ঘরে ঘরে হাজির হচ্ছে মিয়ানমারের সৈন্যরা

বিদ্যুৎ বিল দাও! নয়তো গুলি খেয়ে মরো!

fec-image

সামরিক জান্তাকে রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত রাখতে অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করেছে মিয়ানমারের জনসাধারণ। সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ বিল আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সেনাবাহিনী।

সকালে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছিলেন মিয়ানমারের স্কুল শিক্ষক দাও থিদা পিওনি, আর তখনই বাইরে চার সৈন্যের বুটের আওয়াজ। দরজায় ঠকঠক শুনে বাইরে বেরিয়ে এলেন দাও থিদা; তার বিদ্যুৎ বিল বাকি ছিল। সৈন্যরা তাকে বললো দ্রুত সরকারি বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে বিল পরিশোধ করে আসতে।

জবাবে দাও থিদা জানতে চাইলেন বিল না দিলে কি হবে? সাথে সাথে সৈন্যদের একজন তার দিকে বন্দুক তাক করে বললো, “তোমার কাছে যদি নিজের জীবনের চেয়ে টাকার মূল্য বেশি হয় তাহলে বিল দিও না!” একথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে ঘরের পোশাকেই বিদ্যুৎ অফিসে ছুটে যান এই শিক্ষিকা এবং বিল পরিশোধ করেন।

গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। এরপর থেকে সামরিক শাসনের প্রতিবাদে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছেন মিয়ানমারের অসংখ্য মানুষ। সামরিক জান্তাকে রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত রাখতে অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ বিল দেওয়াও বন্ধ করেছেন তারা।

কিন্তু জনসাধারণের এসব উদ্যোগ সামরিক শাসনের পতন ঘটাতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানের এগারো মাস পরে এসেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী টাকা আদায়ের জন্য এতটাই মরিয়া যে তারা এখন কঠোর পাওনাদারের মতো আচরণ করছে।
মিয়ানমারবাসী জানান, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইয়াঙ্গুন ও মান্ডালেসহ বিভিন্ন শহরে সৈন্যরা বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাজির হচ্ছে বিল উঠাতে।

সেনাবাহিনীর এই মরিয়া আচরণের কারণও খুব সহজেই অনুমেয়। মিয়ানমারে প্রতিবাদ-ধর্মঘট ও অসহযোগ আন্দোলনকে রুখে দিতে ইতোমধ্যেই ব্যাপক ধরপাকড় চালিয়েছে সেনাবাহিনী। এবার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য হুমকিও যুক্ত হয়েছে এই তালিকায়। অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারস সূত্রে জানা যায়, সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে নিহত হয়েছেন ১৪৬৬ জন বেসামরিক নাগরিক। এছাড়া তদন্ত কেন্দ্রগুলোতে অমানুষিক নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ২০০ জনের। মানবাধিকার সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, আন্দোলন চলাকালীন অন্তত ৮৫ জন তরুণকে ঘটনাস্থলে গুলি করে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী।

সেনা অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী ঘটনাচক্রে ধ্বসে পড়েছে মিয়ানমারের অর্থনীতি। চাকরি ছেড়েছেন শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অসংখ্য পেশার লোক।

২০২১ সালে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উর্ধ্বগতি থাকবে বলে ধারণা করা হলেও, সেনা অভ্যুত্থান এবং মহামারির কারণে তা উল্টো ১৮ শতাংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

শুধু তাই নয়, ২০২২ সালের মধ্যে মিয়ানমারের শহরাঞ্চলে দারিদ্রতার হার তিন গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করছে ইউএনডিপি। গেল বছরের ডিসেম্বরে দেশটির ১২০০ পরিবারের উপর জরিপ করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনটি। প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটির এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল ব্যুরোর পরিচালক কান্নি উইংনাজারা বলেন, “এই হারে যদি দারিদ্রতা বাড়তে থাকে তাহলে মিয়ানমার থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে; যা অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা কোনো দেশের জন্য অশুভ সংকেত।

এদিকে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ এর মান কমে গেছে অর্ধেকেরও বেশি। ফলে দেশজুড়ে জ্বালানি ও রান্নার তেলের দাম বেড়েছে।

দেশজুড়ে চলমান সংকটের কারণে ব্যাংকের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না মিয়ানমারের নাগরিকরা। ফলে টাকার সংকটও দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে থাকছে না কোনো স্টক, ভোক্তারা টাকা তুলতে চাইলে আগে অনলাইনে টোকেন বা ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হচ্ছে। কিন্তু দুটি প্রক্রিয়াই সেখানে প্রায় অসম্ভব। তাই মিয়ানমারের বেশিরভাগ মানুষই এখন দালালের কাছে নিজের একাউন্ট থেকে টাকা ট্রান্সফার করে তারপর সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ কমিশন দিয়ে টাকা উঠাচ্ছেন।

২০১০ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসনের অবসানের পর দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান সেই উন্নয়নের গতিকে একেবারেই ধীর করে দিয়েছে।

মিয়ানমারভিত্তিক অর্থনীতিবিদ ইউ হেইন মং বলেন, “গত ১০ মাসের ঘটনাবলি মিয়ানমারের গত ১০ বছরের অর্জনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একই সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচও অনেক বেড়ে গিয়েছে। মাদক পাচার, অবৈধ কাঠের ব্যবসা এবং অর্থ পাচারসহ নানা বেআইনি ব্যবসার প্রসার ঘটেছে।”
তিনি জানান, বিদ্যুৎ বিল আদায়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ায় সামরিক সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ আগের সরকারের চাইতে এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।

তাছাড়া, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং স্কুলের মতো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোও চলছে না বললেই চলে। ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মতো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলোতে সামরিক সরকারকে পুরোপুরি সরকারি তহবিলের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

কিন্তু তবুও, মিয়ানমারের যা পরিস্থিতি তাতে সকল মন্দার সাথে মানিয়ে নিয়ে সেনাবাহিনীই বরং জনগণের চাইতে ভালো অবস্থানে আছে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ মং বলেন, “সেনাবাহিনীর নিজস্ব ব্যবসা এবং ব্যাংক আছে। সবকিছু ভেঙ্গে পড়লেও তারা টিকে থাকতে পারবে। আর তাদের বন্দুক-গুলি তো আছেই।”

সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন