রাঙামাটিতে অপহৃত টেলিটক কর্মীর জবানবন্দী: মৃত্যুর মুখে ১৮ দিন

Untitled-2

আশরাফ উল্লাহ, চট্টগ্রাম:

বছর আঠারোর আবদুল মজিদ। খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙার ছোট্ট তাইন্দং বাজারের এখন পরিচিত মুখ। বাজারে নেমে এক দোকানিকে মজিদের কথা জিজ্ঞেস করতেই ছোটখাটো জটলা বেধে গেল। কার আগে কে বাড়ি চিনিয়ে দেবে এই প্রতিযোগিতা চলল মিনিট খানেক। তারাই বাতলে দিল মজিদের বাড়ির পথ। কথা না বাড়িয়ে চেপে বসলাম মোটরসাইকেলে। এর মধ্যে সঙ্গী আলোকচিত্রী নীরব চৌধুরী মুঠোফোনে পেয়ে গেলেন মজিদকে। কিছু দূর এগোতেই তাঁর সঙ্গে দেখা। ছোটখাটো গড়ন।

kk

চোখমুখে দীর্ঘ ক্লান্তির ছাপ। মজিদ নিয়ে গেলেন তাঁদের বাড়িতে। পাকা দেয়ালের টিনের চালার ঘর। আশপাশে সেগুনগাছের বাগান আর জঙ্গল। অবশ্য অল্প দূরে কয়েকটা বাড়ি রয়েছে। ঢুকেই চোখে পড়ল একদল কিশোর বসে আছে বসার ঘরে। তারা সবাই প্রতিবেশী। মজিদকে ঘিরেই এখন তাদের দিন কাটছে। মজিদও সময়টা বেশ উপভোগ করছেন। কারণ, এই সঙ্গ আর কখনো পাবেন কি না তা নিয়ে ছিল ঘোর সন্দেহ। প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারাটা তাঁর কাছে এখনো বিস্ময়। রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে রাষ্ট্রয়াত্ত মুঠোফোন সেবাদাতা টেলিটকের কারিগরি সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বি-টেকনোলজির চার কর্মকর্তার সঙ্গে অপহূত হন খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মজিদও। ১৮ দিন কেটেছে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি।

জঙ্গলে অমঙ্গল
দিনটি ছিল ৮ জুলাই। মজিদের বন্ধু বি-টেকনোলজির টেকনিশিয়ান সুজা মিয়া বললেন, ‘অফিসের কাজে মারিশ্যার বারিবিন্দুঘাট যাচ্ছি। আমার সঙ্গে যাবে?’  সঙ্গে সঙ্গে রাজি মজিদ। নতুন জায়গায় ঘোরার নেশা তাঁর। তাই বন্ধুর কথা ফেলতে পারলেন না। আগে থেকে সেখানে অবস্থান করছিলেন প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জামান, টেকনিশিয়ান হেমায়েত হোসেন ও ইমরুল হোসেন। সেখানে একটি টাওয়ারে ত্রুটি সারাতে গিয়েছিলেন তাঁরা। টাওয়ারের জন্য তার  (কেব্ল) নিয়ে যান সুজা ও মজিদ।  দুপুর দুইটার দিকে হঠাৎ চার-পাঁচজন অস্ত্রধারীর আগমন। এসেই ঢাকা থেকে কারা এসেছে তাদের খুঁজল অস্ত্রধারীরা। আখতার, ইমরুল ও হেমায়েত পালানোরও সুযোগ পেলেন না। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো কাচালং নদীর ওপারে। অনেকটা বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সুজা আর মজিদ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার হাজির অস্ত্রধারীরা। এবার সুজা ও মজিদকেও নিয়ে যাওয়া হলো নদীর ওপারে। সেখানে দেখা হলো অন্য তিনজনের সঙ্গে। এরপর গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ওঠানো হলো মোটরসাইকেলে। কেড়ে নেওয়া হলো তাঁদের মুঠোফোন। Untitled-3

প্রকৌশলী আখতার বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা।’ কিন্তু কোনো উত্তর এল না।বাকিটা শুনুন মজিদের মুখেই, ‘মোটরসাইকেল প্রায় ৩৫-৪০ মিনিট চলার পর থামল। খুলে দেওয়া হলো চোখের বাঁধন। দেখি চারদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। এরপর আবার হাঁটা শুরু। চোখ বাঁধা। তিন-চার ঘণ্টা হাঁটার পর একটি পাহাড়ে কুঁড়েঘরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানেই কাটল প্রথম রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাহারায় থাকা ছয়-সাতজন ছাড়া আশপাশে কোনো কাকপক্ষীরও আনাগোনা নেই। অজানা আশঙ্কায় ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে বুক। সকাল হতেই আবার চোখ বেঁধে হাঁটা শুরু। এবার পাহারাদারের বদল। এভাবে প্রতিদিন বদল হয়েছে স্থান ও পাহারাদার। প্রথম দিনের পর আর ঘরের দেখা মেলেনি। জঙ্গলেই কেটেছে দিন-রাত। বিছানা বলতে ত্রিপল। মাথার ওপর পলিথিনের ছাউনি। ব্যস, এতটুকুই। এক জায়গায় এক রাতের বেশি থাকা হয়নি। যেখানেই যেতাম সব একই রকম মনে হতো। কোনো কিছু বোঝার উপায় নেই।’ একটানা বলার পর দম নিলেন মজিদ। কিছুক্ষণ মুখে কথা নেই।  তারপর আবার শুরু করলেন, ‘আমরা যে বেঁচে ফিরব সেই আশা ছিল না। আল্লাহর রহমত ছিল বলে হয়তো সব ঠিকঠাকমতো হয়ে মায়ের কাছে ফিরতে পেরেছি। মনে হচ্ছিল, যেকোনো সময় ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।’এই ১৮ দিন তাঁদের খাবার জুটেছে দিনে দুই বেলা—সকাল ১০-১১টা আর বিকেল চারটায়। ডাল, জুম চালের ভাত ও সবজি। প্রথম কয়েক দিন তো শুধু বাঁশকোড়ল (কচি বাঁশের ডগা) দিয়ে ভাত দিয়েছে। সে সময় লবণ দিয়ে কোনো রকমে ভাত খেতে হয়েছে। পরে বলার পর অবশ্য ডালের ব্যবস্থা করে। খাওয়ার পানি আনা হয়েছে আশপাশের পাহাড়ি ছড়া থেকে।

জঙ্গলে জিম্মি

অপহরণের কয়েক দিনের মাথায় বি-টেকনোলজির প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয় অপহরণকারীদের। কয়েক দফা আলোচনা চলে। কিন্তু বিপত্তি বাধল মুক্তিপণের টাকা যখন ৪০ লাখ থেকে এক লাফে তিন কোটি টাকায় ঠেকল। আলোচনা আর এগোল না। ভেস্তে গেল সব। ছাড়া পাবেন বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন সবাই, তাতে বিষাদের কালো ছায়া পড়ল। পাহারায় থাকা একজন জানালেন, আর ফেরা হচ্ছে না ওদের। কোম্পানি টাকা দিচ্ছে না। তাঁরাও প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলেন আর ফেরা হবে না তাঁদের।

মুষড়ে পড়লেন সবাই। সুজা আর মজিদ ছাড়া অন্যদের স্ত্রী-ছেলেমেয়ে আছে। পরিবারের কথা ভাবতেই কান্না পাচ্ছিল মজিদের। বললেন, ‘বারবার মনে পড়ছিল বাবা-মা ও ভাইবোনদের কথা। বাবা কৃষিকাজ করে শতকষ্টে আমাকে লেখাপড়ার জন্য খাগড়াছড়ি পাঠিয়েছে। একদিন পরিবারের হাল ধরব। মায়ের মুখটাও বুঝি আর দেখতে পারব না। ছোট ভাই সাইফুলের (৪) কথা বেশি মনে পড়েছিল। বড় আদরের ছোট ভাইটি আমার। খাগড়াছড়ি থেকে বাড়িতে এলে সব সময় আমার পিছু পিছু থাকে। সেই ভাইটিকে আর আদর করতে পারব না!’

হেডলাইটের আলো

২৫ জুলাই সন্ধ্যা। বলা হলো, ওঠো সবাই। আবার হাঁটা শুরু। পেছনে অস্ত্রধারী পাহারাদারেরা। সবাই ভাবলেন প্রতিদিনের মতো স্থান বদল হবে। তবে আজ আর চোখ বাঁধা নেই। এভাবে প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটার পর রাস্তার দেখা মিলল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল সবার। পাহারাদারদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। একটু এগোতেই চোখে পড়ল অল্প দূরে গাড়ির হেডলাইটের আলো। হাঁটায় আরও জোর লাগালেন। পেছনে অস্ত্রধারীরা আছে কি নেই, সেই হুঁশ নেই কারও। একটাই চিন্তা, গাড়ির কাছে পৌঁছানো। পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেলেন সবাই। দেখলেন দুটি গাড়ি—একটি পাজেরো, আরেকটি পিকআপ। পাজেরো গাড়িতে বসা কয়েকজন লোক। পরে জানলেন তাঁরা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা।

পাজেরো গাড়ি থেকে একজন নেমে বললেন, ‘তোমরা কারা?’ মজিদরা নাম বললেন। এরপর মজিদদের ওঠানো হলো পিকআপে। এদিকে পেছনের অস্ত্রধারীরা কখন সরে গেছে টেরও পাননি তাঁরা। গাড়িতে বসার পর সবার চোখমুখে আনন্দের ঝিলিক। কারও মুখে কথা নেই। কিন্তু সবার চোখের ভাষা বোঝা যাচ্ছিল পরিষ্কার: ‘আমরা মুক্ত।’

পরে জেনেছেন সেই জায়গাটি ছিল দীঘিনালার মেরুং এলাকা।

বুকের ধন

ছেলে উদ্ধার হওয়ার খবর শুনেই মজিদের মা হনুফা বিবি আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে শুকরিয়া আদায় করেছেন। ছয় ভাইবোনের সবার বড় মজিদ। অপহূত হওয়ার খবর শোনার পর থেকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়েছিলেন মা। বুকের ধনকে পেয়ে এখন খুশিতে আটখানা হনুফা। এক মুহূর্তের জন্যও আড়াল হতে দেন না ছেলেকে। পাশের বাজারে গেলেও ফোন করেন দুই-তিনবার।

হনুফা বিবি বলেন, ‘বন্ধুবান্ধবের লগে আর কোনোখানে যাইতাম দিমু না। যেইখানে যাবে আমারে আগে বলবে, তারপর যাবে।’

মজিদের বাবা আবদুল খালেকও কৃতজ্ঞ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। তাদের বদৌলতে ছেলে জীবিত ঘরে ফিরে এসেছে। কীভাবে কী হলো তা নিয়ে আর বেশি ভাবার আগ্রহ নেই মজিদের। তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ‘আমি বেঁচে আছি।’

তাঁদের অন্য রকম ঈদ

Untitled-4

প্রকৌশলী আখতারুজ্জামানের (২৮) চার মাসের দাম্পত্য জীবন। বিয়ের পর প্রথম ঈদ। ঠিক করে রেখেছিলেন কার জন্য কী কিনবেন। কোথায় যাবেন সেই খসড়াও মোটামুটি করা ছিল। কিন্তু সবকিছুই যেন ওলটপালট হয়ে গেল এক ধাক্কায়। রোজার আগে মারিশ্যায় গিয়ে পড়লেন অপহরণকারীদের কবলে। খবর শুনে শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন স্ত্রী রিপা জামান (২২)। নির্ঘুম রাত্রিযাপন মা-বাবা, ভাইবোনদেরও। উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগে কাটল ১৮ দিন। অবশেষে প্রিয় সেই মানুষটি আবার ফিরল ঘরে। সেকি আনন্দ সবার! শ্বশুরবাড়িতে রিপার প্রথম ঈদটি যেন আরও আনন্দময় হলো।
ঢাকার বাসায় মহা ধুমধামে কেটেছে ঈদের দিনটি।

Untitled-5

আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ছোটবেলার ঈদের আনন্দ উপভোগ করেছি এবার। ঈদের আগে বাড়ি ফিরতে পারব, সে আশা ছিল না। বারবার মনে পড়ছিল পরিবারের সবার কথা। আমাকে পেয়ে তারা মহাখুশি। পরিবারের সবাইকে জামা-কাপড় কিনে দিয়েছি।’ গাইবান্ধার পূর্ব কোমরনই গোদারহাট গ্রামের সুজা মিয়ার (২১) ঘরে ঈদের দিন আত্মীয়স্বজনের মেলা বসেছিল। উদ্দেশ্য, সুজাকে একনজর দেখা। চাকরিতে ঢোকার তিন মাসের মাথায় মহা বিপদে পড়লেন সুজা। একেবারে প্রাণ নিয়ে টানাটানি। মা-বাবা আর ভাইবোনদের সঙ্গে যে ঈদ করতে পারবেন, ভাবতেই পারেননি। সুজা ফিরে আসার জন্য গ্রামের মানুষ দোয়া করেছেন। ‘মানত’ করেছেন আশপাশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। সবার একটাই চাওয়া, তিনি যেন ফিরে আসেন। অবশেষে ফিরলেন সুজা।সুজা বলেন, ‘২৯ জুলাই আমি গ্রামে আসি। সেদিন আমাকে দেখার জন্য হাজার খানেক মানুষ বাড়ির সামনে হাজির হয়েছিল। আত্মীয়স্বজনেরা ছুটে এলেন। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। তাই ঈদের আনন্দটাও অন্য বারের তুলনায় বেশি। সবার সঙ্গে ঈদ করতে পারব, ভাবিনি।’মাটিরাঙার তাইন্দংয়ে আবদুল মজিদের বাড়িতেও খুশির রোশনাই। ছোট ভাইবোনেরা বড় ভাইকে ঘিরে রেখেছে ঈদের দিনটি। মজিদও তাদের পরম মমতায় কাছে টেনে নিয়েছেন। বাবা টাকা দিলেও এবার নিজে গিয়ে ছোট ভাইবোনদের জন্য পোশাক কিনেছেন। মজিদ বলেন, এই আনন্দের সীমা নেই।ইমরুল হোসেন (২৬) ঘরে যাওয়ার পর থেকেই চার বছরের ইমা বাবার পিছু ছাড়ছে না। সারাক্ষণ বাবার সঙ্গেই কাটছে। ছাড়া পাওয়ার পর প্রথম যেদিন নড়াইল সদরে তারাপুরের গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন, সেদিন বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ছোট্ট ইমা বলল, ‘আর কখনো ঢাকা যাবে না। ঢাকা গেলে তোমাকে আবার ভূতে ধরবে।’ তার ধারণা, বাবাকে ভূত ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ইমরুল ২০০৭ সাল থেকে চাকরিজীবনে পার্বত্য এলাকায় কাজ করেছেন অনেকবার। বিপদে পড়লেন এবার।ইমরুল বলেন, ‘ঈদ তো দূরের কথা, আদৌ ফিরতে পারব কি না, এ নিয়ে ছিলাম সংশয়ে। ইমার জন্য মনটা খারাপ লাগত বেশি। পরিবারের সবাইকে কাছে পেয়ে ভুলে গেছি সেই কষ্টকর দিনগুলোর কথা।’হেমায়েত হোসেনও (২৫) বাড়ি ফেরার পর অভূতপূর্ব দৃশ্য। স্বামীকে পেয়ে স্ত্রী শেফালী বেগম আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন। ছেলেকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা মা-বাবাও। তাই ঈদের দিন নড়াইলের কালিয়া থানার মহিষখোলা গ্রামের বাড়িতে বসেছিল চাঁদের হাট। আত্মীয়স্বজনেরা মুঠোফোনে খবর নিয়েছেন।মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে নতুন জীবনের প্রথম ঈদ। সবকিছুই এত্ত ভালো লাগছে, বলে বোঝাতে পারব না।’ বলছিলেন হেমায়েত।

কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন