঠে ঝলমলিয়ে ওঠে সোনালি ধান। সেই ধানের ঝিলিক যেন ছড়িয়ে পড়েছে পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি কৃষকদের চোখেমুখে।

প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল। হেমন্ত মানেই মাঠে মাঠে সোনালি ধানের হাসি আর নবান্নের উৎসব। আমন ধান ঘরে এলেই গ্রামবাংলার কৃষকদের চিরায়ত এক উৎসবের নাম নবান্ন। অগ্রহায়ণ মাসে ঘরে প্রথম ধান তোলার পর নতুন চাল দিয়ে উৎসবটি পালন করেন কৃষিজীবীরা।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর, বাইশারী, সোনাইছড়ি, ঘুমধুম, দৌছড়ি ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন এলাকার মাঠে মাঠে চলছে ধান কাটা। গানে গানে ধান কেটে চলছেন কৃষকেরা। পূর্ব বাইশারী এলাকার কৃষক আবুল শামা এবার দুই একর জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। এখন জমির সেই ধান কাটতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। আবুল শামা বললেন, ‘ধানের ফলন ভালো হয়েছে। দামও ভালো চলছে। আমার পরিবারে এখন খুশির আমেজ।

মধ্যম হেডম্যান পাড়া গ্রামের আরেক কৃষক মংবাথোয়াই মারমা (৫২) বলেন, দুই বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন। ফলনের ব্যাপারে তিনি বলেন, খরচ আর ধানের দাম মিলিয়ে এবার মোটামুটি লাভ হবে। ধান উঠলে যেই টাকা হাতে পাবেন, সেটা দিয়ে আবার আলু লাগাবেন তিনি।

ক্ষেত থেকে ধান কেটে আনার পর কৃষকেরা বাড়ির উঠানে মাড়াই করছেন। ধানের ম-ম গন্ধ এখন কৃষকের উঠানজুড়ে। কোথাও কোথাও বাড়ির গৃহিণীরা কাঠের তৈরি ধান-চাল গুঁড়া করার যন্ত্রবিশেষ দিয়ে নতুন ধানের চাল গুঁড়া করছেন। চালের সেই গুঁড়ায় তৈরি হবে নানা রকমের সুস্বাদু পিঠা-পায়েস।

উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা ছালেহ আহমেদের বাড়িতে দেখা গেল, পুরাতন দিনের ঢেকি দিয়ে চাল গুঁড়া করার ব্যস্ততা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছালেহ আহমেদ এর স্ত্রী আনোয়ারা বললেন, ‘নতুন ধানের পিঠা-পায়েস না খাইলে কী হয়? ছোট থেকেই নতুন ধানের চালের পিঠা খেয়ে আসছি। এই চালের গুঁড়া দিয়ে ভাপা, চিতই, গুরগুরিয়া, সেমাই, তেলপিঠাসহ কত পিঠা হবে!’

সোনালি ধানের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ায় নাইক্ষ্যংছড়ি কৃষকদের চোখে মুখে সোনালি হসির ঝিলিক পড়েছে। সোনাইছড়ির কৃষক মংবাথোয়াই মারমার
বাড়িতে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকেও সামগাইনে চাল গুঁড়া করার শব্দ ভেসে এল। সেখানে গিয়ে দেখা যায় আচিং থোয়াই মারমার স্ত্রী মায়েচিং মারমাও চাল গুঁড়া করছেন। এসময় মায়েচিং মারমা বলেন, ‘নতুন ধান উঠলেই সেই ধানে চাল করে গুঁড়া করি। নিজেদের গুঁড়া করা চালে তৈরি পিঠা অনেক মজা হয়। পিঠা বানানোর দিন আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা বাড়িতে আসেন। সবাই একসঙ্গে বসে পিঠা বানাই। এটাই আমরা পাহাড়িদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই।’

নবান্ন উৎসবের আমেজ ও নতুন ধান তোলার এই আনন্দ সবাই একসঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া আদি যুগ থেকে বিদ্যমান। গ্রামবাংলার কৃষকদের এই আয়োজনকে অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব বলে মনে করেন সমাজ-গবেষক ও স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা। তবে কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে নবান্ন উৎসবের পরিসর অনেকাংশে কমে গেছে।

বাইশারী কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক শাহ জালাল সাইফী বলেন, ‘আমাদের কৃষকেরা এই সময় নানা জাতের ধান আবাদ করতেন। আর সেই ধানে কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে নতুন চালের ভাতের সঙ্গে পিঠা-পুলির উৎসব হতো। কিন্তু এখন আগের মতো সেই উৎসব খুব একটা দেখা যায় না।’

সমাজ-গবেষক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, এক সময় আড়ম্বর পূর্ণভাবে নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপিত হতো। সব ধর্মের মানুষের জন্য অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব হিসেবে সারা দেশেই নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিল। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে এ উৎসব উদযাপন করা হতো। তবে এখন মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন কমে গেছে। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে নবান্ন উৎসবের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে যদি তৃণমূল পর্যায়েও বড় পরিসরে উৎসব আয়োজন করা যেত, তাহলে এই ঐতিহ্য দীর্ঘদিন টিকে থাকত।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, ‘এবার উপজেলায় ৪ হাজার ৫৪৭ হেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমে আমন ধান আবাদ হয়েছে। এই পরিমাণ জমি থেকে উৎপাদিত হবে ১৩ হাজার ৫৪৭ মেট্রিক টন ধান।’

তিনি আরো বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সহকারী কৃষি অফিসারদের মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের নিয়ে তদারকি সময়মত কীটনাশক প্রয়োগ, পানচিং পদ্বতি, আলোকপাতের ব্যবহার করে পোকা দমন করায় রোগ বালাই একটু কম হয়েছে। তাই আশা করছি ফলন ও ইনশাআল্লাহ ভালো হবে। কৃষকদের মুখে ফুটবে হাসির ঝিলিক।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন