ইতিবাচক মনোভাবের কথা বলছেন বিশেজ্ঞরা

পরিবারেই সৃষ্টি হচ্ছে লিঙ্গ বৈষম্য

fec-image

জেন্ডার বা লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে সারা দেশের ন্যায় কক্সবাজারেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে। নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিতে অব্যাহত রয়েছে প্রচেষ্টা। উন্নয়নও হয়েছে বেশ। এরপরেও সমাজের অনেক পরিবারে চলছে লিঙ্গ বৈষম্যের চর্চা। যেখানে অভিভাবক ও কাছের স্বজনরাই ছেলে ও কন্যা সন্তানের মধ্যে সমতার পার্থক্য করছেন। ফলে পরিবার থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে লিঙ্গ বৈষম্য। এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা। তারা বলছেন, যতদিন না পর্যন্ত পরিবারেই ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হবে ততদিন নির্মূল হবেনা বৈষম্য।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বেশকিছু পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনেকে ছেলে ও কন্যা শিশুর মাঝে সমতার কথা বললেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বেশিরভাগের’ই ইচ্ছাকৃত, অবহেলা এবং অজ্ঞতার কারণে বৈষম্যতা চর্চা করছে।

শহরের বৈদ্যঘোনার এক পরিবারের সাথে কথা হলে জানা যায়, তাদের দুই কন্যা ও এক ছেলে মধ্যে ছেলেটি পরিবারের মেঝ সন্তান। সে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। তার স্কুল হচ্ছে ভাল মানের একটি কিন্ডারগার্ডেন। আর কন্যা দুইটি পড়ে বাড়ির পাশ্ববর্তী এক প্রাইমারি স্কুলে। শুধু তাই নয়। ছেলেকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি এবং সাইকেল কিনে দেওয়াসহ নানা ইচ্ছা পূর্ণ করেছে। কিন্তু কন্যা সন্তানের বেলায় ভিন্নতা। এমনকি কন্যা সন্তানদের একজন ভাল রেজাল্ট করায় সাইকেলের আবদার করলেও জুটেনি।

শহরের পেশকার পাড়ার বৃদ্ধা নারী জানান, ‘মেয়েদের আবার কিসের লেখাপড়া। তারা ঘর থেকে কেন বের হবে? নিয়ম হচ্ছে পুরুষেরা ঘরের বাহিরে চাকরি-ব্যবসা করে আয় রোজগার করবে। আর মেয়েরা ঘরে রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালন ও স্বামীর দেখাশুনা করবে। কিন্তু এখন দেখছি জামানা পাল্টে গেছে। এই লক্ষণ ভালোনা।

সদর উপজেলা খুরুশকুলের এক গৃহবধূ জানান, ‘ আমার খুবই ইচ্ছে ছিল বড় ভাইয়ের মত লেখাপড়া করে চাকরি করব। আমি ছাত্রী হিসেবে খারাপ ছিলাম না। কিন্তু পরিবারের কারণে বেশি লেখাপড়া করতে পারিনি। আমাকে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর কি করার। দুই কন্যা নিয়ে সংসার চলছে। তবে আমার মেয়েদের জীবন এমন হতে দেবনা।’

কক্সবাজার শহরের শুটকি পল্লীর এক নারী শ্রমিক রাবেয়া খাতুন জানান, নারীদের অধিকারের কথা বই এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের মুখেই সীমাবদ্ধ। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে শুঁটকি পল্লীতে কাজ করি। তারা পায় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। আর আমরা পাই সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। এরচেয়ে বৈষম্য আর কি হতে পারে। এসব বৈষম আমাদের সন্তানেরা দেখছে। আর তারা হয়ত মেনে নিয়েছে এইটাই পৃথিবীর নিয়ম।

এই প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার থেকেই ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব না। এই ক্ষেত্রে মা-বাবা ও কাছের স্বজনরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে।

কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলাইমান জানান, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রী সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নারীদের অবস্থান। এরপরেও কন্যাসন্তানদের প্রতি শতভাগ বৈষম্য দূরীকরণ হচ্ছেনা। শিক্ষায় সমতা আনতে ছাত্রীদের উপবৃত্তি সহ বাস্তবমুখি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবুও বিদ্যালয় থেকে ছাত্রী ঝড়ে পড়ার হার কম না। সাথে রয়েছে অল্পবয়সী কন্যা শিশুদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা।

শহরের বাসটার্মিনালস্থ এক জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ সাঈদ হোসেন জানান, ধর্মে সবসময় নারীদের সম্মানের কথা বলেছে। তাদের অধিকার আদায়ের কথা বলেছে। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহী বা অজ্ঞ মানুষ ধর্মকে মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করে ভুয়া তথ্য দিয়ে বঞ্চিত করছে নারীর অধিকার। যা অনেক পরিবারের মধ্যে চর্চা হয়। এমনকি খাবারে পর্যন্ত বৈষম্য চলে। ফলে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে অনেক মা’।

এই প্রসঙ্গে জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী শাকী-এ কাউছার জানান, এই আধুনিক যুগেও লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে সমাজ এখনো শতভাগ পরিপূর্ণ নয়। রয়েছে নানা কুসংস্কার। চাকরিতে লিঙ্গ বৈষম্য। আর তা তৈরি হচ্ছে পরিবার থেকেই। অনেক মা-বাবা নিজেদের অজান্তে কোমলমতি শিশুদের মনে বপন করছে বৈষম্যতার বীজ।

লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করা সংস্থা ‘রিসার্চ ট্রেনিং ম্যানেজমেন্ট এন্ড ইন্টারন্যাশলান’ (আরটিএমআই) এর প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর নাসরিন আক্তার মনিকা জানান, পরিবারের সচেতনতার মধ্য দিয়েই নির্মূল হবে লিঙ্গ বৈষম্য। সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই সংস্থা মা’ সভা, মাঠ পর্যায়ে কাউন্সিলিং সহ বিভিন্ন সভা-সেমিনার করছে।

উল্লেখ্য, ডব্লিউইএফ এর ২০২২ সালের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ৬ ধাপ পিছিয়ে বিশ্বে ও ১৪৬ দেশের মধ্যে ৭১ নম্বরে নেমে গেছে। গত বছর ওই তালিকায় বাংলাদেশ ৬৫ নম্বরে ছিল। তার আগের বছর ছিল ৫০ নাম্বারে। লিঙ্গ বৈষম্যহীন দেশ ও জাতি বির্নিমাণে পরিবার তথা অভিভাবকের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষঙ্গরা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন