রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের যত ঝামেলা

fec-image

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আগমনের ২ বছর পূর্ণ হলো। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা তাদের ভাষা, বিশ্বাস ও অবয়বের (তিনটিই বর্ণবাদের সবচেয়ে সাধারণ চিহ্ন) কারণে ঘৃণিত।

বৌদ্ধ মিয়ানমার ফর্সা বা পীত বর্ণের ‘বার্মা’ লোকজন অধ্যুষিত, তারা তিব্বিতো-বারমান ভাষায় কথা বলে। রোহিঙ্গারা যেকোনো বিচারেই জাতিগত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। তাদের সহজেই শনাক্ত করে বহিস্কার করা সহজ।

তারা আগে দুবার- ১৯৭৭ ও ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে এসেছিল। তবে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তারা ফিরে যেতে পেরেছিল। অবশ্য এবার দৃশ্যপট অনেক শোচনীয়, অনেকেই তাদের ফেরার সম্ভাবনা তেমন দেখতে পান না।

বাংলাদেশ জাতিসংঘে উত্থাপনসহ পরিস্থিতিটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু ফলাফল নিরুৎসাহজনক। প্রথমবার আসার সময় যতটুকু সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, এখন তার চেয়ে অনেক কম মনে হচ্ছে।

দুই বছর পর উদ্বাস্তুদের বাড়ি ফেরা খুবই ক্ষীণ সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি কোনো পরাশক্তির সমর্থন নেই। আবার বাংলাদেশ তার ব্যাপারে অন্যরা আগ্রহী হয়ে ওঠুক, সেটাও চায়নি।

বাংলাদেশ এমন এক স্থানে অবস্থিত যা তাকে কৌশলগতভাবে তাৎপর্যহীন করে রেখেছে। বৈশ্বিক যুদ্ধ ও শান্তির সমীকরণে কোনো ভূমিকা নেই। দেশটির কোনো খনিজ বা অন্য কোনো সম্পদ নেই। ফলে তেমন গুরুত্বও নেই।

বাংলাদেশ যদি পরমাণু শক্তিধর হতো বা বিপুলসংখ্যক ইসলামি সন্ত্রাসবাদ তৈরী করত, তবে পরিস্থিতি হতো ভিন্ন। কঠোর বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ এত চমৎকারভাবে তার জিহাদি হুমকি মোকাবিলা করেছে যে বিশ্ব বুঝতে পেরেছে যে দেশটি এ ধরনের যেকোনো চ্যালেঞ্জ দারুণভাবে সামাল দিতে পারবে। তা করার সামর্থ্য আছে দেশটির। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা ইসলামি চরমপন্থার হুমকি সৃষ্টির আশঙ্কা কখনো সত্য হবে না। তাহলে কেন চিন্তা করা?

রোহিঙ্গারা কি ফিরে যাবে?

রোহিঙ্গারা মোটামুটিভাবে শক্তিহীন গ্রুপ, তাদের বেশির ভাগই গরিব ও নিরক্ষর। তারা এ নিয়ে তৃতীয়বার বাংলাদেশে এলো। কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার বিদেশী বিনিয়োগের আকর্ষণীয় টার্গেটে পরিণত হয়েছে। সামরিকভাবেও দেশটি শক্তিশালী, তারা রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দিতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাসী।

সাধারণ বিশ্বাস এই যে স্টেট কাউন্সিলর আঙ সান সু চি ও তার রাজনৈতিক বন্ধুরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। কথাটি আংশিকভাবে সত্য। তিনি কখনো রাষ্ট্রের পূর্ণ ক্ষমতায় ছিলেন না, এখনো নেই। সু চি ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে সঙ্ঘাত সবসময়ই ছিল। আর সামরিক বাহিনীই রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। বেসামরিক শক্তিকে দুর্বল করতে এবং দেশে (এখানে রোহিঙ্গাদের ঘৃণা করা বাধ্যতামূলক না হলেও প্রায় জাতীয় আবেগ) জনপ্রিয়তা বাড়াতে তারা কাজটি করেছিল।

সামরিক বাহিনী হত্যা ও ধর্ষণের মাধ্যমে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেছিল। জাতিসংঘ ও আরো কয়েকটি সংস্থা এই কাজকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে।

অবশ্য মিয়ানমারের জনসাধারণের কাছে সেনাবাহিনীর কাজটি তাদের দেশপ্রেমের নমুনা। তারা ‘শত্রুদের’ তাড়িয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গারা শারীরিকভাবে হুমকি না হলেও ‘বাইরের’ লোক হওয়ায় মিয়ানমারে তাদের কোনো স্থান নেই। ফলে এর মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী তাদের সামর্থ্য প্রমাণ করেছে, তারা তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছে। অর্থাৎ সামরিক বাহিনী তার রাজনৈতিক শক্তি ও প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে। তারা জনপ্রিয়।

রোহিঙ্গারা অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক হুমকি না হওয়ায় এটা অন্য কিছু নয়, বরং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়েছে। তারা গরিব, অ-নাগরিক, মূল্যবান জমিও দখল করে নেই। তারা কোনো বিদ্রোহের হুমকিও নয়। বস্তুত, তারা এমন গুটিকতেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যাদের বিদ্রোহ করার কোনো শক্তি নেই। এমনকি রাখাইনের সশস্ত্র জঙ্গিদের অনেকে বাংলাদেশ শিবির বানিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।

অবশ্য, চীনকে নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার কার্ড ব্যবহারে বাড়াবাড়ির পরিচয় দিয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছে যে মিয়ানমারে সরাসরি চীন বিনিয়োগ করায় দেশটি বেইজিংকে কব্জা করে ফেলেছে। ফলে তারা ইয়াঙ্গুনকে সমর্থন করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক/পাশ্চাত্য বিনিয়োগ মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় চীন হয়ে পড়েছে বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। এতে করে চীনা প্রভাব বেড়েছে। এটা চীনের ওপর মিয়ানমারের নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছে।

এমনকি সু চির মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায়, তবে সেনাবাহিনী তা অনুমোদন করবে না। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীকে তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে না সরানো পর্যন্ত রোহিঙ্গারা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে থেকে যেতে পারে।

বাংলাদেশ কি এখনো প্রত্যাখ্যানের অবস্থানে?

রোহিঙ্গরা যখন প্রথমে এসেছিল, বাংলাদেশ তখন হুমকির কথা নাকচ করে দিয়েছিল এই বলে যে তারা উদ্বাস্তুদের ব্যবস্থাপনা করতে পারবে। দুই বছর পর মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে এবং অনেক হতাশার সুরে বলছেন যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা শেষ পর্যন্ত সঙ্কট সৃষ্টি না করলেও একটি বড় ধরনের সমস্যা।

চীনা সমর্থনপুষ্ট বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় চুক্তিটি প্রত্যাশামতোই ফাঁকা শব্দেই পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ হোসাইন সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, ভারত ও চীনসহ প্রধান শক্তিগুলো সমর্থন করার কারণেই মিয়ানমার এ ধরনের আচরণ করছে। তিনি বলেন, কেবল ‘সৃষ্টিশীল কূটনীতিই’ প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। ওই ‘সৃষ্টিশীল’ দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ এখনো জানা যায়নি।

চীন সম্ভবত কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু এর বিনিময়ে চীন কী পাবে? চীন জানে যে সন্ত্রাসের হুমকি সীমিত, কারণ বাইরের কোনো শক্তি এতে আগ্রহী নয়। ১৯৯২ সালে যে বাইরের আগ্রহ ছিল, এখন সেটিও নেই। ফলে বেইজিং স্বস্তিতে রয়েছে।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যে বিষয়টিকে অবমূল্যায়ন করেছে তা হলো স্থানীয় প্রত্যাঘাত। এর সাথে যোগ হয়েছে ইয়াবা মাদক ব্যবসা ও অন্যান্য ইস্যু। এগুলো উদ্বাস্তু শিবিরগুলোকে খুবই উত্তপ্ত করে ফেলেছে। হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়রা যদি মনে করে, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প করতে দেয়ায় তাদের মূল্য দিতে হচ্ছে, তবে আরো চাপ সৃষ্টি হবে। বড় কোনো মূল্য না দিয়েই অসহায় উদ্বাস্তুদের পরিচর্যা করার উন্মাদনাপূর্ণ দিনগুলো শেষ হয়ে আসছে।

সূত্র: সাউিএশিয়ানমনিটরডটকম

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার, রাখাইন, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন