পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা যেসব রুট দিয়ে রাঙামাটিতে অস্ত্র আনছে

fec-image

 

চারদিক সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদ, সুউচ্চ পাহাড় আর সবুজে ঘেরা জনপদ পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। পাহাড়ের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে রহস্য, আতংক এবং সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিরাপদ ঠিকানা গড়ে উঠেছে।

পাহাড়ের দুর্গম গিরিপথকে নিরাপদ ঠিকানা বানিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সন্ত্রাসীরা রাঙামাটিতে অস্ত্র নিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। এসব অস্ত্র টাকার বিনিময়ে আবার বিভিন্ন গ্রুপের কাছে পৌছে যাচ্ছে।

নিরাপত্তা বাহিনী এবং স্থানীয় জনসাধারণের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তের চারটি নিরাপদ রুট ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা রাঙামাটিতে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। রুটগুলো হলো-‘‘মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরাম সীমান্ত পার হয়ে বান্দরবানের থানচি, লুলংছড়ি, চাকপতিঘাট, বসন্তপাড়া হয়ে রাঙামাটি শহর, বান্দরবান সদর থেকে রাঙামাটি রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া,কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী বাজার, বড়ইছড়ি হয়ে কাউখালী উপজেলা, মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরাম হয়ে রাঙামাটির বরকল উপজেলার শুকনাচারী, তালুকদারপাড়া, বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী হয়ে বাঘাইছড়ি সদর এবং এছাড়া মিয়ানমার থেকে মিজোরামের পুকজিং, মানপাড়া সীমান্ত পেরিয়ে বাঘাইছড়ির পর্যটন নগরী সাজেক লংকর পয়েন্টে অস্ত্র পৌছানো হচ্ছে।
অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এসব অস্ত্র কিনে এনে পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রপের স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করছে। শুধু তা নয়; এসব অবৈধ অস্ত্র সমতলের সন্ত্রাসীরা কিনে নিয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়ের সন্ত্রাসীরা এসব অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি, খুন,গুম এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তার বজায় রাখতে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে এসব সন্ত্রাসীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত।

চলতি বছরে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ ও অস্ত্র উদ্ধার
চলতি বছরের ০২জানুয়ারী রাঙামাটির লংগদু উপজেলার কাট্টলঅ বিলে নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার সময় গোলাগুলিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসীত গ্রুপের এক সশস্ত্র সদস্য নিহত হয়েছিলো। এ সময় এম আর রাইফেল, এ্যামো ৩০ রাউন্ড, সেনাবাহিনীর নকল পোশাক, মুঠোফোন ১২ টি, বাংলাদেশি ন্যাশনাল আইডি কার্ড ০২টি, ব্যাগ ০৫ টি, কম্বল ১০ টি এবং বিভিন্ন প্রকার নথি সামগ্রী উদ্ধার করা হয়।

নিরাপত্তা বাহিনী রাঙামাটির বন্দুকভাঙ্গা রেঞ্জের পাগলিছড়ি ও যমচুক এলাকায় পাহাড়ের ওপরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্যাম্পের সন্ধান পায় নিরাপত্তা বাহিনী। তবে সেখানে গিয়ে কাউকে ধরতে পারেনি। ০৪ জানুয়ারি হিন্দুস্তান টাইমস এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়।
গত ০৭মার্চ রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হাজাছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফের গোপন আস্তানার সন্ধান ও গোলাবারুদসহ বিপুল সামগ্রী উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।

অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের স্বশস্ত্র সদস্যরা পালিয়ে গেলেও এলাকাটি ঘিরে তল্লাশী চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ, সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত ইউনিফর্ম, বাইনোকুলার, ওয়াকি-টকি সেট, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক ও চাঁদা আদায়ের রশিদসহ অন্যান্য নথিপত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

গত ১৬মার্চ রাঙামাটি সদরের সাফছড়ি ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের তন্যা খামার পাড়ায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) স্বশস্ত্র সদস্যরা প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসীত গ্রুপের সাব পোস্ট পরিচালক ও কালেক্টর নির্মল খীসাকে (৩২) গুলি করে হত্যা করেছে।
রাঙামাটির রাজ¯’লী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা মিতিঙ্গাছড়িতে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও জুম্মা ন্যাশনাল আর্মি (জেএলএ) এর মধ্যে সংঘটিত এক বন্দুকযুদ্ধে ৪ জেএলএ সদস্য নিহত হয়েছে বলে গত ১৯মার্চ কুকি চীন ন্যাশনাল আর্মির ফেসবুক পেইজে দাবি করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গত ২৮এপ্রিল রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের শকিনাছড়া এলাকা থেকে অস্ত্রসহ সুরেশ চাকমা ওরফে বিদ্যুৎ চাকমা (৪০) নামের ইউপিডিএফ’র এক সশস্ত্র সদস্যকে আটক করেছিলো নিরাপত্তা বাহিনী। এসময় তার কাছ থেকে একটি এলজি অস্ত্র, দুই রাউন্ড এ্যামোনিশন, ১০টি চাঁদা আদায়ের রশিদ বই, একটি মোবাইল সেট, নগদ দুই হাজার ৪৮০ টাকা এবং দুইটি হিসাবের খাতা জব্দ করা হয়।

গত ০৬জুন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার উত্তর বঙ্গলতলী এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সন্তু গ্রæপ এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসীত গ্রæপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় এক ব্যক্তি নিহত এবং এক শিশু গুরুতর আহত হয়েছিলো।

গত ১৫জুন রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নের ফুলতলি গ্রামে মগ লিবারেশন পাটি (এমএলপি) সন্ত্রাসীরা এসে গুলি চালিয়ে আব্দুল হাকিম (২৬) নামে এক বাঙালি যুবককে হত্যা করেছে। নিহত আব্দুল হাকিম রাইখালী ইউনিয়নের খন্তাকাটা ঘোনিয়াখোলা এলাকার মৃত বাহার আলীর ছেলে।

গত ২০জুন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মারিশ্যা দিঘিনালা সড়কের ১১ কিলোমিটার এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে অস্ত্রসহ প্রসীত গ্রুপের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর দুই কালেক্টর সুবেল চাকমা (৪২) ও বিন্দুময় চাকমা (৪২)-কে আটক করেছিলো। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল, চাঁদাবাজির রশিদ, নগদ অর্থ, চাপাতি, রামদা, মোবাইলসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ মালামাল জব্দ করা হয়েছিলো।

সেই সময়ে সেনাবাহিনীর বাঘাইহাট জোনের জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মাসুদ রানা বলেছিলেন, ইউপিডিএফ দীর্ঘদিন মারিশ্যা দিঘিনালা সড়কের ১১ কিলো ও শুকনা ছড়া এলাকায় অবস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছিলো। তাই গোপন সংবাদ পেয়ে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ ধরনের অভিযান চলমান থাকবে বলে যোগ করেন এ সেনা কর্মকর্তা।

গত ২৩জুন রাঙামাটি সদরের সাফছড়ি ইউনিয়নের মইনপাড়া স্কুল সড়কে নিরাপত্তা বাহিনী ও ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনায় তিন ইউপিডিএফ সশস্ত্র সদস্যকে আটক করেছিলো নিরাপত্তা বাহিনী। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সামান্য আহত হয়েছিলো। তাদের কাছ থেকে একটি এসএমজি রাইফেল, ১২টি পিস্তলের গুলি, ৪৬টি রাইফেলের গুলি ও বিপুল সংখ্যক দেশীয় অস্ত্র সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছিলো।

গত ২৯জুলাই রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের হরেন্দ্রপাড়া এলাকায় সেনাবাহিনীর সাথে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘটনা¯’ল তল্লাশী চালিয়ে একে-৪৭ একটি, দেশীয় বন্দুক ৩টি, দেশীয় পিস্তলল ১টি, ম্যাগজিন একে -৪৭ ১টি, বল এ্যামুনেশন ৬ রাউন্ড, কার্তুজ ১ রাউন্ড, এমটি-কার্টিজ ৪২টি, ওয়াকিটকি সেট ও ব্যাটারিসহ ৪টি, এ্যামুঃপোচ-১টি, জিপিএস ডিভাইস ১টি, গোপন ভিডিও ক্যামেরা কলম ৩টি, গোপন ভিডিও ক্যামেরা বোতাম-২ টি, চশমা ১টি, ইউপিডিএফ লং লাইভ আর্মব্যান্ড ৫টি, ইউপিডিএফ পতাকা ৩টি, বিভিন্ন ধরনে বই-১০টি, চাঁদা আদায়ে রশিদ বই ২টি উদ্ধার করা হয়েছিলো।

গত ১১ অক্টোবর রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের বগাছড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর পোস্ট কমান্ডার কার্মা চাকমা ও তার সহযোগী লেলিন চাকমাকে আটক করেছিলো। এসময় তাদের কাছ থেকে ১টি পিস্তল ও ১টি ম্যাগাজিন, ৩ রাউন্ড অ্যামুনিশন, ১টি ওয়াকিটকি সেট, ২টি মোবাইল ফোন ও ২টি চাঁদা আদায়ের রশিদ জব্দ করা হয়েছিলো।
তবে স্ব-স্ব সংঘটিত এলাকার জনপ্রতিনিধি ও ¯’ানীয়রা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নাম-পরিচয় গোপন করে তথ্য দিলেও সরাসরি কথা বলতে প্রাণ হারানোর ভয়ে তট¯’ থাকেন।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

রাজ¯’লী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান খান বলেন, আমরা মাসিক আইন শৃঙ্খলা বৈঠকে এ উপজেলার আইন শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মাদক, সন্ত্রাস নির্মূলে সীমান্তবর্তী এলাকায় বিজিবি চেক পোষ্টের মাধ্যমে তল্লাশী অভিযান এবং সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রাখা রয়েছে।

দেশের সীমান্তবর্তী বাঘাইছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমেনা মারজান বলেন, আমরা কোন তথ্য পেলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করি এবং আটক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়াও সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার রাখতে নিরাপত্তা বাহিনীকে অবগত করা আছে।

রাঙামাটির পুলিশ সুপার ড. এস এম ফরহাদ হোসেন বলেন, চারদিক সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদ এবং দুর্গম পাহাড় বিস্তৃত। গোপন তথ্যর ভিত্তিতে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে সেনা-পুলিশের যৌথ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশ যেখান তথ্য পাচ্ছে সেখানে এ্যাকশন নিচ্ছে।

রাঙামাটি ৩০৫পদাতিক ডিভিশনের রিজয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হক সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইউপিডিএফের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী যারা রয়েছেন, তাদের আমি লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছি। আমি এতটুকু নিশ্চিত করতে চাই রাঙামাটি রিজিয়নের পক্ষ থেকে, পাহাড় থেকে স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিতাড়িত হতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য, রাঙামাটি, সন্তু লারমা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন