পাহাড়ে বৈশাখী ও বৈসাবী উৎসব আসছে একই সাথে

155697_1651710407914_1359524_n 

মো. আল আমিন, পার্বত্যনিউজঃ

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত পাহাড় জুড়ে শুরু হয়েছে বাংলা নববর্ষ পালনের প্রস্তুতি। তবে একটু ব্যাতিক্রমি মাত্রায় উদযাপিত হয় পাহাড়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন। পাহাড়ে বাঙালির ঘরে বৈশাখী উৎসবের সাথে পাহাড়িদের ঘরে ধুম পড়ে বৈসাবী উৎসব পালনের। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান পাহাড়ি অধিবাসীরা ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করে থাকে। চাকমারা পালন করে ‘বিজু’ নামে, ত্রিপুরারা ‘বৈসু’, তঞ্চঙ্গ্যারা ‘বিসু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ নামে। এই চার সম্প্রদায়ের দেওয়া উৎসবের নামগুলো একত্র করে, এখন এর নাম রাখা হয়েছে ‘বৈসাবি’।

এই বৈসাবী উৎসব প্রতিবছর ইংরেজী এপ্রিল মাসের ১২, ১৩ ও ১৪ তারিখ বা বাংলা চৈত্র মাসের ৩০, ৩১ ও নতুন বছরের বৈশাখের ১ তারিখে আয়োজন করা হয়। পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এই উৎসব বেশ পুরোনো। এই বৈসাবী উৎসব পালনের পাশাপাশি পাহাড়ের বাঙালি সম্প্রদায় প্রস্তুত বৈশাখী উৎসব পালন করতে। তবে সন্দেহ নেই ব্যাতিক্রমি মাত্রা থাকায় পাহাড়ে বৈসাবী উৎসব নাম ও পরিচিতিতে ‘বৈশাখী উৎসব’কে ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন কারনে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ এই বৈসাবী উৎসব সম্পর্কে অধিক আগ্রহী।

এই বৈসাবি উৎসবটি মূলত বাংলা বর্ষবরন উৎসবেরই অপর একটি নাম। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। বাংলা সন গননাও শুরু হয় তার সময়কাল থেকেই। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাসুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। মোঘলদের অধীনস্থ হিশেবে তখনকার উপজাতি শাসকরাও এই নিয়ম মেনে কর ও খাজনা আদায় করতেন।  মুঘল আমল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীরা বাঙালিদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হন যে, আসাম সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটের পরিচালক জেপি মিলস ১৮ শতাব্দীতে চাকমাদের ‘Most Bengalised Tribes’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

এরপর ১৯৬৭ সালের দিকে যখন ঘটা করে বাংলা নববর্ষ উদযাপন তথা পহেলা বৈশাখ পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠে, অনুমান করা হয় তেমন সময়েই পাহাড়িদের এই উৎসবগুলো বিস্তৃতি লাভ করে। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর এই উৎসবকে ভিন্ন নামকরনের কারন জানা না গেলেও, স্বকিয়তা নিয়ে তৎকালীন সময়ে অত্যন্ত সচেতন পাহাড়ের বিভিন্ন গোষ্ঠী মুঘল সুবেদারদের খুশি করতে বেশ জাকজমকের সাথে এই উৎসব পালন করা শুরু করে।  নিজেদের স্বকিয়তা বজায় রাখতেই ভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করা হয়। তবে বর্তমানে সব উৎসবকে একত্রে বৈসাবি নামেই ডাকা হয়।

প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও তিন পার্বত্য জেলায় পালিত হতে যাচ্ছে বাংলা নববর্ষবরন উৎসব বৈসাবি। আগামী ১২, ১৩, ১৪ এপ্রিল থেকে তিন জেলা জুড়ে পালিত হবে এই উৎসব। ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে। কেনাকাটা চলছে জোরেশোরে। ব্যাস্ত সময় পার করছেন ঘরের কর্তারা। বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেছেন দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাহাড়ি চাকুরীজীবী ও ছাত্ররা। পিছিয়ে নেই বাঙালিরাও। বাঙ্গালীর প্রাণের এই উৎসব ঘিরে সমান মাতামাতি তাদের। পান্তা-ইলিশ, পোষাক, রঙ – কোন দিক থেকেই যেন আগ্রহের ঘাটতি নেই তাদের।

তবে স্থানীয় বাঙালীদের অনেকেই চান, পাহাড়ে পাহাড়ী-বাঙালী সম্প্রীতি স্থাপনে বেসাবীর সাথে বাঙালীর নববর্ষকেও যুক্ত করে একটি সুন্দর নাম দিয়ে একসাথে উৎযাপন করা হোক।

দীঘিনালায় বৈসাবী উদযাপন কমিটি গঠনঃ

গত শনিবার উপজেলার উদাল বাগান উচ্চবিদ্যালয় মিলনায়তনে চাকমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির পরিচালক আনন্দ মোহন চাকমার সভাপতিত্বে বৈসাবী উদযাপন সংক্রান্ত এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা সভায় নয় সদস্য বিশিষ্ট উদযাপন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সদস্য সচিব আনন্দ মোহন চাকমা পার্বত্য নিউজকে জানান, আগামী ১২ এপ্রিল থেকে শুরু হবে ৩ দিনব্যাপী এই বৈসাবী উৎসব।

রাঙ্গামাটিতে বৈসাবী উৎসব উদ্বোধন করবেন সন্তু লারমাঃ

রাঙ্গামাটিতে সোমবার বৈসাবী উদযাপন কমিটি গঠিত হয়েছে। বৈসাবী উৎসব কমিটির আহ্বায়ক প্রকৃতি রঞ্জন চাকমার সভাপতিত্বে বৈসাবী উৎসব উদ্বোধন করবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় উরফে শন্তু লারমা, প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন চাকমা সার্কেল চিফ রাজা দেবাশীষ রায়, সম্মানিত অথিতি হিসেবে থাকবেন রাঙ্গামাটির সাংসদ উষাতন তালুকদার, গৌতম দেওয়ান, মানিক লাল দেওয়ান ও জগৎ জ্যোতি চাকমা। উল্লেখ্য, রাঙ্গামটিতে আগামী বুধবার থেকে বৈসাবী উৎসব সূচনার কথা রয়েছে।  

এছাড়াও বান্দরবানে বৈসাবী উদযাপন কমিটি গঠনের খবর পাওয়া গেছে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি আর গতবারের আনন্দকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ব্যাস্ত সময় পার করছেন কমিটির সাথে জড়িত ব্যাক্তিরা। 

বাংলা নতুন বছরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বর্ষবরণ উৎসব ভিন্ননামে বা ভিন্ন ব্যাপ্তিকাল সহ পালিত হলেও এর তাৎপর্য ব্যাপক। বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব কালের আবর্তনে রঙ পাল্টালেও, এখনও প্রায় আগের নিয়মে পালিত হয় পাহাড়িদের উৎসবগুলো। তবে রঙ পাল্টিয়েছে কিছুটা হলেও। কর প্রদানের একটি উৎসবকালের আবর্তনে পরিণত হয়েছে জাতিগোষ্ঠীসমূহের বৃহত্তম সামাজিক উৎসবে। পুরাতন যত অমঙ্গল আর অশুভ, সব ধুয়ে মুছে যাক, বেড়ে উঠুক বৈশাখের অনুভব। সকলকে পহেলা বৈশাখ আর বৈসাবি উৎসবের শুভেচ্ছা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন