পানছড়িতে পুলিশে যোগ দেয়া শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্যের এসএমজি নিখোঁজ

SMJ PIC

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:

খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলায় পূজামন্ডপে ডিউটি করতে এসে এস.এম.জি হারালো এক পুলিশ সদস্য। ঐ পুলিশ সদস্যর নাম নায়েক লক্ষীকুমার চাকমা। তিনি শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্য। শান্তিচুক্তির পর অস্ত্র সমর্পনের সময় ৭.৬২ বোরের একটি রাইফেল ও ৬০০ রাউণ্ড গুলি জমা দিয়ে পরে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।

জানা যায়, গত ৩০/৯/২০১৪ তারিখ বিকাল তিনটায় সিসি মূলে ৬ সদস্যের টিমে পানছড়ি উপজেলাধীন কুড়াদিয়াছড়া সার্বজনীন মন্দিরে দূর্গা পূজার ডিউটি করতে আসেন লক্ষীকুমার চাকমা(৩৫)। তার নামে একটি এস.এম.জি ও চল্লিশ রাউন্ড গুলি বরাদ্দ দেয়া হয়। এই টিমের নেতৃত্বে ছিলেন কিরণ বিকাশ চাকমা। তাদের আবাসস্থল নির্ধারণ করা হয় মন্দিরের বিপরীতে অবস্থিত নলকাটা জুনিয়র হাই স্কুল।

পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে লক্ষীকুমার চাকমা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন অর্থাৎ গতকাল রাতে কিরণ বিকাশ চাকমা ও লক্ষীরাম চাকমা ডিউটি চলাকালে পান খেয়ে রাত ১১ থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত দাবা খেলেন। এরপর তারা ঘুমাতে যান। সকালে ডিউটিতে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করেন তার অস্ত্রটি নেই। অনেক খোঁজাখুজির পরও এস.এম.জি’টি না পেয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘটনাটি অবগত করায়।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার শেখ মিজানুর রহমান, এ.এস.পি হেড কোয়াটার্স কানন কুমার দেবনাথ, সহকারী পুলিশ সুপার সদর সার্কেল মো: সরোয়ার আলম, পানছড়ি থানা অফিসার ইনচার্জ আব্দুস সামাদ মোড়ল, পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা ও ৪নং লতিবান ইউপি চেয়ারম্যান শান্তি জীবন চাকমা।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার শেখ মিজানুর রহমান পার্বত্যনিউজকে জানান, লক্ষীরাম চাকমা বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তিনি জানান, তার কথাবার্তা অসংলগ্ন। এস.এম.জি খোয়ানো নায়েক লক্ষীরাম চাকমা রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার কাকতলী গ্রামের ভব্রবাহন চাকমার ছেলে। তার শশুরবাড়ী পানছড়িতে। শশুরের নাম পূর্ণচন্দ্র চাকমা। দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রতিদিনই শশুরবাড়িতে গিয়েছেন এবং তাদের রান্না করা খাবার এনে খেয়েছেন। এসময় তার কাছে সন্দেহজনক বিভিন্ন লোকজন এসেছে। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি। লক্ষীকুমার চাকমা ও টিম লিডার কিরণ বিকাশ চাকমার সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এ ঘটনা ঘটতে পারে না বলেও মত প্রকাশ করেন জেলা পুলিশ সুপার।

তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ ঘটনায় তাদের সংশিষ্টতা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে মামলার পর এ বিষয়ে আরো বিস্তরিত জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

শেখ মিজানুর রহমান বলেন, ঘটনার মূল নায়ক লক্ষীরাম চাকমা শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্য। শান্তিচুক্তির পর অস্ত্র সমপর্নের সময় তিনি নিজে ৭.৬২ বোরের একটি রাইফেল ও ৬০০ রাউন্ড গুলি জমা দেন। তদন্তে এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।

লক্ষীরাম চাকমা তার সাবেক বাহিনীর কাছে অস্ত্রটি পাচার করেছে কিনা জানতে চাইলে খাগড়াছড়ির এসপি জানান, বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মিশ্র পুলিশ সৃষ্টির উদ্যোগ কী বুমেরাং হতে চলেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শান্তিচুক্তির আওতায় সরকার একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অর্থাৎ পাহাড়ী-বাঙালী কনফিডেন্স বিল্ডিংয়ের অংশ হিসাবে তিন পার্বত্য জেলায় মিশ্র পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু কিছু উপজাতীয় পুলিশ সদস্যের কারণে তাতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এমন অনেক প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

কী ধরণের প্রমাণ পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাহাড়ীরা এখানে হরতাল, অবরোধ করে। আমরা পুলিশ বাহিনীতে তা নিয়ে যেসব ব্রিফিং হয়, কনফিডেন্সিয়াল মিটিং হয়, দেখা যায় মিটিং শেষেই তা ফাঁস হয়ে যায়। এরকম আরো অনেক সমস্যা হচ্ছে। এতে ৫০/৫০ মিক্সড পুলিশের ধারণা মার খাচ্ছে। সরকারের বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত।

টিম লিডার কিশোর বিকাশ চাকমার বিরুদ্ধে কোনো আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কীনা জানতে চাইলে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার বলেন, তাকে আমাদের নজরাধীন করে রাখা হয়েছে।

অস্ত্রটি উদ্ধারে স্থানীয় পুলিশের সাথে সেনাবাহিনী ও বিজিবি জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

উল্লেখ্য আর্মড ব্যাটালিয়ন এসআই কিরণ চাকমা ও নায়েক লক্ষীরাম চাকমার নেতৃত্বে উপজেলাধীন কুড়াদিয়াছড়া সার্বজনীন মন্দিরে ৬জন জন পুলিশ সদস্য ও আট জন আনসার সদস্য কর্তব্যরত ছিলেন।

এদিকে সমঅধিকার আন্দোলন একাংশের মহাসচিব মনিরুজ্জামাম মনির পার্বত্যনিউজকে বলেন, লক্ষীরাম চাকমার অস্ত্র হারানোর গল্পটি সর্বৈব একটি মিথ্যা ও সাজানো নাটক। প্রকৃতপক্ষে এটি পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র পাচারের একটি নাটক মাত্র। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার বিভিন্ন মহলের বাধা ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের নামে উপজাতীয় পুলিশ মোতায়েন করেছে। তার পর থেকেই একের পর এক থানায় আগুন লাগানো, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সেই আগুনে পুড়ে খোয়া যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কী পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি পুড়েছে, কোনো অস্ত্র খোয়া গেছে কীনা তার প্রকৃত হিসাব জাতি আজো জানতে পারেনি।

মনির আরো বলেন, ইতোপূর্বে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে পুলিশের অস্ত্র ও গুলি উপজাতীয় পুলিশ সদস্যরা চুরি করে উপজাতীয সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছে। বর্তমান ঘটনা তারই অনরূপ। আমরা জানতে পেরেছি তার পরিবারের সাথে পাহাড়ী সন্ত্রাসী বাহিনীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে উল্লেখ করে মনিরুজ্জামান মনির অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল উপজাতীয় পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করার দাবী জানান।

উল্লেখ্য শান্তিচুক্তির পর শান্তিবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য অস্ত্র সারেন্ডার করে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়। পরে তদন্তে দেখা যায়, তাদের একটি অস্ত্র জমা না দেয়া সন্ত্রাসীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেখানকার অধিবাসী উপজাতীয় পুলিশদের পদায়ন করা বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই নিয়ম ভঙ্গ করে তিন পার্বত্য জেলায় উপজাতীয় পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়।

এরপর থেকে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর মঙ্গলবার বিকালে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় রাঙ্গামাটির কাউখালী থানা ভবন। একই বছর ১৮ ডিসেম্বর বুধবার সকালে একই নিয়মে পুড়েছে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থানা ভবন।

রাঙ্গামাটির কাউখালীতে পুড়েছে ১২টি অস্ত্র আর ২০০ বুলেট। এর মধ্যে ছিল ১০টি রাইফেল, ১টি শর্টগান ও ১টি গ্যাস গান।

অন্যদিকে মানিকছড়ি থানায় অগ্নিকান্ডে পুড়েছে অন্তত ৬৩টি অস্ত্র ও ৪৮৪০টি বুলেট। এর মধ্যে এলএমজি ২টি, এসএমজি ৫টি, চাইনিজ রাইফেল ২৮টি, শর্টগান ৫টি, স্থানীয়  জনগনের জমা দেয়া অস্ত্রের মধ্যে একনলা বন্ধুক ১৮টি, দুইনলা বন্ধুক ১টি ও রিভলবার ১টি এবং সেনাবাহিনীর উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে এলজি ২টি ও কাটা বন্ধুক ১টি ছিল। অবশ্য এসব ঘটনার সাথে উপজাতীয় পুলিশ সদস্যদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল কীনা তা কোনো সূত্রে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এদিকে ২০১২ সালের ২৪ অক্টোবর কাফরুলের একটি বাসা থেকে ৫শ’ রাউন্ড গুলীসহ গ্রেফতার করা হয় পুলিশ সদস্য প্রেম চাকমা ও জেনাল চাকমাকে। এরপর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অভিযান চালানো হয়। পরে আইজিপি রিজার্ভ অফিসের উত্তর পশ্চিম কর্নারে থাকা একটি কাঠের আলমারি থেকে শর্টগানের গুলী ৬৫টি, ৩০৩ বোরের রাইফেলের গুলী ১৩৭টি, চায়না রাইফেলের গুলী ১৮৯টি, ৭ দশমিক ৬২ বোরের পিস্তলের গুলী ২৮৫টি, নাইন এমএম পিস্তলের ২২০টি গুলী বের করে দেন। পরে কনস্টেবল সায়েমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ওই আলমারির নিচের তাক থেকে রিভলবারের গুলী ১১০টি, শূন্য দশমিক ৩৮ বোরের স্পেশাল হলো পিস্তলের গুলী ৬টি, শূন্য দশমিক ৩৮ বোরের রিভলবারের গুলী ১০টি, শূন্য দশমিক ৩২ বোরের পিস্তলের গুলী ৮টি, শূন্য দশমিক ২২ বোরের ম্যাগনাম লং পিস্তলের গুলী ২টি, শূন্য দশমিক ২২ ফেডারেল শর্ট পিস্তলের গুলী ৫০টি, শূন্য দশমিক ২২ বোরের পিত্মলের গুলি ১২০টি, ৭ দশমিক ৬২ বোরের পিস্তলের খালি ম্যাগাজিন ১টি, শূন্য দশমিক ২২ বোরের পিস্তলের গুলীর খোসা ২২৫০টি, চীনা রাইফেলের গুলীর  খোসা ১৫০টি, ৩০৩ বোরের রাইফেলের গুলীর খোসা ১০টি, ৯এমএম পিস্তলের গুলীর  খোসা ৫টি ও শূন্য দশমিক ২২ বোরের জার্মানীর তৈরি একটি রিভলবার উদ্ধার করা হয়।

জড়িত পুলিশ সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, এসব অস্ত্র তারা বিক্রির জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। আর গত চার বছর ধরে তারা এভাবে হাজার হাজার গুলী, অস্ত্র বিক্রি করেছেন। অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা এটি বিক্রি করলেও উপজাতি পুলিশ সদস্যরা তা কাজে লাগিয়ে নিজেদের সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছে পৌঁছে দিতো।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন