রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতার পরিকল্পনা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছে সন্ত্রাসী গ্রুপ। এছাড়া বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর তৎপরতাও আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে । আর সীমান্তের সন্ত্রাসীদের এসব অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে ঐক্যমতে পৌঁছেছে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকার।
১ জুন বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টায় মিয়ানমারের মংডু শহর বিজিবি-বিজিপি রিজিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন -২০২২ অনুষ্ঠিত হয় । এতে এসব বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। সর্বশেষ সীমান্ত সম্মেলন ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হলেও বিগত ২ বছর ৭ মাস পর পুনরায় এই সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এতদিন পর হঠাৎ করে মিয়ানমারে দু’বাহিনীর বৈঠকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তাদের নিয়ে এ ধরনের বৈঠক নিয়ে
রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে বেশ আলোচিত হচ্ছে।
সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বুধবার রাতে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যানটাইট্স (এআরএসপিএইচ) প্রধান মুহিব উল্লাহ ও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি মসজিদে ঢুকে ৬ জন ছাত্র-শিক্ষককে হত্যার পরে ক্যাম্পে সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা বেশ জোরালো করে। আর্মড পুলিশ সদস্য ও র্যাব-পুলিশ বহুমুখী অভিযান পরিচালনা করে। গত ২ নভেম্বর-২০২১ সালে আরসা’র সেকেন্ড ইন কমান্ড হাসেম উল্লাহ’র গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
অন্যদিকে ১৬ জানুয়ারী মিয়ানমারের নিষিদ্ধ সশস্ত্র গ্রুপ আরসা’র প্রধান নেতা আতাউল্লাহ @ আবু আম্মার জুনুনীর ভাই মোশাহ আলী অস্ত্র এবং মাদক সহ ১৪ এপিবিএন পুলিশের হাতে আটক হয়। বিভিন্ন কারণে একে একে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলো নিস্তেজ হয়ে যায়।
অস্ত্র উদ্ধার, মাদক পাচারকারী আটক ও কথিত আরসা বা আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি সদস্যদের আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থাকা অনেকে গা ঢাকা দেয়। কেউ সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থান নিয়েছে। চলতি ২০২২ সালের প্রথম দিকে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনী পাহাড়ি এলাকায় তাদের ক্যাম্পে অবস্থান ও সুসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশ্য বক্তব্য দেওয়ার ছবি ও ভিডিও যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সুরক্ষা, সীমান্ত পাড়ের জনসাধারণ ও ক্যাম্পে বসবাসরত সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ বেড়ে যায়। সম্প্রতি একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়ে দৈনিক আজাদী টেকনাফ প্রতিনিধি’ হাতে পৌঁছে।
এতে আরসা সদস্য জনৈক ব্যক্তি মাস্টার আব্দুর রহিম নামের একজনকে বলতে শুনা যায়, কোরবানি ঈদের মধ্যে হামলা চালিয়ে জানান দিতে হবে। ক্যাম্পে যদি থাকতে হয় তাহলে যে কোন উপায়ে বাংলাদেশের কোন বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে অন্য একটা গ্রুপের নামে প্রচার করতে হবে। এ খবরটি আরসা সদস্যদের মাঝে জানিয়ে দিতে হবে এবং এ ধরনের কিছু না করলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা’র শক্তি বৃদ্ধি পাবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা নেতা জানান, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম জিরো পয়েন্ট বা নো ম্যান্সল্যান্ড অবস্থানরত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা মূল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। মিয়ানমারের কাটাতারের বাইরে আবার সীমান্ত খালের বাংলাদেশের ওপারে হওয়ায় সেখানে দু দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চালানো হয় না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরসা সদস্যরা কর্মকাণ্ড পরিচালিত করছে। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হারানো একচ্ছত্র আধিপত্য ফিরে পেতে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা আটছে এমন আশঙ্কায় কথা উড়িয়ে দেওয়ার মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ সংস্থার সভাপতি মাহাবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা, আরসা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলোর বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে।’
১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো, নাঈমুল হক জানান, ‘গত এক বছরে অপরাধের সাথে জড়িত কথিত আরসা সদস্য সহ ১ হাজার ৪৭৯ জন সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে।’
গত ১৯ এপ্রিল উখিয়া উপজেলার কোটবাজারস্থ সদর দপ্তরে এক বছর দায়িত্ব পালনের পূর্তি উপলক্ষে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি আরো বলেন ‘উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে এপিবিএন পুলিশ সাহসিকতার সহিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।’
এদিকে নাফনদী ও স্থল সীমান্তে বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ টহল, পিলার পরিদর্শন ও আন্তঃসন্ত্রাস দমনে আবারো তৎপরতা শুরু করার কথা জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি কর্মকর্তা কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজম-উস-সাকিব। তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের পক্ষে ও মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের পক্ষে মিয়নমার বর্ডার গার্ড পুলিশ স্টেশন কমান্ডার পুলিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিয়েট লুইন উপস্থিত থেকে একটি বৈঠক ১ জুন মিয়ানমারের মংডু শহরে অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে সীমান্তে সন্ত্রাস দমনে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপিস্থিত ছিলেন।
যদিও চুক্তির বিষয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেনি। তবে বিভিন্ন আলোচ্যসূচির বিষয়ে উভয় পক্ষ যৌথ স্বাক্ষর করেছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা। তিনি বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়ন সংবাদ সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন বিষয়টি পরিস্কার করেছেন।
মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের নেতা পুলিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিয়েট লুইন উক্ত বৈঠকে সীমান্ত এলাকায় দুষ্কৃতিকারী বা সন্ত্রাসীদের ক্যাম্প, আস্তানা অপসারণ , মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সন্ত্রাসী, দুষ্কৃতিকারীদের সংঘর্ষ বিষয়ে সহযোগিতা কামনা করেছেন।
বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ মোট ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজম-উস-সাকিব বলেন , কোন মিয়ানমার নাগরিক যেন অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ যেন করতে না পারে সে বিষয়ে বিজিপি কমান্ডারকে অনুরোধ করেন। সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ করিরোধ , আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস দমন ও দুষ্কৃতিকারীদের প্রতিহতকরণ , মিয়ানমার কর্তৃক সীমান্তে ইম্প্রোদার এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস ( আইইডি ) স্থাপন , মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়ায় বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি মিয়ানমার হতে অবৈধভাবে ইয়াবা , মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে পাচার নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি অবহিত করে । তাছাড়া মিয়ানমারে বিজিপিকে তাদের সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়টি আরও জোরদার অনুরোধ জানান ।
এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্থ করেন ।