পেকুয়ায় বহু মালয়েশিয়াগামীর হদিস নেই দীর্ঘদিন ধরে, পরিবারে শোকের মাতম

মানবপাচার
এম.জুবাইদ, পেকুয়া:
কক্সবাজারের পেকুয়ায় মানবপাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানো অনেক লোকের হদিস না পাওয়ার গুঞ্জন চলছে। এনিয়ে নিখোঁজ পরিবারের লোকজনের মাঝে দেখা দিয়েছে আহাজারী আর্তনাদ আর শোকের মাতম।

এছাড়া, প্রভাবশালী মানবপাচার চক্রের অঘোষিত কড়া নজরদারী ও হুমকির চাপে বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগীরা ভয়ে মুখ খোলারও পাচ্ছেনা সাহস অভয়।

দেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজারের উপকূলীয় মডেল উপজেলার নাম পেকুয়া। ৭ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই জনপদে প্রায় দু’লক্ষাধিক মানূষের বসবাস রয়েছে। দেশের দরিদ্র পীড়িত অন্যতম একটি উপজেলা হিসাবে এখানকার লোকজনও দারিদ্রতার কষাঘাতের কারণে জিবন জীবিকার তাগিদে সব সময় খুঁজে বেড়ান দেশের বাইরের কর্মসংস্থান। আর এলাকার মানূষের এ চাহিদা প্রত্যাশা ও স্থানীয় প্রশাসনের বিদেশগামীদের নানা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির অভাবকে পুঁজি করে দীর্ঘদিন ধরে জনপদটিতেও দাপিয়ে চলেছে ক্ষমতাধর অবৈধ মানবপাচার চক্রের লোকজন।

এ অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে গত বছর তিনেক ধরে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জিবন ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে অনেক মায়ের সন্তান, সহধর্মীনীর স্বামী, বোনের ভাই, সন্তানের পিতা। সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়াসহ বিদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রে পাড়ি জমানো লোকজনদের মধ্যে অনেকেরই হদিস খোঁজ মিলছেনা বছরের পর বছর ধরে। তবুও নানা কারণে তাদের পরিবারের লোকজন বিদেশ পাড়ি জমানো লোকজনদের কোন না কোন সময় নিজ ঘরে বা দেশে ফিরে আসার ছিল আশা।

কিন্তু থাইল্যান্ডে অভিবাসীদের গণকবরের সন্ধান, বিদেশের কারাগারে অনেক লোকের দেশে ফেরার আর্তনাদ আহাজারীর পাশাপাশি গন্তব্যের তীরে পৌঁছেও সেদেশে আশ্রয় না পেয়ে সাগর জলে আটকে মানবেতর দিনাতিপাতের ঘটনা গণমাধ্যমের বদৌলতে সকলের নজরে পড়ায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে অনেককেই। যার জের ধরে হদিস বিহীন নিখোঁজ আপনজনদের সন্ধানে তাদের পরিবারে এখন দেখা দিয়েছে আহাজারী আর্তনাদ।

সারা বিশ্বের গণমাধ্যমকর্মীরা যখন নড়ে চড়ে এসব ঘটনাবলী নিয়ে তাদের লেখনী আর সচিত্র তথ্য চিত্র রেডিও-টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরছে ঠিক তখনি জেলার পেকুয়ায়ও বিদেশ পাড়ি জমানো নিখোঁজদের সন্ধানে তাদের স্বজনরা হারানো আপনজনকে খুঁজে পেতে শুরু করেছেন নানা চেষ্টা তদবির আর দৌড়ঝাফ।

উপজেলার ৭ ইউনিয়নের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে ইতিমধ্যে বিদেশে পাচারের শিকার মানুষের হদিস না পাওয়া নিয়ে চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে সবখানেই জমে উঠেছে নানা আলোচনা সমালোচনা। ফলে, বিষয়টি নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রস্তুতে এ প্রতিবেদক উপজেলার প্রত্যন্ত পাড়া-মহল্লায় সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে জানতে পারেন যে, উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন ও পাড়া-মহল্লায় রয়েছে অবৈধ মানবপাচার চক্র ও তাদের লেলিয়ে দেয়া দালালদের রয়েছে নিরব অবাধ দৌরাত্ম। আর এ দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে গতকয়েক বছরে পেকুয়া উপজেলা থেকে বিভিন্ন উপায়ে নানাদেশে পাচার হয়েছে শত শত মানুষ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সফল হলেও অনেকেই হয়েছেন ব্যর্থ ও কারান্তরীণ।

খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, উপজেলার অন্যতম পাহাড়ি জনপদ টইটংয়ের দরগাহ মুরা নামক এলাকার মনজুর আলম নামের এক অসহায় বৃদ্ধ অভিযোগ করেছেন, প্রায় ৪/৫মাস পূর্বে উপজেলার টইটং ইউনিয়নের পশ্চিম সোনাইছড়ি ভেলুয়াপাড়া ঐলাকার বৃদ্ধ মনজুর আলমের একমাত্র পুত্র সাইফুল ইসলাম(২৪) নামের এক যুবককে প্রতিবেশী বারবাকিয়া ইউনিয়নের কাদিমাকাটা এলাকার জনৈক বদিউল আলমের স্ত্রী তার মালয়েশিয়া প্রবাসী স্বামীর সাথে কাজ পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফুসলিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যান।

পরে, খোঁজ নিতে গিয়ে ধনিয়াকাটা স্টেশন এলাকার কলা ব্যবসায়ী মিজান নামের এক যুবক তার ছেলে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছেন জানিয়ে ওই বৃদ্ধার কাছ থেকে দফায় দফায় ২লক্ষাধিক টাকা হাতিয়েও নেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ওই বৃদ্ধা মনজুর আলমের পুত্র সাইফুলের কোন খোঁজ খবর নাই।

উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়ন পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ওই গ্রামের বকশিয়াঘোনা এলাকার নুরুল ইসলামের পুত্র বাদশা(২০), নুর আহমদের পুত্র হেলাল উদ্দিন(২৩), ছৈয়দ হোছনের পুত্র জাফর আলম(২৫), বকশিয়াঘোনায় নানার বাড়িতে পালিত মোজাম্মেলের পুত্র আবদুল মান্নান(২০) সহ আরো অনেকে দীর্ঘদিন পূর্বে স্থানীয় দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমালেও আজো তাদের নেই কোন খোঁজ-খবর।

শিলখালী ইউনিয়নের জারুলবুণিয়া থেকে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানো একাধিক অভিবাসী পেকুয়ায় কর্মরত সংবাদকর্মীদের সাথে বিভিন্ন সময়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে অভিযোগ করে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের দেশ পরিচালনায় আসলে বিএনপি-জামাতের ব্যর্থ সরকার পতন আন্দোলনের জের ধরে স্থানীয় বিএনপি সমর্থীত ইউপি চেয়ারম্যানের ছত্রচ্ছায়ায় গ্রামটির ৬নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার নুরুল আমিন সাগরপথে গোপনে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান।

পরে, নানা কৌশলে তার এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন মহল্লা থেকেও তার মাধ্যমে বেশ কিছু লোকজনকে চক্রটির লেলিয়ে দেয়া দালালের প্রলোভনের ফাঁদে আটকিয়ে পরিবারের লোকজনের সম্মতি ছাড়া গোপনে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয় মোটাংকের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে।

এনিয়ে ওই সাবেক ইউপি সদস্যের সাথে তার বাড়ির সামনে ভিন্ন এলাকার কয়েকজন লোকজনের সাথে টাকা পয়সার লেনদেন ও তার গডফাদার জনপ্রতিনিধির নাম উচ্চারণে প্রকাশ্যে ব্যবসার ঘটনাও ঘঠে। এক পর্যায়ে ওই বিরোধ ধামাচাপা দিতে তড়িঘড়ি কিছুদিনের জন্য ওই ইউপি সদস্যও গোপনে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেন।

বিষয়টি গোপন থাকলেও সম্প্রতি ওই প্রাক্তন ইউপি সদস্য দেশে ফিরলে মালয়েশিয়া প্রবাসী তার এলাকার বেশকয়েকজন লোক বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে মুঠোফোনে ফাঁস করে দেন। এভাবে আরো অনেকেই অবৈধপথে বিদেশ পাড়ি জমালেও দীর্ঘদিন যাবত খোদ পরিবারের সদস্যদের সাথে তাদের যোগাযোগ না হওয়ার ও হদিস না পাওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

পেকুয়া থানার ওসি মোঃ আবদুর রকিবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এধরনের ঘটনায় বিচ্ছিন্ন কয়েকটি অভিযোগ দায়ের হলে তার বিষয়ে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ। আর ইতিমধ্যে মানবপাচারের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেশকয়েকজনকে পুলিশ আটক করে হাজতেও পাঠিয়েছে পুলিশ। তিনি জানান, মানবপচার ঘটনার সবিস্তার বর্ণনায় যে কারো কাছ থেকেই লিখিত অভিযোগ পেলে দ্রুত তদন্তপূর্বক নিখোঁজের সন্ধান, উদ্ধারের পাশাপাশি জড়িতের বিরুদ্ধেও দ্রুত তৎপরতা শুরু করবে পুলিশ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন