বান্দরবানের সাঙ্গু নদী: নাব্য, জীববৈচিত্র্য ও পর্যটন

fec-image

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নদী সাঙ্গু। বান্দরবানের থানচি উপজেলার মদক এলাকার পাহাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া নয়নাভিরাম এই নদী বান্দরবানের সদর ও রুমা উপজেলা হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, দোহাজারী, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দুই অংশে বিভক্ত হয়ে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে মিশেছে।

বান্দরবান জেলার উপর দিয়ে সাঙ্গুসহ মাতামুহুরি, নাফ, বাঁকখালী, রেজু, সোনাইছড়ি, হারবাংছড়া ইত্যাদি নদ-নদী প্রবাহিত হলেও দৈর্ঘ্যর দিক থেকে সাঙ্গুই বান্দরবানের বৃহত্তম ও প্রধান নদী।

সাঙ্গু নদীর অপর নাম শঙ্খ। বান্দরবানের মার্মা সম্প্রদায় এই নদীকে ‘সাবুক খ্যং’ বা ‘রেগ্রীইং খ্যং’ নামেও অভিহিত করে থাকেন। ‘রে’ অর্থ পানি আর ‘গ্রীইং’ অর্থ পরিষ্কার বা স্বচ্ছ, আর ‘খ্যং’ অর্থ নদী। অর্থাৎ ‘রেগ্রীইং খ্যং’ মানে ‘পরিষ্কার বা স্বচ্ছ পানির নদী’। এ প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন একজন ইংরেজ প্রশাসকের মন্তব্য, The Sangu is in the south of the district. The upper reaches of this river are known to the maghs as Sabok Khyoung, and near Bandarban as Rigray Khyoung—. In the plains, it is known as Sangu which is a corruption of Shanka, a shell. The river is tidal to within a short distance of Bandarban. (সূত্র: An Account of the Chittagong Hill Tracts, R.H. Sneyd Hutchinson, The Bengal Secretariat Book Depot, Calcutta, 1906). মুহাম্মদ ইসহাক কর্তৃক সম্পাদিত Bangladesh District Gazetteers:Chittagong Hill Tracts. গ্রন্থেও সাঙ্গু নদী নিয়ে একই কথা বলা হয়েছে।

বান্দরবান শহরের অবস্থান সাঙ্গু নদীর তীরেই। তাছাড়া, সাঙ্গুর দুই তীর ধরেই বসতি গড়েছেন এখানকার বেশির ভাগ মানুষ। যোগাযোগ, পানীয় জল ও মৎস্য আহরণের প্রয়োজনে এবং জীব-বৈচিত্র্যের দিক থেকে সাঙ্গুকে বান্দরবানবাসীর ‘লাইফ-ব্লাড’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

কিন্তু ধীরে ধীরে নাব্য হারিয়ে সাঙ্গু নদী বিপন্ন হয়ে উঠছে। বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা মাটি ও বালিতে ভরাট হয়ে উঠছে সাঙ্গুর তলদেশ। ফলে এর পানি ধারণক্ষমতা কমছে। এতে একদিকে বর্ষায় অল্প বৃষ্টিতেই বন্যা হচ্ছে আর অন্যদিকে গ্রীষ্মে পানীয় জল ও সেচের পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। এই অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন না হলে তলদেশ ভরাট হয়ে পুরোপুরি নাব্য হারানোর আশঙ্কা রয়েছে সাঙ্গুর। নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও বালি আহরণের ফলে ভূমিক্ষয়ের কারণে সাঙ্গুর গতিপথও বদলে যাচ্ছে।

এক সময় নানান জাতের মাছে ভর্তি ছিল সাঙ্গুর বুক। সাঙ্গুর দুই তীরের উর্বর জমিগুলোতে ধানসহ মৌসুমী ফসলের বাম্পার ফলন হতো; তীরবর্তী ঘন বনগুলো ছিল পাখ-পাখালি, সাপসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। নাব্য হারানো, নদী-তীরের অপদখল আর তীরবর্তী বৃক্ষগুলো নিধন করার কারণে এখন আর সেই অবস্থা নেই সাঙ্গুর। ফলে জীব-বৈচিত্র্যের উপর পড়ছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব।

ইদানিং অসংখ্য পর্যটকের আগমন ঘটছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার বান্দরবানে। দুর্নিবার আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই সাঙ্গুতে নৌ-বিহার করছেন; গোসল করতে নামছেন। এতে মাঝেমধ্যে সলিল সমাধির মতো দুর্ঘটনারও শিকার হচ্ছেন পর্যটকরা। সাম্প্রতিককালে সাঙ্গুতে গোসল করতে নেমে একই পর্যটক পরিবারের একাধিক সদস্যের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

সাঙ্গু নদী বাঁচলে বান্দরবান বাঁচবে; এর জীব-বৈচিত্র্যও রক্ষা পাবে। এজন্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত অবিলম্বে। তাছাড়া, স্থানীয়ভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশে পর্যটকদের জন্য তথ্যকেন্দ্র, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লাইফ-গার্ড, নিবন্ধিত ও অভিজ্ঞ ট্যুর-গাইডসহ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা জরুরি।

লেখক: এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট, বাংলাদেশ।
shahjahanmohammed38@gmail

লেখকের আরো লেখা পড়ুন:

রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব?

তুম্ব্রু খালের প্লাবন, সীমান্ত চুক্তি ও আমাদের কূটনীতি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন