ব্রিটিশ পত্রিকায় রোহিঙ্গা গনহত্যার ভয়াবহ বর্ননা

অলিভার হলমেস কক্সবাজার থেকে:

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্ণনায় তুলাতলির গণহত্যা

গ্রামের পাশের খরস্রোতা নদীতেই তুলাতলি গ্রামের বাসিন্দাদের সমাধি রচিত হয়েছে। সাপের মতো গ্রামটিকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে নদীটি। বর্মি সৈন্যরা গ্রামবাসীকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে নদীর তীরে। অনেককে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, বাকিরা পালাতে গিয়ে ভেসে গেছে স্রোতের টানে।

নদীর অন্য পাড়ে ছোট্ট একটি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে সেই ভয়াবহতা দেখেছেন জহির আহমেদ। দেখেছেন আরো অনেক গ্রামবাসীর সাথে নিজের পরিবারের সদস্যদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের একটি উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেয়া জহির সেই ভয়াবহতার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘পানির খুব কাছেই ছিলাম আমি’। তার চোখ ছিল রক্তলাল, গায়ে ঘাম ও কাদায় মাখা জামা।

সাক্ষাৎকারে জহির জানান, তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের রাইফেলের গুলিতে মেরে ফেলা হয়, শিশু ও নবজাতকদের ছুড়ে ফেলা হয় পানিতে যাদের মধ্যে তার ছয় মাস বয়সী কন্যা হাসিনাও ছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আঙ্গুল গুনে গুনে স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের নিহত সদস্যদের নাম বলতে থাকেন জহির। দুই হাতের আঙ্গুল শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শেষ হয় না নাম।

সেনাবাহিনীর ভয়াবহতার আরেক সাক্ষী খালেদ হোসেন। ২৯ বছর বয়সী এই দিনমজুর জানান, হত্যাকাণ্ডের তিন দিন আগে অন্তত ৯০ জন সেনা গ্রামে এসে বাসিন্দাদের পূর্ব দিকের একটি এলাকায় জড়ো হতে নির্দেশ দেয়। খালেদ বলেন, ‘তাদের প্রধান ছিল দুই তারকাবিশিষ্ট কর্মকর্তা।

সে আমাদের বলে, সেনাবাহিনী লোকজনকে হত্যা করছে এমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে গ্রামে। কিন্তু তোমাদের কৃষিকাজ ও মাছ ধরা অব্যাহত রাখা উচিত। সৈন্যদের দেখলে তোমরা দৌড়াবে না, দৌড়ালেই আমরা গুলি করব। এ কথার পর তারা স্থানীয় বৌদ্ধদের সাথে নিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে যায়।

ঘরগুলো থেকে স্বর্ণ, টাকা, কাপড়, চাল, আলুসহ যা কিছু পেয়েছে সব নিয়ে যায়। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে কয়েকটি ঘর গুড়িয়ে দেয় তারা। যোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে সেনারা, কিন্তু কাউকেই পায়নি’।

পিতম আলী নামে গ্রামের এক চাল ব্যবসায়ী জানান, অভিযানের একদিন আগে জীবন বাঁচাতে দুয়ালতলি নামের একটি গ্রামের একদল লোক নদী পাড়ি দেয়। এ সময় ১০ জনেরও বেশি নদীতে ডুবে মারা গেছে। ওই গ্রাম থেকে আসা কয়েকজনকে আশ্রয় দিয়েছেন পিতম আলী, যারা তাকে জানিয়েছে নদীর ওপাড়ে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কথা।

পরদিন রাত সাড়ে ৩টার দিকে আলী প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনতে পান, তবে কোন দিক থেকে শব্দ আসছে তা নিশ্চিত হতে পারেননি। সে দিনও তাদের গ্রামে আসে সেনারা। আলী বলেন, ‘আমি গ্রামের উত্তর দিকে বসবাস করতাম, আরো উত্তর দিক দিয়ে সেনারা নদী পার হয়ে সামনে অগ্রসর হয়।

আমি আমার পরিবার নিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে সেনাদের দেখতে পাই। সকাল ৮টা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি, তারপর তারা সেখান থেকে চলে যায়।’ আলী জানান, জঙ্গল থেকেই দেখতে পান যে তাদের বড় কাঠের ঘরটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

মিয়ানমারের ১১ লাখ জাতিগত রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুর মধ্যে এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সাথে নিয়ে এসেছে পরিকল্পিতভাবে জাতিগত নির্মূলের দুঃসহ স্মৃতি।

তুলাতলি গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা এক ডজনের বেশি রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান, যাতে পাওয়া গেছে ৩০ আগস্ট গ্রামটিতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর বর্বরতা ও বহু লোককে হত্যার অভিযোগ।

যারা পশ্চিম দিকের পাহাড়ে পালিয়ে গেছে তারা তিন দিনের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশের সীমান্তে। বাকিদের গণকবর দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রামটির বাসিন্দারা।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ পুরো অঞ্চলটিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার ফলে গার্ডিয়ানের পক্ষে স্বাধীনভাবে হতাহতের সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

তবে বেশির ভাগ লোকেরই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে পৃথকভাবে। দুই দিন ধরে নেয়া এসব সাক্ষাৎকারে তাদের দেয়া তথ্যে মিল পাওয়া গেছে।

গত ২৫ আগস্ট (সেনা ক্যাম্পে) একটি রোহিঙ্গা মিলিশিয়া গ্রুপের গেরিলা-স্টাইলে হামলার প্রতিশোধ নিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের পুরো উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক অভিযান শুরু করে।

অবশ্য তুলাতলির মতো এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড রাখাইন রাজ্যে নতুন নয়, এর আগেও অনেক রোহিঙ্গা দেশ ছেড়েছে।

২০১২ সালে বৌদ্ধদের সাথে দাঙ্গায় এক লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। যাদের অনেকেই হয় সাগরে ডুবে নয়তো জঙ্গলে মানব পাচারকারীদের ক্যাম্পে অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছে।

তারপরও অঞ্চলটিতে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সাথে কী ঘটেছে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে চলতি বছর প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের এক রিপোর্টে।

রিপোর্টটিতে সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও গণধর্ষণকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এবারের নারকীয়তা ছাড়িয়ে গেছে আগের সবগুলোকে।

এবারের অভিযানটি মিয়ানমারকে রোহিঙ্গামুক্ত করার চূড়ান্ত অভিযান বলে সতর্ক করে দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা গেছে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সঙ্ঘাতময় এলাকাটিতে জাতিসঙ্ঘের সব ধরনের ত্রাণকার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

অং সান সু চির প্রশাসন এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তারা এই সেনা অভিযানকে ‘উগ্রবাদী সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে দাবি করছে এবং বলছে উগ্রবাদীরা নিজেরাই গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গা মিলিশিয়া কর্তৃক রাখাইনের হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার কথাও বলা হচ্ছে। প্রায় ২৬ হাজার অমুসলিম এসব সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা তুলাতলির নিরীহ মানুষ বলছে, তারা ধান, মরিচ ইত্যাদি চাষ করে জীবন পাড় করেছে। সেনা অভিযানের সময় কিংবা (আগেপরে কখনোই) তাদের গ্রামে কোনো মিলিশিয়া ছিল না।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর আহমেদ বায়েজীদ/ আরটিএনএন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন