লংগদুর ঘটনায় পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যকার বিশ্বাস ও সম্প্রীতি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে


কাজী হাফিজ, লংগদু থেকে ফিরে:
বাড়িগুলোতে লোকজন ছিল না। হামলা হতে পারে—এই আশঙ্কায় ঘটনার আগেই বাড়িতে তালা দিয়ে চলে যায় ওরা। আগুন লাগানোর ঘটনার সময় তাই কোনো প্রতিরোধও হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি পরিবারগুলোর বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক ও সরকারি চাকরিজীবী পরিবারও রয়েছে।

গত ২ জুন স্থানীয় যুবলীগ নেতা ও ভাড়ায় মোটরসাইকেলচালক নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ নিয়ে বিক্ষুব্ধ বাঙালিদের মিছিল তখন বাইত্যাপাড়া থেকে লংগদুর পথে। নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশের পাহারায় এই মিছিল উপজেলা মাঠে আসার আগেই সকাল ৯টার দিকে পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলে ওঠে। তার আগে লংগদু উপজেলা মাঠে নয়নের জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য যে বাঙালিরা জড়ো হয়েছিল, তাদের শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছিল।

এই আহ্বানের সময়ই ওই সব বাড়িঘর থেকে কালো ধোঁয়া উঠতে থাকে। আগুন দেওয়া হয় মোট তিনটি এলাকায়। তিনটিলা, বাইত্যাপাড়া ও মানিকজোড়ছড়ায়। গত শনিবার লংগদুতে সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

লংগদু থানার কাছেই বাজারে কথা হয় ৭০ বছর বয়সী উদয় শংকর চাকমার সঙ্গে। তিনি তাঁদের হেডম্যান কুলিন বিহারীর চাচাতো ভাই। বললেন, ‘আগুন জ্বলে ওঠার সময় আমরা ঘরে ছিলাম না। বাড়ির দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। ’ তাঁর দাবি, ‘বাঙালিরাই আগুন দিয়েছে। নয়ন ডাকাতির শিকার। ডাকাতরা তাঁকে হত্যা করেছে। এর জন্য কেন আমাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হলো?’

উদয় শংকর চাকমা জানান, তাঁর বোন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, ভগ্নিপতি সরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন। তাদের ঘরবাড়িও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পর উদয় শংকরের স্ত্রীকে রাঙামাটিতে এক আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

লংগদুর তিনটিলা বনবিহারের গেটের বাইরে ৫৬ বছর বয়সী ধর্মদর্শী চাকমা। ওই বনবিহারের সামনেই বেশ কয়েকটি বাড়ি এবং পাশের জনসংহতি সমিতির কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আগুনের সে উত্তাপে কাছের গাছপালাগুলোর একাংশের ডালপালাও ঝলসে শুকিয়ে রয়েছে।

ধর্মদর্শী চাকমা জানান, তিনি স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর দুটি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কারা আগুন লাগিয়েছে তা তিনি চোখে দেখেননি। বললেন, “ওরা আসার আগে আগেই আমরা বাসা ছেড়ে চলে যাই। আমরা খবর পেয়েছিলাম, ‘হুন্ডাওয়ালারা’ অ্যাটাক করতে পারে। ”

ধর্মদর্শী চাকমা আরো বলেন, ‘নয়ন আমার কাছের লোক। তার সঙ্গে গ্রিন হিল আন্দোলন নিয়ে আমরা পথনাটক করেছি। ’

স্থানীয় প্রশাসনের ধারণা, এ ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যকার বিশ্বাস ও সম্প্রীতির। গত ৩ জুন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, ‘নয়নকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

নয়ন হত্যার জের ধরে পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ায় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যকার বিশ্বাস ও সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে। এই বিশ্বাস ও সম্প্রীতি আবার সৃষ্টি হতে সময় লাগবে। পুড়িয়ে দেওয়া ঘরবাড়ি আবার নির্মাণ করা যাবে, কিন্তু নষ্ট হওয়া বিশ্বাস-সম্প্রীতি কিভাবে তৈরি হবে!

এদিকে এ ঘটনা ঘটার আগেই পাহাড়িদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়েও আলোচনা আছে। স্থানীয় প্রশাসনের কারো কারো বক্তব্য, লংগদুতে তিনটি এলাকায় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আগে থেকেই বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পেছনে ১৯৮৯ সালের এক ভীতিকর স্মৃতিও কাজ করতে পারে বলে অনেকের ধারণা। ওই সময় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুর রশীদ সরকার। তখন পাহাড়িদের বাসায় আগুন দেওয়া হয়। পুড়ে যায় প্রায় ৪০০ বাড়িঘর। প্রায় ২৫ জন প্রাণ হারায়।

এ বিষয়ে লংগদু উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ওই সময় বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। হতে পারে সেটা স্মরণ করেই এবার আগে থেকেই বাড়িঘর ছেড়ে যায় ওরা। এ ছাড়া নয়ন ছিল এলাকায় জনপ্রিয়। তাকে হত্যায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাত রয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছিল। পরিস্থিতি জটিল করে তোলার জন্য ওই সন্ত্রাসীরা ওদের মধ্যে আগে থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে সরে থাকতে প্ররোচিত করে থাকতে পারে।

তোফাজ্জল হোসেন বলেন, গত ২ জুনের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ বাঙালিদের মিছিল থেকে একটি অংশ আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে শুনেছি। এ ছাড়া শুনেছি, প্রায় সাত-আট হাজার লোকের ওই মিছিলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টায় ছিলেন সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শতাধিক সদস্য। সে অবস্থাতেও জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে অনেকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মানিকজোড় ছড়াতে কয়েক শ পাহাড়ি ও বাঙালি মুখোমুখি হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উভয় দলকে সরিয়ে দেয়।

এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে দেওয়া কিভাবে সম্ভব হলো—এ প্রশ্নে উপজেলার চেয়ারম্যানের জবাব, প্রত্যেকের ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার ছিল।

লংগদু থানায় কথা হয় রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাফিউল সরওয়ারের সঙ্গে। আগুন দেওয়ার ঘটনায় বাঙালিদের গণহারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ঘটনায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং এরা সবাই বাঙালি। ঘটনার সঙ্গে প্রচুর লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়তে পারে। যারা দোষী তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। তবে নিরীহ লোকজনকে যাতে হয়রানির শিকার হতে না হয় সে দিকে লক্ষ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে শাফিউল সরওয়ার বলেন, ‘আগুন লাগানো হতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিল বলে আমার জানা নেই। তবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি যাতে না ঘটে তার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালি নেতাদের ব্রিফ করা হয়েছিল। ’ ঘটনার পর বাঙালি পরিবারগুলো পুরুষ শূন্য। এ অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, হয়তো গ্রেপ্তারের ভয়েই তারা বাড়ি ছেড়েছে।

এদিকে নিহত নয়নের তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট চার বছরের মেয়ে নূরে আক্তার নিপু এখনো জানে তার বাবা ঘুমাচ্ছে। পরে জাগবে। গত শনিবার লংগদুতে নয়নের বাসায় গিয়ে শোকাতুর পরিবেশই দেখা যায়। বাবার কথা উঠতেই নিপু বলে, ‘মসজিদের কাছে আব্বু দাদার সঙ্গে ঘুমাইছে। ’ জানা যায়, নয়নের বাবা ফয়েজ উদ্দিন আট মাস আগে মারা যান।[bws_pdfprint display=”pdf,print”]

সূত্র: কালের কণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন