রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সমর্থন অব্যাহত থাকবে

fec-image

রোহিঙ্গা সংকট সমাধান দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে তা নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়িয়ে চলছে। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান, রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও সম্মানজনকভাবে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে দ্রুত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, টেকসই এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো আগ্রহ এবং সক্রিয় সমর্থন আশা করেন।

সম্প্রতি মিয়ানমার পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ চলমান রয়েছে। মিয়ানমার সরকার রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বলে জানিয়েছে এবং তারা বর্ষার আগে মে মাসের প্রথম দিকে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে আগ্রহী। কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে চীনের চলমান প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে মিয়ানমার এ উদ্যোগ নিয়েছে।

গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ এর নেতৃত্বে ১৭ সদস্যর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসে এবং ৪২৯ রোহিঙ্গার সাক্ষাতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই শেষে ২২ মার্চ মিয়ানমার ফিরে যায়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য ৭৫০টি প্লটের ওপর ১৫টি নতুন গ্রাম তৈরি করতে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেয়া রোহিঙ্গাদেরকে প্রথমে কয়েকটি ক্যাম্পে রেখে যাচাই করার পর তাদেরকে নতুন এই গ্রামগুলোতে পাঠানো হবে। এই পাইলট প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে মিয়ানমার জানিয়েছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে তাদের নিজ গ্রামে ফিরতে ইচ্ছুক। তাদেরকে নিজ গ্রামে ফিরে যেতে না দিলে তারা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। নাগরিক অধিকার, ভ্রমণ স্বাধীনতা কিংবা অন্যান্য জাতিসত্তার সমান অধিকারের নিশ্চয়তা পেলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে।

রোহিঙ্গা সমস্যাটি দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়। নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বেচ্ছামূলক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের পাশাপাশি নিজেদের অধিকার নিশ্চিত হওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের সেখানে ফিরে যেতে চায় না। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলা করে আসছে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে দ্রুত প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করে। এজন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।

২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল, এই দীর্ঘ সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়নি তাই এই সংকট মোকাবেলায় একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রনয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া গতিশীল ও টেকসই করতে মিয়ানমার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, মিয়ানমারের জনগণ, মিয়ানমার ও আরাকানের স্থানীয় রাজনৈতিক দল, বৌদ্ধ সংগঠনগুলো, সুশীলসমাজসহ সবার মনোভাব ইতিবাচক হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী, বৌদ্ধ ভিক্ষু সংগঠন, আরাকানের রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের সাথে ব্যবধান গুছিয়ে আন্তরিক পরিবেশ ও আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। মিয়ানমারের জনগণ বিশেষত রাখাইন প্রদেশের সাধারণ মানুষের মনোভাব পরিবর্তন ও রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, অভিবাসী রোহিঙ্গা সংগঠন, এন এল ডি ও আরাকান আর্মির প্রতিনিধির মাধ্যমে তা চলমান রাখতে হবে। মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ও জনগণের মাঝে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক আবেদন সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে।

রাখাইন প্রদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্কস্থাপন এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাঁদের মনোভাব সহনীয় করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, অভিবাসী রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ এবং রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে সক্রিয় গ্রুপগুলোকে এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এ আর এন এ এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা অন্যান্য সংগঠনগুলোকে মিলিতভাবে রাখাইনে প্রত্যাবাসন সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করার ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সংকট সমাধানে গৃহীত চলমান সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যেতে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দাতাসংস্থাগুলো ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মিয়ানমারের মূল জনস্রোতে মিশে যাওয়ার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। রাখাইন প্রদেশের অবকাঠামো ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে কর্ম সংস্থান ও মৌলিক সমস্যাগুলো উন্নয়নের জন্য কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভুমিকা নিতে হবে। আঞ্চলিক দেশগুলোকে এই সংকট সমাধানে মানবিক, রাজনৈতিক এবং আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে হবে। যে কোন পরিস্থিতিতে ত্রান ও আর্থিক সাহায্য চলমান রাখতে জরুরীভিত্তিতে আপতকালিন ব্যবস্থাগ্রহন ও রিজার্ভ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে।

মিয়ানমারে ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। চলমান সহিংসতায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থাগুলো মিয়ানমারে ত্রান কার্যক্রম চালাতে পারছেনা বিধায় রোহিঙ্গারা সেখানে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। এই ত্রান কার্যক্রম অবিলম্বে চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যার বাস্তবসম্মত ও স্থায়ী সমাধান।

প্রত্যাবাসন পরবর্তী রোহিঙ্গাদের বসবাসের জায়গা ও সেখানকার সুবিধাগুলো সম্পর্কে বর্তমানে তাদের কোন ধারণা না থাকায় অনেক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনিচ্ছুক হতে পারে। বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে তারা দীর্ঘদিন নিরাপদে আছে এবং ত্রান সহায়তা পাচ্ছে। মিয়ানমারে ফিরে তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে চায় না। এই সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা কক্সবাজার ক্যাম্পে এসে সরাসরি রোহিঙ্গাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারে।মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ প্রথম ব্যাচের রোহিঙ্গাদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে রাখাইনে নিয়ে গিয়ে প্রত্যাবাসনের জন্য নেয়া উদ্যোগ ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা দেখিয়ে আনতে পারে। এতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে উৎসাহ পাবে।

মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পর প্রথম একবছর বা প্রয়োজন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা চলমান রাখার জন্য মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র বা সংস্থাগুলো, মিয়ানমারে নিয়োজিত জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠনের প্রতিনিধি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উপস্থিতি রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আশা করা যায়। ইউএনএইচসিআর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনে অংশ নেয় সে জন্য তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে।

ইউএনএইচসিআর, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে। বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা অব্যাহত রাখবে ইউএনএইচসিআর। এই ধরনের উদ্যোগ ও পরিকল্পনা রোহিঙ্গাদের জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রত্যাবাসনের জন্য নেয়া চলমান উদ্যোগের সমালোচনা মোকাবেলা সহজ হবে। এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা গেলে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জন এবং স্বেচ্ছায় টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

রোহিঙ্গাদের টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে একটি বাস্তবায়ন উপযোগী রোড ম্যাপ প্রণয়ন দরকার যার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেলেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পর চলাফেরার স্বাধীনতা ও কাজের নিশ্চয়তা চায় রোহিঙ্গারা। কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন হবে, সেই সময় কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং অভাব কমে আসবে এর ফলে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তন হতে বাধ্য।

এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারে নেয়া উদ্যোগের বিষয়ে স্বচ্ছতা আসবে এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনে নেয়া যে কোন কার্যকরী পদক্ষেপে সমর্থন অব্যাহত রাখবে।

লেখক: এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন