পাহাড়ের অর্থনীতিতে অশনি সঙ্কেত

বনবিভাগে বিভিন্ন রেঞ্জ অফিসের সামনে এভাবেই খোলা আকাশের নীচে নষ্ট হচ্ছে আটককৃত মূল্যবান কাঠ৤

রাঙামাটির কাঠ ব্যবসা বন্ধ গত সাতদিন

আনোয়ার আল হক
রাঙামাটি ২৫ এপ্রিল’১৩, কাঠ ব্যবসার ওপর সীমাহীন চাঁদাবাজি ও খোদ রাঙামাটি শহর থেকে বার বার কাঠ শ্রমিক অপহরণের জের ধরে বন্ধ হয়ে গেছে রাঙামাটির কাঠ ব্যবসা। পাহাড়ের অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি কাঠ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর সাথে জড়িত সহ¯্রাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। স’ মিলগুলোতে কাজ না থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে স’মিল শ্রমিকরা। এই অবস্থাকে পাহাড়ের অর্থনীতির জন্য আর একটি অশনি সঙ্কেত বলে মনে করছেন রাঙামাটির ওয়াকিবহাল মহল।
বিরোধী দলের আন্দোলন ও গত তিনমাসের লাগাতার হরতালে যখন সারা দেশের বাজার ব্যবস্থায় মন্দাভাব বিরাজ করছে, এমনি প্রেক্ষাপটে পাহাড়ের অর্থনীতির এই নতুন সঙ্কট খেটে খাওয়া মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে। স’মিল শ্রমিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, পাহাড়ের সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব এবং বড়লোকদের ব্যবসা নিয়ে রাজনীতির কারণে আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষ এখন দাবার গুটিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের জীবন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথাটি কেউ ভাবছে না। শ্রমের বিনিময়ে জীবন চালাতে এসে একবার আমরা অপহরণকারীদের টার্গেট হচ্ছি, আবার রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে বেকার হয়ে পড়ছি। কাজ করতে পারলে আমরা দিনশেষে পরিবারের লোকদের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে পারি। কিন্তু হঠাৎ করে স’মিলগুলোতে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক গত কয়েকদিন বেঁেচ থাকার মতো খাদ্যটুকুও জোগাড় করতে পারেনি। তারা এ অবস্থা নিরসনে পাহাড়ে কর্তব্যরত সকল ধরণের প্রশাসনের সমন্বয়ের মাধ্যমে আশু সমাধান দাবি করেছেন।
গতকাল বুধবার রাঙামাটি শহরের স’মিলগুলো ঘুরে দেখা যায় মিলগুলোতে কোনো কার্যক্রম চলছে না। তবে এ কথা স্বীকার করেননি মিল মালিকরা তারা জানান, মিলগুলোতে গাছ ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ না হলেও সাধারণ কাজকর্ম চলছে। তবে এও স্বীকার করেন, রাঙামাটি থেকে বাইরের জেলা পরিবহন করা গাছের কার্যক্রমই তাদের মুল কাজ। বিপরীত কথা বললেন মিল শ্রমিকরা, তারা জানালেন মিলে আমরা কোনো কাজ করছি না। কাজ করছেন না কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বললেন, তারা বললেন, মালিকরাও বন্ধ রেখেছে ব্যবসায়ীরাও বন্ধ রেখেছে।
গত ১৭ এপ্রিল রাঙামাটি শহরের রাজবাড়ি স’মিল থেকে শাহাব আলী ও সফিউদ্দিন নামে দুই কর্মচারীকে অপহরণের পর থেকই স’মিলগুলো অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের ছাড়িয়ে আন হলেও মুলত এই অপহরণের রেশ ধরে তৈরি হয়েছে ত্রিমুখী সঙ্কট। কাঠ ব্যবসার সাথে জড়িত সূত্রগুলো জানিয়েছে ইউপিডিএফকে টাকা দিয়ে শ্রমিক ছাড়িয়ে আনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে জেএসএস। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে তারা রাজবাড়ি স’মিল বন্ধ রাখতে বলেছে। এদিকে ইউপিডিএফ শহরের অন্যান্য স’মিল মালিকদের সাফ জানিয়ে দিয়ে বার্ষিক চাঁদা দিয়ে টোকেন কাটা হয়নি, এমন স’মিলগুলোতে টোকেন নিশ্চিত না করা পর্যন্ত যেনো কাজকর্ম বন্ধ রাখা হয়। খুব সহসাই তারা স’মিলগুলোতে টোকেন চেক করতে আসবে।
এদিকে স’মিল মালিকদের অপর একটি সূত্র দাবি করেছে, রাজবাড়ি স’মিল বন্ধ থাকায় স’মিল শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সকল স’মিলে কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মিল বন্ধ রাখার বিষয়ে রাজবাড়ি স’মিলের ফোরম্যান মমতাজ উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মালিক বন্ধ রাখতে বলেছে, তাই আমরা মিল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি। ওই মিলের শ্রমিক সর্দার পান্না মাঝি জানান, আমরা খেটে খাওয়া মানুষ কাজ পেলে কাজ করি, আমরা কিভাবে মিল বন্ধ রাখবো। মালিক কাজ করাচ্ছে না তাই আমরা কাজ করতে পারছি না। কাজ করতে না পারায় পরিবার পরিজন নিয়ে সঙ্কটে আছি। মালিক কেন মিল বন্ধ রাখতে বলেছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই খবর তো আমরা জানবো না।
এ ব্যাপারে রাজবাড়ি স’মিলের ব্যবস্থাপক বিটু চাকমার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সঙ্কট হলে মাঝে মাঝে মিল বন্ধ থাকতেই পারে। আমরা দু’একদিন বন্ধ রেখেছিলাম। এখন তো চালু আছে, কিন্তু শ্রমিকেরা কাজ করছে না। তিনি এও বলেন আপনারা কাঠ ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করলে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাবেন। আমরা এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না।
রাজবাড়ি স’মিলে দেখা যায় ১০ থেকে ১২টি কাঠের বোট ঘাটে ভিড়ে আছে। ওই বোটগুলো থেকে গত এক সপ্তাহেও কাঠ আনলোড করা হয়নি। ওই কাঠের মালিকের প্রতিনিধি একজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আমরা প্রতিদিন একটি বোটের জন্য দুই হাজার টাকা করে ডেমারেজ দিচ্ছি’। কাঠ আনলোড না হওয়ায় মালিকের অনেক টাকা লস যাবে’।
এদিকে স’মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাই খোকন জানান, রাজবাড়ি স’মিলে যেহেতু কাজ হচ্ছে না, বাধ্য হয়ে আমরা অন্য স’মিলগুলোতেই কাজ করতে পারছি না। একই ইউনিয়নের কিছু শ্রমিক কাজ করবে কিছু শ্রমিক কাজ করবে না তাতো হয় না। তবে তিনি জানান, অন্য স’মিলগুলো শুধুমাত্র পারমিটের গাছ লোড আনলোডের কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পারমিটের গাছ ছাড়া আর কোনো বৈধ গাছ আছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছু বলতে চাননি।
এই বিষয়ে রাঙামাটি কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাওন ফরিদ জানান, রাজবাড়ি স’মিল থেকে শ্রমিক অপহরণের ঘটনার পর থেকে স’মিলগুলোতে কাজ বন্ধ রয়েছে কথাটি সত্য তবে আসলে কেন বন্ধ এ বিষয়টি আমাদের কাছেও পরিষ্কার নয়। তবে শ্রমিকরা জানিয়েছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত তারা কাজ করবে না। ব্যবসায়িদের সাথে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর কিছুটা বিরোধ হওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করে বলেন, আমরা আশা করছি সহসা এ ঝামেলা মিটে যাবে। তবে সমস্যাটা আমাদের সাথে নয়।
এদিকে উপজাতীয় কাঠ ব্যবসায়ী ও জোত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অন্যসাধন চাকমা, কোনো সঙ্কট রয়েছে বলে স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, নানা কারণে দুয়েকদিন ব্যবসা বন্ধ থাকতেই পারে। এটা আবার ঠিক হয়ে যাবে।
রাঙামাটি করাতকল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাই খোকন আরো বলেছেন, ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের (সন্ত্রাসীদের) কি দ্বন্দ্ব তাতো আমরা জানি না, কিন্তু এই দ্বন্দ্বের কারণে বারবার শ্রমিক অপহরণ, নির্যাতন আমরা আর মেনে নেবো না। এখন থেকে এই রকম ঘটনা ঘটলে এরফলে সৃষ্ট যেকোনো ঘটনার জন্য সংশ্লি¬ষ্টদেরই দায়ি থাকতে হবে।
রাঙামাটি কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল আলম চৌধুরী জানান, বার বার শহরের স’মিল থেকে শ্রমিক অপহরণের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কি করা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে তিনি সোমবার একটি সভা করেন। সভায় ব্যবসায়ী, মিল মালিক, শ্রমিক ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান শুধুমাত্র রাজবাড়ি স’মিল বন্ধ থাকার বিষয়টি তার গোচরে রয়েছে। অন্য মিলগুলো বন্ধ থাকার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
কাঠ ব্যবসার সাথে জড়িত বিভিন্ন সূত্র জানায়, রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলাতেই বর্তমানে চাঁদার পরিমাণ সীমাহীনভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাঠ ব্যবসার সাথে জড়িতদের অবশ্যই স্থানীয় একাধিক সশস্ত্র গ্র“পকে প্রতি বর্গফুটে ৪০ এবং ৩৫ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। আর এই চাঁদা আদয়ে তিন পাহাড়ি সংগঠনের কোন গ্র“প কার চেয়ে এগিয়ে থাকবে এই দ্বন্দ্বে সঙ্কট আরো ঘনিভূত হচ্ছে।
এদিকে সম্প্রতি গণমাধ্যমের সাথে এক সাক্ষাৎকারে খোদ পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার চাঁদাবাজির বিষয়ে খোলামেলা বক্তব্য দেওয়ার পর পাহাড়ি সংগঠনগুলো আরো কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে দাবি করেছে একাধিক সূত্র। তবে মন্ত্রীর বক্তব্যকে সাধুবাদ জানিয়েছে ব্যবসায়ী, শ্রমিক সংগঠনগুলো এবং রাঙামাটির অভিজ্ঞ মহল। সাক্ষাৎকারে মন্ত্রী বলেন, জেএসএস ও ইউপিডিএফ এর চাঁদাবাজিতে পাহাড়ের মানুষ অতিষ্ট এটা একটি প্রকাশ্য বিষয়। তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি আমরা শুনতে চাই না, দেখতেও চাই না। মানুষ চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি চায়। জিম্মি দশা থেকে মুক্তি চায়। চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যপারে তিনি সবাইকে উদ্যোগে নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
কিন্তু ব্যবসায়ী, মালিক-শ্রমিক এবং ভূক্তভোগীরা বলেছেন, পাহাড়ের প্রশাসনগুলো সম্মিলিতভাবে চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে পাহাড়ের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আর এর মাশুল গুণতে হবে জনগণ ও সরকারে কে। তারা এই অবস্থাকে অর্তনীতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে দাবি করেছেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন