পার্বত্য তিন জেলার উন্নয়ন সভায় অংশ নেন না ডিসিরা, নেতিবাচক প্রভাব

fec-image

‘আগে জেলা প্রশাসকেরা জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগ দিতেন। ২০১৯ সালে প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে জেলা প্রশাসকেরা এ সভায় যোগ দেন না। তাঁরা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগ না দেওয়ার ফলে পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন হচ্ছে। লক্ষ করা যাচ্ছে সমন্বয়হীনতাও।’

দেশের প্রত্যেকটি জেলায় প্রতি মাসে অনুষ্ঠিত হয় জেলা উন্নয়ন সভা। জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় জেলার উন্নয়নের সার্বিক অগ্রগতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। এতে উপস্থিত থাকেন অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। কিন্তু পার্বত্য ৩ জেলায় (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান) ডিসি ও বিভাগীয় অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা জেলা উন্নয়ন সভায় অংশ নেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তিন পার্বত্য জেলার সভার কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ এবং জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ওই তিন জেলার উন্নয়নে।

প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট থেকে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিন বছরের বেশি মেয়াদকালে এক দিনের জন্যও তিনি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগ দেননি। তাঁর স্থলাভিষিক্ত নতুন জেলা প্রশাসক মো. শহিদুজ্জামান যোগদান করেছেন প্রায় পাঁচ মাস হলো। তিনিও জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগ দেন না।

একইভাবে মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ২০২১ সালের ১ মার্চ থেকে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগ দেন না।
এদিকে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে কর্মরত। তিনিও জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় অংশ নেন না। উন্নয়ন সমন্বয় সভায় জেলা প্রশাসকদের অনুপস্থিতির সুযোগে সংশ্লিষ্ট অন্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারাও হাজির হন না। এতে সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৬১ জেলায় উন্নয়ন সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসকেরা। তিন পার্বত্য জেলা এর ব্যতিক্রম। এখানে সভাপতিত্ব করেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা। এ বিষয়ে ১৯৮৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাতে জেলার উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের জেলায় উন্নয়ন সভার আহ্বায়ক করা হয়। তখন থেকে তিন পার্বত্য জেলার জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিতে সভাপতিত্ব করেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এ সভায় আগে জেলা প্রশাসকেরা অংশ নিলেও এখন আর নেন না।

এ বিষয়ে রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগদান করেন না জেলা প্রশাসক। তবে তাঁর পক্ষে প্রতিনিধি পাঠান। জেলা পুলিশ সুপারও যোগ দেন না। তিনিও প্রতিনিধি পাঠান। অনুপস্থিত থাকেন অন্য বিভাগীয় প্রধানেরা।

তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসক না থাকলে প্রকৃত উন্নয়ন সমন্বয় হয় না।

খাগড়াছড়ি জেলা উন্নয়ন সভার ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ জেলার অনেক কর্মকর্তাই যোগদান করেননি। জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক আবু সাঈদ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার যোগ দেন। জেলার তিনটি পৌরসভা রামগড়, মাটিরাঙ্গা ও সদর পৌরসভার কোনো মেয়র বা প্রতিনিধিও যোগ দেননি।

উপজেলা পরিষদের মধ্যে রামগড়, মহালছড়ি, গুইমারা, মাটিরাঙ্গা এবং খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ৫টি পরিষদের কেউ যোগ দেননি। এ মাসের সভায় জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক, জেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, উপপরিচালক মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, নির্বাহী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগসহ অনেকে এপ্রিলের খাগড়াছড়ি জেলা উন্নয়ন সভায় অনুপস্থিত ছিলেন।

একইভাবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বান্দরবান জেলার উন্নয়ন সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ মাসে জেলা প্রশাসন, পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

কেন জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগদান করেন না, জানতে চাইলে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘পার্বত্য তিন জেলায় উন্নয়ন সমন্বয় সভা হয় না। এই জেলায় একটি মাসিক সভা হয় জেলা পরিষদে। সেই সভায় আমাদের জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন।’

মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে চেয়ারম্যান আমার অফিসে আসেন, আমিও জেলা পরিষদে যাই।’ বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. শহিদুজ্জামানও একই কথা বলেন। তাঁর মতে, এতে কোনো সমস্যা নেই।

জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় জেলা প্রশাসকদের অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কংজুরী চৌধুরী বলেন, ‘আগে জেলা প্রশাসকেরা জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগ দিতেন। ২০১৯ সালে প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে জেলা প্রশাসকেরা এ সভায় যোগ দেন না। তাঁরা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় যোগ না দেওয়ার ফলে পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন হচ্ছে। লক্ষ করা যাচ্ছে সমন্বয়হীনতাও।’

সূত্র: আজকের পত্রিকা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন