রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে জাতিসংঘ
কক্সবাজার প্রতিনিধি:
মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু জিরো পয়েন্টের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনলেন সফররত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
রবিবার(২৯ এপ্রিল) সকাল নয়টার দিকে ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি জিরো পয়েন্টে অবস্থান করা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখেন এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন।
জিরো পয়েন্ট পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধি দলটি উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান। সেখানে চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিশেষ ব্লকে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন।
এসময় কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ও পরিবেশ পরিস্থিতি চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেন। পরে প্রেসব্রিফিংয়ে নিজ নিজ দেশের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন প্রতিনিধিরা।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের সৃষ্টি। এ সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ লক্ষ্যে আগামীতে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা করা হবে। আন্তর্জাতিক ফোরামের আন্তরিক সহযোগিতায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান সম্ভব। মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘটিত রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি গণহত্যা বলা যাচ্ছে না। এখনই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে না। সে লক্ষ্যে চীন, রাশিয়াসহ শক্তিধর দেশ গুলো একমত পোষণ করেছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান গুস্তাভো মেজা-চুয়াদ্রার নেতৃত্বে ১৫ সদস্যদের প্রতিনিধি দলে রয়েছেন চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিক।
প্রেস ব্রিফিংয়ে রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন সেই লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার করেন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা। কথা বলার আগে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন সফরকারী সদস্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, এ সফর রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সকালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু কোণারপাড়া জিরো পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের জীবনমান দেখতে যান সফররত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা। সেখানে তারা অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় চোখের সামনেই বাবা সৈয়দ আলম ও মা সখিনাকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য দেখে ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা কিশোরী আমেনা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ওই সময় তাকে বারবার সান্তনা দিচ্ছিলেন সফররত দলের প্রধান।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের কাছে পেয়ে মিয়ানমারে স্বজনহত্যার বিচার দাবি করেন রোহিঙ্গারা। এ সময় প্রতিনিধি দল কিশোরী আমেনার বাবাসহ রাখাইনে হত্যার শিকার সবার বিচার পেতে সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।
উভয় স্থানেই তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের কাছে তাদের ওপর চালানো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মমতার বর্ণনা দেন।
রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে দুদিনের সফরে শনিবার বিকেলে কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে ইরাক থেকে সরাসরি কক্সবাজারে আসেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এ প্রতিনিধি দলটি।
ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় সাথে ছিলেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব:) খুরশিদ আলম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শাখার মহাপরিচালক তারেক মাহমুদ, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এ এইচ এম. মনিরুজ্জামান, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ছিলেন।
এর আগে শনিবার বিকেলে কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে ইরাক থেকে সরাসরি কক্সবাজারে আসেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলটি। এরপর তারা উখিয়ার ইনানীর রয়েল টিউলিপ হোটেলে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় নিরাপত্তা পরিষদের এ দলের কাছে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জোরালো পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।
জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনটি বিষয়ে আলাদা উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে প্রথাগত ও অপ্রথাগত নিরাপত্তা বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পক্ষে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুনিরুল ইসলাম আখন্দ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম এবং প্রত্যাবাসনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকার ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগ) তারেক মোহাম্মদ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখার আশ্বাস দিয়েছেন।
জাতিসংঘ প্রতিনিধদলকে স্বাগত জানান রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
প্রতিনিধিদলের এক প্রশ্নের উত্তরে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমারে গণতন্ত্র এলে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতি আশা করেছিল বাংলাদেশ। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতিকে অস্বীকার যে কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না, সেটিও তিনি উল্লেখ করেন।
নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন ছাড়া অস্থায়ী ১০ সদস্যের মধ্যে নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, পোল্যান্ড, কুয়েত, বলিভিয়া, পেরু, খাজাখাস্তান, ইথিওপিয়া ও গিনির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসেছেন। দলের অন্যরা হলেন জাতিসংঘের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা। প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে কক্সবাজার হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।