রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আশাবাদী বাংলাদেশ

fec-image

চীনের মধ্যস্থতায় বর্ষা মৌসুমের আগেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এ কারণে রাখাইনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রোহিঙ্গা ও সরকারের ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার ঘুরে এসেছে শুক্রবার। তবে সেখানে প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক পরিবেশ দেখছে না রোহিঙ্গারা। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ।

প্রতিনিধি দলে থাকা কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৪-এর বাসিন্দা মোহাম্মদ তাহের গতকাল শনিবার সমকালকে বলেন, ‘বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে যে এলাকাতে আমরা থাকতাম, যেখানে আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ওই জায়গাতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়নি। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছে, বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের মংডু ট্রানজিট কেন্দ্রে মাত্র তিন দিন রাখা হবে। তারপর সরাসরি মডেল ভিলেজে স্থানান্তর করা হবে। তখন মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট (এনভিসি) দেওয়া হবে। মিয়ানমারের বাসিন্দা হিসেবে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখাতে পারলে পর্যায়ক্রমে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদান করা হবে।’

পরিদর্শনকালে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের কয়েকজন সদস্য এনভিসির বিরোধিতা করে এনআইডি এবং মডেল ভিলেজের পরিবর্তে জন্মভিটাতে পুনর্বাসনের দাবি জানান।

প্রতিনিধি দলের আরেক রোহিঙ্গা সদস্য রশিদ উল্লাহ বলেন, ‘প্রথমে রাখাইনের নাকফুরায় পৌঁছি। এর পর সেখান থেকে বলিবাজার নিয়ে শেল্টারগুলো দেখানো হয়। এসব এলাকা ঝোপ-জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। পরে কাজিল বিলে সে দেশের সরকারের লোকজন জমিজমা সার্ভে করে, লাল কাপড় দিয়ে পতাকা টাঙানো হয়েছে। লাপ্পু গুনপাড়ায় তিনটি শেল্টার দেখি। মিয়ানমারে যাওয়ার পর প্রথমে এখানে তিন মাস থাকার পর গ্রামে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তাঁরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নাগরিকত্ব দাবি করেছি, ভিটামাটি দাবি করেছি– সেগুলো ফেরত দিলে আমরা যাব, সেটি জানিয়েছি। রাখাইনের অনেক জায়গা ঝোপ-জঙ্গলে ভরে গেছে। সেখানে কোনো মানুষজন নেই। এখানে আসার পর ক্যাম্পের লোকজন রাখাইনের বর্তমান অবস্থা জানতে চান। আবার অনেকে সে দেশে নিজেদের গ্রামে থাকা ঘরবাড়ি, জমিজমা বিষয়ে জানতে চান।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগে গত শুক্রবার রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ, পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে ঘুরে এসেছে ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলের উদ্দেশ্য ছিল প্রত্যাবাসন উপযোগী সহায়ক পরিবেশ মিয়ানমারে আছে কিনা, তা দেখা। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যাওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পরিবেশ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রাখাইনের পরিবেশ, পরিস্থিতি অনেক ভালো দাবি করে তাঁরা বলেছেন, ছয় বছর আগে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাফ নদ অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও মংডু শহরে রোহিঙ্গাদের নড়চড় হয়নি।

রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি সমকালকে বলেন, ‘মংডু শহরে আমরা ঘুরেছি, গ্রামেও গিয়েছি। সেখানকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে, পরিবেশ অনেক ভালো। মংডু শহরে রোহিঙ্গারা অবাধে ঘুরছে, কাজকর্মে ব্যস্ত রয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা আশাবাদী এবং দ্রুত শুরু করতে চাই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আবার আসবে।’

তবে রোহিঙ্গারা যদি স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে না চায়, তবে পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। তাঁরা শুধু প্রত্যাবাসনের আশার কথা শুনিয়েছেন।

সরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মংডু শহরের পরিস্থিতি দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। সেখানে রোহিঙ্গা মেয়েদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে দেখেছেন তিনি। মংডুর মডেল ভিলেজ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তুলনায় অনেক উন্নত। মডেল ভিলেজে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের প্রতিটি পরিবারে (রোহিঙ্গা) চাষাবাদের জন্য এক একর করে জমি বরাদ্দ দেওয়া হবে, স্কুলে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি ও স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ থাকছে। মডেল ভিলেজে হাসপাতাল, মসজিদ ও খেলার মাঠ রাখা হচ্ছে, যা অতীতে রোহিঙ্গা বসতিতে ছিল না। রোহিঙ্গাদের উচিত সুযোগটি কাজে লাগানো।

রাখাইনের মংডু বলিবাজারে ঘরবাড়ি ছিল সুবিয়া খাতুনের। ২০১৭ সালে গ্রাম ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গা নারী বলিবাজার ঘুরে এসে বলেন, সবুজেঘেরা আমাদের গ্রাম এখন ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। পুকুর ও বাগানে গাছপালা ছিল, সেসবের কোনো চিহ্ন এখন কিছু নেই। ১০-১২টি গ্রামের ৪-৫টি শেল্টার দেখানো হয়েছে, যা খুবই ছোট। সেগুলো দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। আমরা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার নামে নতুন করে আবার কোনো ক্যাম্পে যাব না। ফিরে গিয়ে গ্রামে নিজেদের ঘরে থাকতে চাই।

বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কাছে নিবন্ধিত। এর ভেতর এখন পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার পূর্ণাঙ্গ তথ্য মিয়ানমারকে দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে মাত্র ৭-৮ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে দেশটি। এ ৭০ হাজারের মধ্যে ৫২ শতাংশ রোহিঙ্গার বিষয়ে সবুজসংকেত দিয়েছে নেপিদো। বাকিদের কারও তথ্য পায়নি এবং আরও কিছু রোহিঙ্গাকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার।

সূত্র: সমকাল

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন