পার্বত্য চট্টগ্রামে কেএনএফের উত্থান ও করণীয়

fec-image

গত ০২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা ও থানছি উপজেলায় মাত্র ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি ব্যাংকে কথিত কেএনএফের (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) সফল অপারেশন, অর্থ ও অস্ত্র লুট, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ, দিনের বেলায় থানায় হামলার অপচেষ্টা এবং তৎপরবর্তীতে পার্বত্য এলাকায় সেনাসহ সংশ্লিষ্ট বাহিনীর চলমান যৌথ অভিযান, সেনাপ্রধানের ঘটনাস্থলে উপস্থিতি, সর্বোপরি ন্যূনতম তিনজন মন্ত্রীর (সেতু, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র) মন্তব্য, প্রভৃতি নিয়ে সারা দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

এর আগে গত ০৭ এপ্রিল/২৩ মাসে রাতে ওই জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর থেকে ১২-১৩ কিলোমিটার দূরে দখামতাং পাড়ার রোয়াংছড়ি-রুমা সড়কে পাহাড়ি উগ্রবাদী সংগঠন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) এবং কেএনএফ তথা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পরদিন সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আটজনের লাশ উদ্ধার করেন।

তারও আগে ২২ মার্চ/২৩ বর্ণিত খামথাং পাড়ার পাশের রামথার পাড়ায় কারবারি থংচুল বমকে (৭০) কে বা কারা হত্যা করে ফেলে রেখে গিয়েছিল; যার রহস্য আজো উদঘাটন হয়নি। তারও ৫ দিন আগে ১৭ মার্চ/২৩, ওই জেলাধীন রুমা উপজেলার বগালেক-কেওক্রাডং-ধুপ পানি নির্মাণাধীন সড়ক থেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্টকে অপহরণ করা হলে, ১৬ দিন পর তিনি মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পান। সর্বোপরি বিগত ১২ মার্চ/২৩ ওই এলাকার পাইক্ষং পাড়া ও রৌনিন পাড়ার মাঝামাঝি কাটা পাহাড় নামক স্থানে কেএনএফ সদস্যরা সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় নাজিম উদ্দিন নামের সেনাবাহিনীর একজন মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নিহত ও দুই সেনাসদস্য আহত হন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে কেএনএফের গোপন আস্তানায়, সমতলের জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল্ হিন্দোল শারক্বিয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের সংবাদপ্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বর্ণিত এলাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করলে, ৪০ জন জঙ্গিকে তখন গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণে কর্তৃপক্ষ বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন উপজেলা রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বারবার।

এসব ঘটনাবলির পটভূমিতে কুকি-চিন সংগঠন সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য নিম্নে বিবৃত হলো :

‘কুকি-চিন’ সংক্রান্ত কিছু তথ্যাদি
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ভারতের সেভেন সিস্টার নামীয় প্রদেশগুলোর অন্যতম হচ্ছে মিজোরাম; যার অধিবাসীদের বেশির ভাগ মিজো হিসেবে পরিচিত। ওই মিজোরা, যারা কুকি-চিন হিসেবে পরিচিত; তারা বাংলাদেশের বম, লুসাই পাংখোয়া জাতিগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষ। তাদের একটি বৃহৎ অংশ, বর্তমানে বাংলাদেশের বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন বান্দরবান সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলায় বসবাস করে। এ ছাড়া একই এলাকাগুলোর সন্নিহিত অন্য দেশ মিয়ানমারভুক্ত চিন প্রদেশ এবং ভারতভুক্ত মিজোরামেও তাদের বসতি রয়েছে। বান্দরবানের কাছাকাছি মিজোরামের একটি জেলার নাম লুঙ্গৎলাই। আর মিয়ানমারের সীন-এর অংশ পালেতওয়া টাউনশিপের মাটুপি, একই অঞ্চলের অংশ। এর কাছে আরাকানের মংডু। অর্থাৎ চার ধরনের প্রশাসনিক পরিচয় নিয়ে, এ অঞ্চলে রয়েছে বহু জাতিসত্তার মানুষ। বহুকাল ধরে এরকম জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে নৃতাত্ত্বিক বন্ধন ঘিরে বিবিধ ভাঙাগড়া, সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ ছিল এবং আছে। তার মধ্যে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের মিশেলও যুক্ত হয় প্রতিনিয়ত। এর ধারাবাহিকতায় মিজোরামের রাজধানী আইজলে বিগত ফেব্রুয়ারি/২০২৩ থেকে মিজোরা, বাংলাদেশের কুকি-চিনদের ব্যাপারে সমব্যথী হয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছে। তারা তাদের সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারকে, বাংলাদেশের কুকি-চিনদের উদারভাবে আশ্রয় দেয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

মিজো জাতীয়তাবাদ
‘মি’ শব্দের অর্থ (মিজো ভাষায়) মানুষ, আর ‘জো’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পাহাড়’। অর্থাৎ মিজো শব্দের অর্থ পাহাড়ের মানুষ। ধারণাটি বেশ বড়। এতে অনেক জাতিসত্তা অন্তর্ভুক্ত। আইজলের মিজোদের বক্তব্য হলো, ‘কুকি-চিন’রাও ‘জো’। সুতরাং তারা বিপদে পড়ে যদি মিজোরামে ঢুকে থাকে, তাহলে তাদের তাড়ানো যাবে না। মিজোরামের বর্তমান সরকারও এরকম মনোভাব সমর্থন করে বলে জানা যায়। তবে বিএসএফ তথা সীমান্তরক্ষীরা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত বিধায় সীমান্তে অন্য দেশের ‘জো’রা বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে তারা ক্ষুব্ধ। যেহেতু মিয়ানমারের চিন বাংলাদেশের বান্দরবান এবং ভারতের মিজোরাম মিলে জোদের মধ্যে প্রায় সবাই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, সে কারণে আইজলে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক একটি শক্ত বন্ধনও কাজ করছে। বম, পাংখুয়া, লুসাই জনগোষ্ঠীর সদস্যরা ব্রিটিশ খ্রিষ্টান হিসেবে পরিচিত। প্রায় ১০০ বছর আগেও, তাদের প্রায় সবাই প্রকৃতিপূজারী ছিলেন; যারা পশ্চিমাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত চার্চগুলোর বিবিধ কার্যক্রমে বর্তমানে খ্রিষ্টান হয়ে গেছেন। লক্ষণীয় যে, ‘বম’ শব্দের অর্থ হচ্ছ ‘বন্ধন’; যার সামাজিক চেহারা একই রকম অব্যাহত রয়েছে।

জাতিগত পথরেখা
ভারতবর্ষ এবং মিয়ানমারের দখল, ‘মুক্তি’; সব ঘটেছে ব্রিটিশদের হাতে। শত শত বছরের নৃ-তাত্ত্বিক বাস্তবতা এসব কাটাছেঁড়ায় কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও, এতে তার পথ হারায়নি। অনেক সময় প্রশাসনিক জটিলতায় ভৌগোলিকভাবে এসব ত্রিমোহনার মানুষকে, আইন-আদালতের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে সীমান্ত পেরোতে হয়। এ রকম বিবিধ প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে মিজোরামে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে থিতু হওয়া কিছু চাকমাও সেখানে রয়েছেন। বৌদ্ধ চাকমাদের সাথে, ওই দিকে আবার খ্রিষ্টান মিজোদের সম্পর্কও ভালো নয়। ইয়াং মিজো অ্যাসোসিয়েশনের (ওয়াইএমএ) দাবি হলো, অতীতে চাকমাদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যতটা উদার ছিল বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ থেকে তথায় অনুপ্রবেশ করা ‘জো’দের বিষয়েও একই রকম উদার হতে হবে।

এতে বোঝা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে একটি ‘জো’ জাতীয়তাবাদ কাজ করছে। এর প্রবল সমর্থন রয়েছে আবার মিয়ানমারের চিন প্রদেশের চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (সিএনএফ) দিক থেকে। সেখানে পালেতওয়া শহরটির ওপর অধিকার নিয়ে চিনদের সাথে রাখাইনদের রয়েছে ব্যাপক বিরোধ। সেখানকার রাখাইনদের সংগঠন ‘আরাকান আর্মির (এএ) নাম চলে এসেছে আবার সাম্প্রতিক কুকি-চিন সমস্যায়। এ কারণে জটিল এক জাতিগত সমীকরণে নতুন করে ঢুকছে এ পুরো অঞ্চল। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে প্রকাশ্যে বাংলাদেশে কুকি-চিন নামীয় সংগঠনের উৎপাত শুরু।

স্মরণযোগ্য যে, ‘জো’র অর্থ, আর বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়িদের আত্মপরিচয় দানের ক্ষেত্রে ‘জুম্মু’ হিসেবে পরিচয় দেয়ায় অন্তর্নিহিত অবস্থা কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা। সে প্রেক্ষাপটে সংখ্যায় যত কম হোক, কেএনএফ দুরান্তে থাকা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সহানুভূতি ও উৎসাহ পাচ্ছে বা পাবে, এটা যুক্তিসঙ্গত বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।

জানা যায়, কেএনএফ সদস্যরা মিয়ানমারের চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদর দফতরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং এ কুকি-চিন তরুণরা অধিকতর উচ্চমানের প্রশিক্ষণে মিয়ানমারের ‘কাচিন’ পর্যন্ত চলে যায়। কাচিনের বিদ্রোহী সংগঠন ‘কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (কেআইএ) চায়না কর্তৃক প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পেয়ে থাকে বলেও বহুলভাবে বিশ্বাস করা হয়। এ পর্যায়ে সার্বিক ধারণা লাভে বলা যায় যে, চিন ও কুকিরা নৃঃবিজ্ঞানে একই অধ্যায়ে আছে। এশিয়ার এ অঞ্চলে এরা সবাই মিলে মোটেই ছোট কোনো জাতি শক্তি নয়।

প্রাসঙ্গিক পাহাড়ি অঞ্চলটি নিয়ে পাশ্চাত্যের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গী সংক্রান্ত অধিকতর কিছু তথ্য, নিচে তা উপস্থাপন করা হলো :

কুপল্যান্ড প্লান : এ উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের বিদায় ঘণ্টা বাজার শেষ মুহূর্তে তাদের শেষ মরণ-কামড় হিসেবে চেষ্টা হয়েছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আমাদের তিন পার্বত্য জেলাসহ চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দক্ষিণাংশ এবং মিয়ানমারের সন্নিহিত অঞ্চল তথা ‘চিন’সহ প্রয়োজনীয় অঞ্চল নিয়ে একটি ‘ক্রাউন কালোনি’ গঠনের; যে অঞ্চলটি উপমহাদেশের স্বাধীনতার আলোচনার বাইরে থাকবে। সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থেকে যাবে। চল্লিশের দশকের শেষ পর্যায়ে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন ফোরামে; ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায়, তৎকালীন ভাইসরয়ের দফতরে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। ব্রিটিশ আমলা ‘রিজিনাল্ড কুপল্যান্ড’ ১৯৪৬ সালে প্রথম এ পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করে বলে জানা যায়। এজন্য এ পরিকল্পনাকে ‘কুপল্যান্ড প্লান’ নামে অভিহিত করা হয়। তবে তার পেছনে আসল কুশীলব ছিল ‘খ্রিষ্টান চার্চ সম্প্রদায়’।

তাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল, অঞ্চলটি সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের আওতায় রেখে, সেখানে খ্রিষ্টীয়করণের কাজটি নির্বিবাদে ব্রিটিশ আমলে সম্পন্নকরতঃ, সেখানে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সময়ের অভাবের আড়ালে, পাক-ভারতের সীমানা চিহ্নিত করার সময় ব্রিটিশ আমলা ‘রেড ক্লিপ’ কর্তৃক পাহাড়ি সীমান্তরেখা নির্ণয়ে অস্পষ্টতা তার ধারাবাহিকতার ফল বলে অনেকে মনে করে। বলা বাহুল্য, তাদের হিসাব-নিকাশ ঠিকই ছিল। এলাকাটিকে আরো ৭৫ বছর ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ শাসনের আওতায় রাখা গেলে, এতদিনে তাদের সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারত। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক সীমানাসহ, মিয়ানমারের সন্নিহিত চিন রাজ্যের অঞ্চলটির আজকের পরিস্থিতির দিকে তাকালে তা সহজে অনুমেয় ।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ভারতের নাগাল্যান্ডে ১৮৭১ সালে খ্রিষ্টান চার্চের (ব্যাপটিষ্ট) অনুপ্রবেশ ঘটে। ওই সময় সেখানে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। অথচ ওই অঙ্গরাজ্যে সম্প্রতি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের পরিমাণ, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে, মিজোরামে খ্রিষ্টান চার্চের অনুঃপ্রবেশ ঘটে ১৮৯৪ সালে, যখন ওই এলাকার মানুষদের অধিকাংশ ছিল প্রকৃতি পূজারী। বর্তমানে ওই রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। একইভাবে মেঘালয় রাজ্যে খ্রিষ্টান চার্চের (ক্যাথলিক) অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯১৩ সালে। ওই সময় প্রায় শূন্যের কোটায় থাকা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মিয়ানমারের চিন প্রদেশের অবস্থাও একই রকম।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা একেবারে সঙ্গিন। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ছাড়া আরো অন্তত ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে সংখ্যাগত, আচরণগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে রয়েছে বিস্তর ফারাক। মোটা দাগে তারা সমতলবাসী ও পাহাড়ি- এ দুই অভিধায় বিভক্ত। পাহাড়িদের প্রধান তিন সম্প্রদায় হচ্ছে- চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা। তাদের পৃথক সত্তা ও নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা নিশ্চিত করার প্রকাশ্য ব্রত নিয়ে বিদেশী ফান্ড দ্বারা পরিপুষ্ট অনেক এনজিও এখনো তিন পার্বত্য জেলায় সক্রিয় রয়েছে; যাদের বেশির ভাগ আর্ত মানবতার সেবার নামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরিত করার কাজ করছে।

এছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় বর্তমানে উল্লেখযোগ্য ১৯৪টি গির্জা উপজাতীয়দের ধর্মান্তরিতকরণে মৌলিক ভূমিকা রাখছে বলে জানা যায়। এর ধারাবাহিকতায় পাহাড়ি যেসব জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, তাদের প্রায় শতভাগ বর্তমানে খ্রিষ্টান হয়ে গেছে অনেক আগে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বম, লুসাই, পাংখোয়া, খুমি, স্রো ও খিয়াংসহ অপর মোট ১০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী; যাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বর্তমান পর্যায়ে কেএনএফ বা অন্য কোনো নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে ধারণা পাওয়া যায়। মাঠপর্যায়ে পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ইতোমধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ৬০ হাজার, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ৪০ হাজার এবং রাঙ্গামাটি জেলায় ২০ হাজার উপজাতি অধিবাসী খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছেন; যাদের অধিকাংশ বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে ভারত ও মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সীমান্ত সন্নিহিত এলাকার বাসিন্দা।

এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ নামে ৮১৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় অনুমোদনের ঘোষণাসংক্রান্ত যে বিল পাস হয়, তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের চার্চগুলোর ধারাবাহিক নিরন্তর ও লাগাতার তদবির ছিল লক্ষ করার মতো। প্রাসঙ্গিক চার্চগুলোর লাগাতার তদবিরের ফলে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এ বিল নিয়ে কাজ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধি পরিষদ সদস্যদের একাংশ। তার ফলে সিনেটে পাস হওয়ার আগে এ আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নকক্ষে (প্রতিনিধি পরিষদ) পাস হয়। চার্চগুলোর ক্রমাগত ও সার্বিক প্রচেষ্টার প্রেক্ষাপটে, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে এ বিল পাসের ক্ষেত্রে নিদারুণ ঐকমত্য দেখা গেছে। ২০২৩ সালে সংযুক্ত করা ‘বার্মা অ্যাক্ট’-এর পরবর্তী প্রভাব, এতদঞ্চলের মানুষ সহসা অবলোকন করবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে।

পার্বত্য (শান্তি) চুক্তির প্রভাব : পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত বিরোধসংক্রান্ত বিষয়ে অনেকে মনে করেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির সব ধারা প্রতিপালন/কার্যকর না করায় সমস্যাটির সমাধান হচ্ছে না। বস্তুতপক্ষে সেটিও সত্যি নয়। এ চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিপরীতে সরকার যেসব আনুকূল্য বা সহায়তা প্রদান করছে, তার প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভোগ করছেন চাকমারা, বাকি ৩০ ভাগের মধ্যে প্রায় সব সুবিধাভোগী হিসেবে আছেন মারমা ও ত্রিপুরারা।

পাহাড়ের অবশিষ্ট নৃ-গোষ্ঠীর অর্থাৎ বাকি ১১টি নৃ-গোষ্ঠী পাচ্ছে সাকুল্যে শতকরা এক ভাগেরও কম। ফলে তাদের মধ্যে বিরাজ করছে গভীর হতাশা। তারা পাহাড়ি তথা জুম্মু হিসেবে ১৪ জাতিগোষ্ঠীর ১৩ ভাষাভাষীদের সাথে বাঙালিদের বিরুদ্ধে একই সারিতে দাঁড়িয়ে দাবি জানাতে বাধ্য হলেও, সুযোগ সুবিধা গ্রহণের বেলায় চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা কর্তৃক বঞ্চিত হওয়ার ধকল সামলিয়ে উঠতে না পেরে, দারুণ মনোব্যথায় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।

সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশে বসবাসরত সব নাগরিকের সমান অধিকার ঘোষণা করা হলেও, সংবিধান এটিও ঘোষণা করেছে যে, সমাজের কোনো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে, সমান পর্যায়ে নিয়ে আসতে, রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে। ওই বিধানের আওতায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম (শান্তি) চুক্তি। ওই চুক্তি সম্পাদনের পর, পাহাড়িদের বেশির ভাগ হয়েছিলেন উচ্ছ্বসিত। কিন্তু কিছু দিন পর তাদের অনেকের স্বপ্ন ভঙ্গ হয় চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের মাধ্যমে বঞ্চনায় একই সাথে অন্য ১১টি নৃ-গোষ্ঠীর স্বার্থহানির কারণ হচ্ছে। অথচ সংবিধান অনুসারে পিছিয়ে পড়াদের অনুকূলে সুবিধা প্রদানের সময়কাল, সীমাহীন হওয়ার কথা নয়।

এদিকে পাহাড়ি নেতারাসহ সমতলের কিছু বিশেষজ্ঞ ক্রমাগত বলে চলেছেন, চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার বেশির ভাগ (৪৮টি) কার্যকর করা হলেও, অবশিষ্টাংশ কার্যকর না করা হলো পাহাড়িদের দুঃখের কারণ। লক্ষণীয় যে, পার্বত্য (শান্তি) চুক্তির ৭২টি ধারার সব কিছু কার্যকর করার বিনিময়ে সরকারি পক্ষের চাওয়া ছিল ‘পাহাড়িদের অস্ত্র সমর্পণ’। অথচ, নামে মাত্র কিছু অস্ত্র জমা দিয়ে, এ পর্যন্ত পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বুঝা যাচ্ছে যে, সরকার তার কথামতো চুক্তির ২/১টি বিষয়-ব্যতীত পুরোপুরি কার্যকর করলেও, বিপরীত ক্রমে পাহাড়িরা একটি মাত্র শর্তই পালন করেনি। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ নিরসনে সচেষ্ট হওয়ার এখনই সময় বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে।

সর্বশেষ অবস্থা : বর্তমানে কেএনএফ যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তাতে নিঃসন্দেহে এদের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। কেননা কুকিদের এ ধরনের হামলা, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ পরিস্থিতিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে। বান্দরবানকেন্দ্রিক বর্তমানে কেএনএফের এহেন তৎপরতা বেশি এবং সেখানে তারা কিছু সুবিধাও পাচ্ছে তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর কাছে থেকে। পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত থেকেও সংশ্লিষ্ট সহযোগী সংগঠনসমূহ কুকিদের সহযোগিতা দিচ্ছে। তারা মূলত ভৌগোলিক সীমান্তের সুযোগটি ব্যবহার করছে। কেএনএফ দেশের পার্বত্যাঞ্চলকে অতীতের তুলনায় আরো বেশি অশান্ত ও ভয়ঙ্কর করে তুলছে। এমনকি পাহাড়ের যেখানে উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, সেখানে বাধা সৃষ্টি করছে কুকি সন্ত্রাসীরা।

ইদানীং কুকি সন্ত্রাসীদের কম্ব্যাট (সামরিক) পোশাকে অস্ত্র মহড়া, প্রশিক্ষণ ও গুলি চালানোর ভিডিও, নিজেরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করছে। তারা অনলাইনের সামাজিকমাধ্যমে কুকিদের কিছু আইডি বা পেজে, অনবরত তৎপরতার জানান দিচ্ছে; এমনকি একটি ভিডিওতে কেএনএফের প্রধান, নাথান বমসহ তাদের শীর্ষ নেতাদের গায়েও সামরিক আদলে পোশাক দেখা গেছে। তাদের কার্যক্রম এখন পর্যন্ত বান্দরবান পার্বত্য জেলাভিত্তিক হলেও, তারা ইতোমধ্যে তিন পার্বত্য জেলার প্রায় অর্ধেক আয়তনের অঞ্চল তথা বান্দরবান জেলাধীন লামা, রুমা, আলী কদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি, বরকল উপজেলাসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে। শুধু তাই নয়, তারা এ মানচিত্রকে প্রস্তাবিত হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সীমানা, জেলা উপজেলা সীমানা নির্ধারণ করেছে।

এমতাবস্থায় তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম সীমান্ত এলাকাগুলো পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মচঞ্চল করে তোলা দরকার অতি শিগগির। সে উন্নয়নের ধারায় পাহাড়ি জনগণকে; যারা অন্যদের চেয়ে আগে, সেখানে বসবাস শুরু করেছে; অবশ্যই তাদের অগ্রাধিকার দেয়া জরুরি। এতদসঙ্গে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের পুরো সীমান্ত বরাবর সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার যে উদ্যোগ চলমান, তার শম্বুক গতি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর ধারাবাহিকতায় তিন পার্বত্য জেলাকে দেশের অন্যান্য জেলার সমমর্যাদায় রাখা হচ্ছে এখন সময়ের দাবি। পার্বত্য চট্টগ্রাম তুলনামূলক জনবিরল হলেও আয়তনে দেশের এক-দশমাংশ। জাতীয় উন্নয়ন বাজেটে সে বাস্তবতার প্রতিফলন থাকা আবশ্যক। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে অধিকাংশ সমস্যার নিষ্পত্তি হওয়া সম্ভব। আর তা উচিত কোনো বিদেশী এনজিও বা আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়ন ছাড়া; নিজস্ব অর্থায়নে। সে সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে; প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্তের।

উপরে বর্ণিত তথ্যাদির আলোকে তথ্যাভিজ্ঞমহলের কিছু মতামত নিম্নরূপ :

১. পার্বত্য জেলার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে; সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার অধিকতর উন্নত পন্থা খোঁজ করত:, অতিসত্বর পাহাড়ের জন্য গঠিত র্যাব-এর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ ইউনিটকে মাঠে নামানোর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

২. পাহাড়ের ১৩ ভাষাভাষী ১৪টি জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে পিছিয়ে পড়া এবং সরকারি সুবিধা থেকে প্রায় বঞ্চিত ১১টি নৃ-গোষ্ঠীর আস্থার সঙ্কট থেকে, কুকি ন্যাশনাল ফ্রন্টসহ, নতুন নতুন সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যক্রমের উন্মেষ হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে গভীরভাবে কাজকরত পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

৩. পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনসমূহ কোনো বিদেশী রাষ্ট্র বা কোনো গ্রুপের সহায়তা পাচ্ছে কিনা তা বিবেচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

৪. কেএনএফের চলমান কার্যক্রম অঙ্কুরে শেষ করতে চলমান অভিযানের মাত্রাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম নেয়া জরুরি।

৫. অন্তত ২/৩ বছর আগে থেকে বান্দরবানের সীমান্ত এলাকাসহ সন্নিহিত অঞ্চলে কিছু সশস্ত্র লোকজন; যারা ওই অঞ্চলের মানুষ নয়, এমনকি বাংলাদেশের নাগরিক নয়, ওই অঞ্চলে তাদের ঘোরাফেরা করার তথ্যসংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে স্থানীয় জনগণ কর্তৃক জানানোর পরও তারা তা না দেখার ভান করেছে বা ইচ্ছে করে কাউকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে মর্মে স্থানীয়ভাবে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

৬. হঠাৎ করে জানা গেল, পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন প্রশিক্ষণ নিয়েছে। দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে উদ্বুদ্ধ করে তাদের নেয়া হয়েছে। কিভাবে এটি সম্ভব হলো? কারা করল? এ মৌলিক প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিত হয়ে সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করে, সে প্রেক্ষাপটে পার্বত্য (শান্তি) চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিকল্প কথা ভাবা যেতে পারে।

৭. পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অরক্ষিত আন্তর্জাতিক সীমানা বিশেষ করে দেশের রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার উদয়পুর, দুসর, কংলাক, বাঘাইহাট, শিয়ালদাহ, বেটলিংয়ের সাথে ভারতের মিজোরামের সীমান্ত অঞ্চল এবং বান্দরবানের তিন্দু, রেমাক্রী, ছোট মদক, বড় মদক, মংওয়া, দ্রংগং, ইয়ারান বাগ, লিংরি, মালিংগা, সুখিয়াং, টাংকই, লাপাই এলাকার বিপরীতে মিয়ানমারের ‘চিন’ রাজ্যের পিথং, ঝির, কালাজং, ক্রম দিয়ে, অবাধে অস্ত্র প্রবেশের সুযোগ নি-িদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দিয়ে সন্ত্রাসীদের সীমান্ত চলাচলে শতভাগ রুখে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

৮. পার্বত্য (শান্তি) চুক্তির যেসব শর্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বা বাস্তবায়নের বাধাসমূহ চিহ্নিত করে, করণীয় নির্ধারণে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ এখন অতি আবশ্যক।

৯. বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে কোনো ব্যক্তি, সংগঠন, জাতি-গোষ্ঠীর সবাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সমান অধিকার লাভ করবে। কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগবশত রাষ্ট্র কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা নয়। তবে পিছিয়ে পড়া জাতি-গোষ্ঠীকে সমান পর্যায়ে নিয়ে আসতে ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিতে পারবে। এ অধিকার কিন্তু স্থায়ী নয়। বিবিধ কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে এ পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীকে দেশের অন্য এলাকার বা জাতি-গোষ্ঠীর সমান্তরালে নিয়ে আসা গেলে তাদের অনুকূলে সরকার তার দেয় বিশেষ সহায়তা কমিয়ে এক পর্যায়ে তা বন্ধ করার কথা।

২ ডিসেম্বর/১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি, সংবিধানের ওই ধারার আওতায় সম্পাদিত হয়েছে বিধায় একটি বিশেষ কমিশন বা শক্তিশালী কমিটি গঠনের মাধ্যমে উপকারভোগী তথা তিনটি নৃ-গোষ্ঠী বিশেষ করে চাকমাদের, শিক্ষাদীক্ষা মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু হার, পানি সরবরাহ ইত্যাদি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সামাজিক সূচকসমূহ যাচাইকরত তাদের দেয় সুবিধা থেকে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাদ দিয়ে ওই সহায়তা সংখ্যায় কম এবং চাকমাদের মাধ্যমে প্রায় বঞ্চিত অপর ১১টি নৃ-গোষ্ঠীর অনুকূলে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

১০. বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং অন্যান্য কিছু শিক্ষকসহ বিশেষ শ্রেণীর একটি বিশেষজ্ঞ গ্রুপ পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সমস্যায় পার্বত্য (শাস্তি) চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াই একমাত্র কারণ হিসেবে প্রায়ই উপস্থাপনকরত বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বা আলোচনা সভায় মতামত প্রকাশ করে থাকেন। বহুবিধ আলোচনায় তার অনুকূলে তারা অনেকটা জনমত তৈরিও করতে সক্ষম হচ্ছেন। অথচ এ চুক্তির বেশির ভাগ ধারা উপ-ধারা সরকার কর্তৃক কার্যকর করা সত্ত্বেও সরকারের একমাত্র চাহিদা ‘পাহাড়ে অস্ত্র সংবরণ’ যে এক-শতাংশও পালিত হচ্ছে না, বিষয়টি সেভাবে আলোচনায় আসছে না। এ প্রেক্ষাপটে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে, বিষয়টি বহুল আলোচনায় এনে, বিপরীত জনমত সৃষ্টি করে পাহাড়িদের মনস্তাত্ত্বিক দুনিয়ায় স্পর্শ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

১১. পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান অপারেশন উত্তরণকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম (শান্তি) চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে যেরূপ ছিল সেভাবে পুনঃবাস্তবায়ন করার বিষয়টি বিবেচনা করার এখনই উপযুক্ত সময়।

১২. বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রি-দেশীয় ফোরাম তৈরি করে এ অঞ্চলে সম্ভাব্য খ্রিষ্টান দেশ সৃষ্টির যেকোনো প্রয়াস অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয়ার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।

লেখক : নিরাপত্তা গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন