মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমা দ্বিচারিতা

fec-image

ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা কি আফগান/ইরাকি/সিরিয়ান/ইয়েমেনি শরণার্থীদের চেয়ে বেশি সহানুভূতির দাবিদার? পশ্চিমা মিডিয়া এবং পুরো ইউরোপ বলছে, হ্যাঁ! ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পরিবার নিজস্ব গাড়ি বোঝাই খাবার ও পানীয় নিয়ে হাজির হচ্ছেন ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য! খোলা হয়েছে লঙ্গরখানা, মেডিক্যাল ক্যাম্প, টানানো হয়েছে তাবু, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে দোভাষী! গত কয়েক দশক ধরে লক্ষ লক্ষ অশ্বেতাঙ্গ শরণার্থী ইউরোপীয় দেশগুলোর সীমান্তে ভিড় করলেও দেখা গেছে ঠিক এর মারাত্মক উল্টো চিত্র। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া, বল প্রয়োগ ও গ্রেফতার এবং জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো, আশ্রয় ও খাবারের অভাবে শীত এবং ক্ষুধায় শরণার্থীদের মৃত্যু, ঝুঁকিপূর্ণভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে আশ্রয় প্রার্থী শরণার্থী মৃত্যুর দৃশ্য ইউরোপীয় সীমান্তে একটি অতীব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে! ২০১৫ সালে সাগর পাড়ে সিরিয়ান কুর্দি শিশু আলান কুর্দির নিথর দেহ পুরো বিশ্বকে নাড়া দিলেও পাষণ্ড নাক উঁচু শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের মনকে নাড়া দেয়নি এতটুকুও! পশ্চিমাদেরই সৃষ্ট তথাকথিত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সম্পাদনের স্বাধীনতা সংরক্ষণের নিয়ম মোতাবেক রাশিয়ান লৌহমানব ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের সাথে সাথেই সেটা উন্মোচিত হয়েছে অত্যন্ত নগ্নভাবে।

আমেরিকান টিভি চ্যানেল এনবিসি’র একজন সঞ্চালক ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে থাকা তাদের প্রতিনিধির কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, পোল্যান্ড ২০১৫ সালে শরণার্থী গ্রহণে একান্ত অনিচ্ছুক ছিল, সেখানে কেন এখন এই ভিন্ন পরিস্থিতি? প্রতিবেদক কোনো প্রকার ভনিতা না করেই বলেন, ‘ইউক্রেনীয়রা সিরিয়ান শরণার্থীদের মতো নন, তারা খ্রিষ্টান, তাঁরা শ্বেতাঙ্গ এবং তাঁরা পোলিশদের ন্যায় একই ধরনের মানুষ!’ সবচেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে যুদ্ধ আক্রান্ত ইউক্রেনীয়দের মধ্যে এমন সংকটকালীন সময়েও বর্ণবাদের কোনো কমতি নেই! নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের স্বঘোষিত মানদন্ড বিবিসিকে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে ইউক্রেনের সাবেক ডেপুটি চিফ প্রসিকিউটর ডেভিড সাকভেরেলিডজে বলেন, ‘আমার জন্য এটা খুবই মর্মান্তিক, কারণ আমি দেখছি, নীল চোখের এবং স্বর্ণকেশী ইউরোপীয়দের হত্যা করা হচ্ছে!’ অর্থাৎ তার দৃষ্টিতে কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়দের হত্যা বড় কোনো সমস্যা না এবং শ্বেতাঙ্গদের জীবনের মূল্য তাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি! ইরাকি, আফগান, সিরীয়, ফিলিস্তিনি, আফ্রিকান, ইয়েমেনিদের হত্যা যথার্থ! এরকম চরম বর্ণবাদী মন্তব্যে বিবিসি সঞ্চালক কোনো প্রকার আপত্তি না করে উল্টো বলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি এবং আপনার আবেগকে সম্মান করি!’

মুসলিমবিরোধী এমন মিডিয়া আগ্রাসনে পিছিয়ে থাকবে কেন ইউরোপের অন্যতম মুসলিম বিদ্বেষী দেশ অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স? ফ্রান্সের বিএফএম টিভি সাংবাদিক ফিলিপ কোরবি বলেন, ‘আমরা এখানে পুতিন সমর্থিত সিরিয়ান এক নায়ক কর্তৃক বোমাবর্ষণের শিকার সিরিয়ানদের নিয়ে কথা বলছি না। আমরা কথা বলছি, গাড়িতে করে পলায়নপর ইউরোপীয়দের নিয়ে, যেগুলো দেখতে আমাদের গাড়ির মতো। কোরবি’র ভাষ্য মোতাবেক এমনকি পালিয়ে আসার বাহনও নির্ধারণ করে দেয় কে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য এবং কে যোগ্য না! আরেক ইউরোপীয় মিডিয়া আইটিবি’র একজন সাংবাদিক পোল্যান্ড হতে প্রতিবেদন করার সময় বলেন, ‘এখন অকল্পনীয় বিষয়গুলো তাদের (ইউক্রেনীয়) সাথে ঘটছে। এটা উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের কোনো জাতি নয়, এটা ইউরোপ! যুদ্ধ যেহেতু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য সাধারণ ও নৈমিত্তিক ঘটনা।’ অথচ, বাস্তবতা হলো, তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি যুদ্ধের জন্য দায়ী পশ্চিমারা, হয়তো পশ্চিমারা একতরফাভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে শোষণ করছে, না হয় অস্ত্র-গোপন মদদ দিয়ে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে রেখে যুগের পর যুগ ধরে শোষণ করছে (বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলো)। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের উৎপত্তি ও মূল কেন্দ্রস্থল ইউরোপ। অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার বলেন, ‘অবশ্যই আমরা শরণার্থী (ইউক্রেনীয়) গ্রহণ করবো, যদি প্রয়োজন হয়। আমরা প্রতিবেশীকে সাহায্য করা নিয়ে কথা বলছি।’ অথচ, এই কট্টরপন্থী নেহামারই আফগান শরণার্থীদের প্রবেশের চরম বিরোধিতা এবং প্রয়োজনে জোরপূর্বক তালেবানদের নিকট হস্তান্তর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও গেম চেঞ্জার টার্কিশ ড্রোন

টেলিগ্রাফ সাংবাদিক ড্যানিয়েল হান্নান এক কলামে লিখেন, ‘মনে হচ্ছে, তারা আমাদের মতো, যা এটাকে আরো বেশি দুঃখজনক করে তুলেছে। ইউক্রেন একটি ইউরোপীয় দেশ, এর জনগণ নেটফ্লিক্স দেখে ও তাদের ইন্সটাগ্রাম একাউন্ট আছে, অবাধে ভোট দেয় এবং মুক্ত খবরের কাগজ পড়ে।’ হান্নানের মতে, নেটফ্লিক্স দেখা ও ইন্সটাগ্রাম একাউন্টও শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানের মাপকাঠি! ইউক্রেনের কিয়েভ হতে কানাডার সিবিএস নিউজ সাংবাদিক চারলি ডি’আগাটা লাইভ কভারেজে বলেন, ‘আমরা ইরাক বা আফগানিস্তান নিয়ে কথা বলছি না, যেখানে দশকের পর দশক ধরে সংঘর্ষ চলমান। ইউক্রেন অপেক্ষাকৃত সভ্য এবং ইউরোপীয় দেশ।’ তথাকথিত অন্যতম সভ্য দেশের সিনিয়র সাংবাদিকরা যুদ্ধের ময়দান হতে প্রতিবেদনকালে কেমন করে বলতে পারেন এমন কথা?

আমেরিকা ও ইউরোপের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের ফলে উদ্বাস্তু এশীয় এবং আফ্রিকানদের বলা হয় সন্ত্রাসী ও ইউরোপ দখলের জন্য আগমনকারী, জীবনবাজি রেখে সাগরে পাড়ি দিতে গিয়ে যাদের অধিকাংশের হয়তো সলিল সমাধি ঘটে, না হয় কোনো মতে জীবন নিয়ে ইউরোপীয় তীরে ওঠতে পারলে ঠাঁয় হয় ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাহীন বদ্ধ ক্যাম্পে-খাঁচায় বা কারাগারে। ইউরোপীয় সভ্য দেশ যুক্তরাজ্যের মতো দেশে স্কুলগামী শরণার্থী শিশুদের জন্য বর্ণবাদী গালি ও শারীরিক লাঞ্চনা যেন নৈমিত্তিক ঘটনা! সভ্য দেশ হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় তাদের জন্য কি মানবাধিকারের সংজ্ঞা এক না?

যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউক্রেন হতে পলায়নপর এশীয় ও আফ্রিকান ছাত্রদের জিম্মি করে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী, রাশিয়া কর্তৃক একাধিকবার অসামরিক লোকজন সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও ইউক্রেনীয় আর্মি সহজে কাউকে শহর ত্যাগ করতে দিচ্ছে না, এটা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় কোনো সাড়াশব্দ পর্যন্ত নেই। জীবন বাজি রেখে কোনভাবে সীমান্তে পৌঁছেও নিস্তার নেই বাদামি চামড়ার এশীয় ও কালো চামড়ার আফ্রিকানদের, মুখোমুখি হতে হচ্ছে সেই চিরাচরিত উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের। আলাদা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে সকল অশ্বেতাঙ্গদের এবং সহজে সীমান্ত অতিক্রম করতে দেওয়া হচ্ছে না তাদের। করা হচ্ছে মারধর, দেশে ফিরতে সীমান্তে ভিড় করা ভারতীয় এক ছাত্রকে তো ক্যামেরার সামনেই লাথি মেরেছে ইউক্রেনীয় বর্ডার পুলিশের এক অফিসার! নাইজেরিয়া সরকার কর্তৃক তাদের ছাত্রদের সাথে বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানানো এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ হতে বারংবার সমন্বয় সাধনের পরও নন ইউরোপীয় নাগরিক প্রত্যাহারে আশানুরূপ গতি আসেনি এক মুহূর্তের জন্যও। আফ্রিকান ছাত্রদের ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়ে বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কিরিল পেতকভ বলেন, ‘আমরা তাদের পরিচয় ও অজানা অতীত সম্পর্কে জানি না, হতে পারে তারা সন্ত্রাসী!’ মুসলিম শরণার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে দুনিয়াজুড়ে চরম বিতর্কের মধ্যেই স্পেনের পার্লামেন্টে ডানপন্থী ভক্স দলীয় নেতার প্রচন্ড মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যেকে মুহুর্মুহু তালি দিয়ে অধিবেশনে উপস্থিত সবাই স্বাগত জানায়! এ কেমন নিষ্ঠুর গণতন্ত্র ও মানবিকতা?

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পশ্চিমাদের হীনমন্যতা ও দ্বিচারিতার এক জঘন্য বাস্তব প্রমাণও সবার সামনে পুনরায় উপস্থাপিত হচ্ছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কোনো প্রকার প্রশংসা ও নাৎসি সালাম পশ্চিমা বিশ্বে নিষিদ্ধ, ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যা দাবির সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা বা এ নিয়ে গবেষণা বা প্রকৃত নিহতের সংখ্যা জানার চেষ্টা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! এর ব্যত্যকারীর বিরুদ্ধে নেওয়া হয় কঠোর ব্যবস্থা, বহু স্বনামধন্য ক্রীড়াবিদ ও সেলিব্রিটিকে সাফল্য উদযাপন করতে গিয়ে মনের অজান্তেই নাৎসি সালাম দিয়ে পড়তে হয়েছে মারাত্মক সব বিড়ম্বনায়। পশ্চিমারা এখন ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসবে ব্যস্ত থাকলেও এটা চন্দ্র-সূযের ন্যায় পরিষ্কার যে, হিটলার মূলত পরাজিত হয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা হালের রাশিয়ার নিকট এবং বার্লিনে পৌঁছে নাৎসি পতাকা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সোভিয়েত সেনারা। আজও সেই শোকে কাতর নব্য নাৎসিদের দ্বারা গঠিত ‘আজব ব্যাটালিয়ন’ যখন ২০১৪ সালে নৃশংসভাবে হাজার হাজার রুশভাষীদের হত্যা করলো তাদেরকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান না করে বরং অন্তর্ভুক্ত করা হলো ইউক্রেন ন্যাশনাল গার্ডে! নব্য নাৎসি ‘আজব ব্যাটালিয়ন’র লোগো ও পতাকা হিটলারের অন্যতম এলিট বাহিনী দ্বিতীয় এসএস পাঞ্জার ডিভিশনের অনুরূপ এবং কর্মকাণ্ড হিটলারের বাহিনীর চেয়েও বহুগুণ নৃশংস। কী অবাক কান্ড! এই নব্য নাৎসিদের নিয়ে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইহুদিবাদীদের কোনো সমস্যা নেই, রুশভাষী ইউক্রেনীয়দের নির্বিচারে হত্যার জন্য উল্টো তাদের দেওয়া হয়েছে কল্পনাতীত অর্থ সহায়তা, অত্যাধুনিক সব অস্ত্র এবং উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণ।

অলৌকিক কিছু না ঘটলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের টিকে থাকা বা জয় পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, এটা সবারই জানা। ইউক্রেনীয়দের এই চরম দুর্দশার মাঝখানেও নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও হীন উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যস্ত একমাত্র নন-পশ্চিমা দেশ হচ্ছে ইজরাইল। ইউক্রেনের বর্তমান সরকারের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেস্কি রেজনিকভ-সহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ইহুদি, এটা এখন সবার জানা হলেও হয়তো অনেকেরই জানা নেই যে ইজরাইলের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেইর ছিলেন একজন ইউক্রেনীয় ইহুদি। ইজরাইলের বর্তমান জেরুজালেম বিষয়ক (মূলত অবৈধভাবে পুরো জেরুজালেমে ইজরাইলের দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকরণ) এবং গৃহনির্মাণ বিষয়ক (মূলত অবৈধ বসতি স্থাপন) মন্ত্রী জীভ ইলকিন একজন ইউক্রেনীয় ইহুদি, যার আপন ভাই যুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইউক্রেনের খারকিভ নগরীর বাসিন্দা (যুদ্ধের শুরুর পর হয়তো গোপনে ইজরাইল বা কোন ইউরোপীয় দেশে পালিয়ে গেছেন, যা এখনো নিশ্চিত না)। ফিলিস্তিনি ভূমিতে অবৈধভাবে বসবাসকারী স্যাটেলার ইহুদিদের একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশ ইউক্রেনীয় বা ইউক্রেনীদের বংশধর। রাশিয়া সীমান্তে নব্য নাৎসির স্বর্গরাজ্য এবং একটি ইহুদি নিয়ন্ত্রিত বৃহৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্ল্যান ‘এ’ ব্যর্থ হতে দেখে ইহুদিবাদীরা বসে নেই, তারা প্ল্যান ‘বি’ হিসেবে ইউক্রেনের চার লক্ষ ইহুদির অধিকাংশকে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে পুনর্বাসিত করে দখলদারিত্ব আরো সুসংহত করার মিশনে নেমেছে। এটাই হলো ইজরাইলি প্রধানমন্ত্রী নাফাতালি বেনেট (যিনি নিজেও ফিলিস্তিনি ভূমিতে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের নেতা হিসেবে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন) এর মধ্যস্থতার নামে অতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপের মূল কারণ।

কোনো ফিলিস্তিনি দখলদারের লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারলেও হয় সন্ত্রাস, তাদের কেউ নৈতিক সমর্থন জানালে হয়ে যান সন্ত্রাসের সমর্থক, কিন্তু উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদে মত্ত যুদ্ধাসক্ত ভাড়াটে খুনিরা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র হাতে দলে দলে ইউক্রেনে এসে হয়ে যাচ্ছে প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং মানবতাবাদী! ফিলিস্তিনিদের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে ফিলিস্তিনিদের ভূমি ফেরত ও সমঅধিকার না দেওয়া পর্যন্ত ইজরাইলকে (রাষ্ট্র ইজরাইলকে, ইহুদি জাতিকে নয়, অসংখ্য উদারপন্থী ইহুদিও বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট এন্ড সেনশন সংক্ষেপে বিডিএস এর একনিষ্ঠ সমর্থক) বয়কটের আবেদন হয়ে যায় ইহুদি বিদ্বেষ, সমর্থনকারীকে ভোগ করতে হয় নানাবিধ হয়রানি ও নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের সাথে সাথেই রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্মরণকালের ভয়াবহ সব নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে রাশিয়ার সব ধনকুবের ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধেও! এ কেমন দু’চোখা মানবতা?

ইজরাইলি যুদ্ধাপরাধ তদন্তের দাবি তোলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারক ও কর্মকর্তাদের নিষিদ্ধ করার হুমকি দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রাশিয়ার বিচার করতে চায়! গত সাত দশকের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের রক্তের দাগ এখনো না শুকিয়ে যাওয়া মে ২০২১ এর গাজা গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্তকারীদের কোনভাবেই ইজরাইল ও গাজায় ঢুকতে দেওয়া হবে না ঘোষণা দেওয়া দেশটি এখন রাশিয়ার কথিত যুদ্ধাপরাধের আন্তর্জাতিক তদন্ত এবং বিচার চায়! মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক বিচার নিয়ে এ কেমন নৃশংস দু’মুখো রসিকতা? খোদ মার্কিন মিডিয়া ও সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির শুনানিতে প্রমাণিত হওয়া ইউক্রেনে প্রাণঘাতী গোপন ভাইরাস ও জৈব অস্ত্রের গবেষণায় অর্থায়ন এবং প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে কল্পিত ও সম্ভাব্য রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে অগ্রিম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চায়! মানবাধিকার ও মানবতার নামে পশ্চিমাদের নৃশংস রসিকতার যেন আর শেষ নাই!

পশ্চিমা বিদ্বেষ ছড়ানো অথবা পরিহার যোগ্য একটি যুদ্ধে সাধারণ ইউক্রেনীয়দের দুর্দশাকে যথার্থতা দান মোটেই মূল উদ্দেশ্য না। এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো, সবাইকে জানানো, হয়তো আমাদের দেশেও মানবাধিকার পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘুদের অবস্থার উন্নয়নের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে, কিন্তু পশ্চিমারা সহ বিশ্বের অন্য কোনো দেশ মানবাধিকার নিয়ে আমাদেরকে উপদেশ দেওয়ার যোগ্য না। উপনিবেশিক আমল হতে খুঁজতে গেলে পশ্চিমাদের বর্ণবাদ, শোষণ-নির্যাতনের উদাহরণ রয়েছে অগণিত, তবুও যদি একমাত্র উদাহরণ হিসেবে হালের স্বঘোষিত বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টিপাত করি, ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘন ও বর্ণবাদের এক করুণ চিত্র পাওয়া যায় এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও (বিশ্বব্যাপী গণহত্যা- যুুদ্ধাপরাধ ব্যতীত)!

বিবিসি’র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহতের সংখ্যা ১৪,৪১৪ জন এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ২৩,৯৪১ জন। পিউরিসার্চের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালে বন্দুকহামলায় নিহত, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আত্মহত্যায় নিহত হয়েছে মোট ১৯,৩৮৪ জন, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত ৬১১ জন (নিঃসন্দেহে সিংহভাগ কালো চামড়ার মানুষ), কোনো কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি, এমন বন্দুক হামলায় হতাহতের সংখ্যা ৪০০ জন। শুধুমাত্র কালো হওয়ায় জর্জ ফ্লইড’কে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের একজন পুলিশ শ্বেতাঙ্গ অফিসার, তথাকথিত কম সভ্য তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের কেউ না। হাঁটু গেড়ে বসে বর্ণবাদের প্রতিবাদ জানানো এবং কালোদের জীবনেরও মূল্য আছে (Black Lives Matter বা সংক্ষেপে BLM) আন্দোলনের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে, পশ্চিমা মিডিয়ার আবিষ্কৃত তথাকথিত কম সভ্য কোনো দেশে না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে প্রতি মুহূর্তের সংবাদ প্রচার করেছ ও পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং শ্বেতাঙ্গরা একে অন্যের সাহায্যে যেভাবে এগিয়ে এসেছে, এর অর্ধেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও হয়তো আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ বাস্তুচ্যুত প্রায় চার কোটি মুসলিমকে আজ এই মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো না।

স্বঘোষিত মানবাধিকারের ‘অধ্যাপক’ পশ্চিমা মিডিয়া এবং মানবাধিকারের রক্ষক পশ্চিমারা কখনো এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না, তারা সব সময় মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনাকে অনেক বড় বানিয়ে মানবাধিকারের উপদেশ দিতে আসবে (যার প্রকৃত লক্ষ্য হলো নিজেদের হীন স্বার্থ হাসিল করা) এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করবে, যেমনটা সুনির্দিষ্টভাবে করা হয়েছে লিবিয়ায় এবং চলছে সিরিয়ায়। মুক্তমত ও মানবাধিকারের স্বঘোষিত ধারক এবং বাহক পশ্চিমা মিডিয়ার মজ্জাগত এই হীন দ্বিচারিতা নিয়ে সংযুক্ত আরব-আমিরাতের শারজাহ’র শাসক পরিবারের রাজকন্যা শেখ হেন্দ বিনতে ফয়সাল আল কাসিমি যথার্থই টুইট করেছেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট ইউরোপীয়দের অমানবিক চেহারা উন্মোচিত করেছে। তাদের সিংহভাগ ইউক্রেনীয় ব্যতীত অন্যান্য শরণার্থীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। যাতে তাদের মানবাধিকারের ডুমুর পাতা ঝরে পড়েছে এবং সভ্য বিশ্ব আমাদের যে মানবাধিকারের উপদেশ দেয়, সেটা মিথ্যা।’ [তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, টুইটার]

লেখক: প্রতিরক্ষা বিষয়ক তথ্য সংগ্রাহক

লেখকের আরো লেখা পড়ুন:

বৃহৎ প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক শক্তির মাঝখানে যখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র

মেটাভার্স কী এবং মেটাভার্স বিশ্বে কী পরিবর্তন আনতে চলেছে

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইনসার্জেন্সি মোকাবিলায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন