রোহিঙ্গা গণহত্যা রোধে মিয়ানমারকে ব্যবস্থা নেবার নির্দেশ দিলো আইসিজে

fec-image

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অভ জাস্টিস রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর গণহত্যার মতো সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমারকে আদেশ দিয়েছে। এবং একই সাথে বিগত সহিংসতা প্রমাণ সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়াও রাখাইনে এখন যে রোহিঙ্গারা আছেন, তাদেরকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য মিয়ানমারকে সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিয়েছে নেদারল্যাডন্সের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে)।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় কিছুক্ষণ আগে ঘোষণা করা অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে এই আদেশ দেয়া হয়।

মিয়ানমারের সর্বোচ্চ নেতা অং সান সু চি তার দেশের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করলেও জাতিসংঘের এই সবোর্চ্চ আদালত রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যেকোন নিরাপত্তা বাহিনী যেন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোন গণহত্যায় না জড়ায়, উষ্কানি না দেয়, কিংবা নির্যাতনের মুসলমানদের চেষ্টা না করে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দেয়া হয়।

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেয়ার জন মিয়ানমারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলো আগামি চার মাসের মধ্যে একটি রিপোর্ট আকারে আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এরপর এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পর পর আদালতকে জানাতে হবে।

২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এই নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে গত বছরের ১১ নভেম্বর আইসিজেতে মামলা দায়ের করে আফ্রিকার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গাম্বিয়া।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে গত বছরের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর মামলার শুনানি চলে। ১০ ডিসেম্বর গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দল আদালতে গণহত্যার বিষয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করে।শুনানিতে গাম্বিয়ার পক্ষে মামলার প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির বিচারমন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদু।

পরদিন ১১ ডিসেম্বর মিয়ানমারের নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের সরকার প্রধান অং সান সু চি। সেখানে তিনি তার দেশের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

দ্য হেগ শহরে এই শুনানিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। ওই দলে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তিনজন প্রতিনিধিও ছিলেন।

বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ প্রশ্নে মি. তাম্বাদু বিবিসিকে বলছেন,
”’রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক বাসিন্দারা সংগঠিত হামলা চালাচ্ছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, মায়ের কোল থেকে শিশুদের ছিনিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে মারছে, পুরুষদের ধরে ধরে মেরে ফেলছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে এবং সবরকমের যৌন নির্যাতন করছে।”

একে ১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডা গণহত্যার সঙ্গে তুলনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘রোয়ান্ডায় টুটসিদের ওপর যেরকম অপরাধ করা হয়েছিল, এটা সেরকমই মনে হচ্ছিল। এখানে সেই একই রকম গণহত্যার সব বৈশিষ্ট্যই রয়েছে। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য এটা মিয়ানমারের সরকারের একটা চেষ্টা।”

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার বিচার মন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদুর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমার কাউকে ফেরত নেয়নি।

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, সে ব্যাপারে বিশ্বব্যাপীকে কিছু করার জন্য তাগিদ দেয়া।

দু’দিন আগে মিয়ানমার সরকারের গঠিত একটি কমিশন ২০১৭ সালে রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিয়ারেন্সের সময় কিছু সৈন্য সেখানে যুদ্ধাপরাধ করলেও গণহত্যার মতো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না বলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়।

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এই আদালত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ ঘোষণার আগে মিয়ানমারের ওই প্রতিবেদনকে অনেকেই প্রতারণামূলক হিসেবে দেখছেন।

বৃহস্পতিবারও এই মামলার আদেশ ঘোষণার আগে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে তিনি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের মাত্রাকে অতিরঞ্জিত হিসেবে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে রাখাইনে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দেশীয় আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।

মিয়ানমার এবং গাম্বিয়া উভয় দেশই ১৯৪৯ সালে গৃহীত গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী। এছাড়া আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত মানা বাধ্যতামূলক এবং সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই। যদিও সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার মতো ক্ষমতা নেই আদালতের। তবে অতীতে খুব কম দেশই এই আদালতের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা কিংবা পুরোপুরি মেনে চলেছে।

যেভাবে আইসিজেতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গত নভেম্বরে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে গাম্বিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক এ আদালতে গণহত্যার দায়ে তৃতীয় মামলা এটি।

গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দেশেই ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে শুধু গণহত্যা থেকে বিরত থাকা নয় বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং অপরাধের জন্য দেশগুলো বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে প্রথম জেনোসাইড কনভেনশন মামলা হয়েছিল সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে। এ মামলায় সার্বিয়া বসনিয়া হার্জেগোভিনিয়ায় গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছিল বলে প্রমাণ হয়।

কানাডা, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, তুরস্ক এবং ফ্রান্স জোর দিয়ে বলেছে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়েছে। ইসলামী দেশসমূহের সংগঠন ওআইসি তার ৫৭টি সদস্য দেশকে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার কাজে সহায়তা করে।

যেভাবে মামলার তদন্ত

গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আছে বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর ৪ জুলাই রোহিঙ্গাদের ওপর যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসির অনুমতি চান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা। জুলাই মাসে তার তদন্ত দল বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করে।

এরপর প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্তের জন্য আবেদন করেন ফাতো বেনসুদা, যাতে সায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকরা। ফলে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিপীড়নের ঘটনায় কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে তদন্ত শুরু হয়।

তবে শুরুর দিকে অনেকে এ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ মিয়ানমার আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র নয়। একইভাবে আইসিসির প্রতিনিধি দলকেও রাখাইনে পরিদর্শনে যাওয়ার অনুমতিও দেয়নি।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সামরিক অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও, খুন, ধর্ষণের মুখে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এই অভিযান গণহত্যার অভিপ্রায়ে পরিচালনা করেছে বলে মন্তব্য করেছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন