শিক্ষক সঙ্কটে রাজস্থলী তাইতং পাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত

fec-image

‘পিতামাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই, শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।’ বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এ্যারিস্টটল আড়াই হাজার বছর আগে এমন মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু সুন্দরভাবে যোগ্য মানুষ গড়ার কারিগর সংকটে আছেন দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী রাজস্থলী তাইতং পাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি খুড়ে খুড়ে শিক্ষা দিয়ে আসছিলো শিক্ষার্থীদের। তখন থেকে ১১টি পদে শিক্ষক বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে জাতীয়করণ হওয়ার পর বিদ্যালয়ের শিক্ষক কয়েকজন অবসরে যাওয়য় আর কোন শিক্ষক পদায়ন হয়নি। ফলে দীর্ঘ ৩৬ বছর যাবত জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সাড়ে ৫০০ শিক্ষার্থী অতিথি শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বিদ্যালয়টি।

নিয়মবর্হিভূতভাবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাবলিক শিক্ষক রাখার কতটুকু যৌক্তিগতা বলে মনে করেন সচেতন মহল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক এ পার্বত্যনিউজকে বলেন, আমরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিমাসে টাকা দেওয়ার পরও কোন হিসাব নিকাশ আমাদেরকে দিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনীহা প্রকাশ করেন। এমন কি বিদ্যালয়ের অতিথি শিক্ষকরা ইচ্ছামাফিক তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালায়। পাবলিক পরীক্ষার সময় দায়িত্ব না পাওয়ার পরও অভিভাবকদের পকেট কেটে বড় লোক হচ্ছে, অতিথি শিক্ষকরা। সরকারি নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যার ফলে অতিথি শিক্ষকের উপর ভরসা করছেন অভিভাবক মহল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয় গভর্নিংবডির সভাপতি ও রাজস্থলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শান্তনু কুমার দাশ বলেন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাবলিক শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালানো অযৌক্তিক। অপরদিকে এলাকার ভিত্তবানদের অর্থায়নে অতিথি শিক্ষক নিয়োগ করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। তবে অতিথি শিক্ষক দিয়ে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা নিয়ম নেই বলে তিনি শিকার করেন।

রাজস্থলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আওযামী লীগের সভাপতি উবাচ মারমা বলেন, আশির দশকের পশ্চাৎপদ জনপদে অনেকের ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি তিন যুগেও শিক্ষক শূন্যতা কাটেনি। এলাকাবাসীর অর্থায়নে অতিথি শিক্ষকের ব্যয় বহন করা হচ্ছে। শূন্যপদে শিক্ষক পদায়ণ ও নতুন পদ সৃষ্টিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

সাড়ে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য স্বল্প সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে শ্রেণি কার্যক্রম। শিক্ষক সংকটের ফলে নিয়মিত ক্লাস নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের।পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ ভবন না থাকায় গাদাগাদি করে বসতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি হতাশ অভিভাবকরাও। উক্ত বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চাহিদাপত্র পাঠানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই দ্রুত পর্যাপ্ত শিক্ষক পদায়নের দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষের।

অতিথি শিক্ষক দিয়ে চালাতে হচ্ছে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। আর্থিক সংকটের কারণেও তাও সম্ভব হয়ে ওঠছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাড়ে ৫০০ শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীদের প্রাণ হলো শিক্ষক কিন্তু সেই প্রাণের সংকট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে । ফলে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট ও কোচিংমুখী হচ্ছে। সমস্যা তৈরি হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রমে, তার প্রভাব পড়ছে ফলাফলেও।

শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উথিনসিন মারমা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদি একজনও শিক্ষক না থাকে তাহলে শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হবে এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট রয়েছে, উপজেলার সমন্বয় মিটিংগুলোতে বারবার বলছি। এ ব্যাপারে সরকার যদি একটু আন্তরিক হন তাহলে শিক্ষক সংকট নিরসন হবে।

কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, দূর-দূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী এখানে পড়েন। শিক্ষক সংকটের কারণে অনেক বিষয়ের পর্যাপ্ত ক্লাস হয়না। শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম। তারা শিক্ষক সংকট নিরসনের দাবি জানান।

মেহেরুন ও আকলিমা নামে অষ্টম ও দশম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী বলেন, অনেক বিষয়ের একজনও শিক্ষক নেই। এই কারণে প্রায় ছাত্র, ছাত্রীরা ভর্তি হয়ে খুবই বিপদে পড়ছে। তাছাড়া শিক্ষক সংকটের কারণে ক্লাস কম হচ্ছে। ফলাফল তেমন ভালো হচ্ছে না, এভাবে চললে এক সময় বিদ্যালযের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানুমা মার্মা বলেন, বিষয়কভিত্তিক কোনো শিক্ষক নেই। বিষয়টি নিয়ে আমরা পড়েছি বিপাকে।

বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক আসলাম হোসেন বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রেণি কার্যক্রম। ফলে ক্লাসে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ার কারণে ভালো কোন সাপোর্ট শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। শূন্যপদ পূরণসহ শিক্ষকদের পদের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি তোলেন তিনি।

এ বিষয়ে রাজস্থলী তাইতং পাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তরিৎ কান্তি বড়ুয়া বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য প্রতিবেদন দেওয়া হলেও সুরাহা মিলতেছে না। আমি নিজেও সরাসরি কয়েকবার যোগাযোগ করেছি।

পদ সংখ্যা বিষয়ে তিনি বলেন, পদ সংখ্যা খুব কম। যা আছে তার মধ্যেও অনেক পদশূন্য রয়েছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আর্থিক সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় শিক্ষক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় মানসম্মত শিক্ষকও মিলে না। শিক্ষক সংকট নিরসনের জন্য তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন