সোমবার উদ্বোধন হচ্ছে দ. এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উঁচু আলীকদম-থানচি সড়ক

Alikadam-Thanchi Road News Pic copy

স্টাফ রিপোর্টার:
আগামী সোমবার দুয়ার খুলছে বহুল প্রতীক্ষিত দ. এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উঁচু আলীকদম-থানচি সড়কের। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ২৫শ’ ফুট উচ্চতায় ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩৩ কিলোমিটারের এ সড়কের নির্মাণ কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। সেনাবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশল ব্যাটালিয়ন এর নির্মাণ কাজ শেষ করে।

আগামী সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চতম এই সড়কটির উদ্বোধন করবেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভিডিও কনফারেন্সে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া সেনাবাহিনীর সোস্যাল ওয়ার্ক অর্গানাইজেশনের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল ওহাব, বান্দরবানের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নকিব আহম্মদ, জেলা প্রশাসক মিজানুল হক চৌধুরী, সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আরিফুর রহমানসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এতে উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।

গত মে মাসে সড়কটির উদ্বোধনের কথা থাকলেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সড়কটির বেশ কিছু অংশের মাটি ভেঙে যাওয়ায় তা আর হয়নি। সড়কটির ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো সংস্কারের পর এটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। তবে যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কটি খুলে দিতে আরো বেশ কিছুদিন সময় লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্ঠরা জানিয়েছেন।

স্থানীয়রা জানান, সড়কটি চালু হলে দুই উপজেলার লক্ষাধিক পাহাড়ি-বাঙালির ভাগ্যোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। স্থানীয় অধিবাসীদের পাহাড়ে উত্পাদিত কৃষিপণ্য পরিবহন সহজতর ও সময় সাশ্রয় হবে। এতে করে লাভবান হবে সাধারণ মানুষ। ২০১০ সালে সেনাবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশল ব্যাটালিয়ন ১৬ ইসিবি আলীকদম-থানছি সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু করে এবং ১৭ ইসিবি এর কাজ সমাপ্ত করে। সড়কটি চালু হলে এখানকার সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক চিত্রও পরিবর্তন হবে। দুই উপজেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম হবে।

দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন বাড়বে। আলীকদম সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন বলেন, সড়কটি চালু হলে এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।

সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ ১৯ ইসিবির জেষ্ঠ কর্মকর্তা মেজর মাহাবুবুল হক জানান, ২০০৬ সালে থানছি ও আলীকদম উপজেলা সীমান্তের ডিম পাহাড় দিয়ে সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। প্রথমে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু করলেও পরে এটি সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ ১৬ ইসিবি ও ১৭ ইসিবি কাজ সম্পন্ন করে। চলতি বর্ষা মৌসুমে প্রবল বর্ষণের কারণে সড়কটির বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলোর সংস্কার কাজ চলছে। আগামী ১৪ জুলাই মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সড়কটির উদ্বোধন করবেন।

Alikadam-Thanchi Road News Pic-02 copyবান্দরবানের চিম্বুক রেঞ্জের (চিম্বুক পাহাড়) ডিম পাহাড় অংশটির উচ্চতা প্রায় ২৫শ’ ফুট। এত উচ্চতায় পাহাড়ের ধাপ কেটে সড়ক নির্মাণ যেমন ব্যয়বহুল তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও। সেনাবাহিনীর প্রকৌশল শাখার সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ডিম পাহাড়ের ৬০/৭০টি ধাপ কেটে সড়কটি নির্মাণ করে। তাই ডিম পাহাড় থেকে দেখলে মনে হবে যেন সাপের মত আঁকা বাঁকা হয়ে সবুজের ভেতর দিয়ে নিচে নেমে গেছে সড়কটি। সড়কটি বান্দরবানের থানছি উপজেলা থেকে আলীকদম হয়ে চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কের সাথে মিশেছে। দেশের উচ্চতম এই সড়কটির অন্যতম দিকই হচ্ছে এর প্রকৃতিক সৌন্দর্য।

থানছি-আলীকদম সড়কর নির্মাণ প্রকল্পের প্রধান কর্মকর্তা লে.কর্নেল মনোয়ারুল ইসলাম জানান, মূলত প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৯১ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগ থানছি-আলীকদম অভ্যন্তরীণ সড়কের কাজ শুরু করে। ৮০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে সড়ক নির্মাণ কাজ হাতে নেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে পর্যন্ত সড়কের কেবল ৪ কিলোমিটার কাজ সমাপ্তির পর পুরো নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় সেনাবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশল ব্যাটালিয়ানকে। ২০০৬ সালে অর্থবরাদ্দ পাবার পর পুনরায় সড়কের কাজ শুরু করা হয়।

২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৫ সালের জুন মাসে সড়কের পুরো কাজ শেষ করার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই সড়কের নির্মাণ শেষ করা সম্ভব হয়েছে। ১২ ফুট চওড়াও এবং উভয় পার্শ্বে ৩ ফুট করে মোট ১৮ ফুট প্রস্তুতি ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কটি।

তিনি বলেন, এক সময় থানছি-আলীকদম উপজেলার হাজার হাজার মানুষের একমাত্র যাতায়াত মাধ্যম ছিল বান্দরবান জেলা সদর হয়ে থানছি এবং আলীকদম থেকে থানছি আসতে ১৯০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হত। সড়কটি নির্মাণের ফলে থানছি সদর থেকে আলীকদম উপজেলা যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট।

স্থানীয়রা জানান, এ সড়কটি নির্মিত হওয়ায় আলীকদম ও থানচি এ দুই উপজেলার দুর্গম এলাকার প্রায় ৮০ হাজার পাহাড়ি মানুষের সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত হল। স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সহজতর ও অল্প সময়েই পরিবহন সুবিধাও নিশ্চিত হয়েছে। ফলে এ দুর্গম এলাকার ৮০ হাজার মানুষের ভাগ্যে আমূল পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।

বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানছি ও আলীকদম উপজেলার দুর্গম এলাকার প্রায় ৮০ হাজার উপজাতীয় বাসিন্দাদের দাবি ছিল ৩৩ কিলোটিার দীর্ঘ থনাছি-আলীকদম সড়কটি নির্মাণের। অবশেষে সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত হয় এ সড়কটি। সড়কটি চালু হলেই এলাকার প্রায় ৮০ হাজার পাহাড়ি তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজেই পরিবহন সুযোগ পাবেন এবং তারা ন্যায্য মূল্যও পাবেন অনায়াসে।

থানছির দুর্গম রেমক্রির জুমচাষী লুইপা মুরুং ও কেউচিং মুরুং জানান, নবনির্মিত সড়কটি চালু হলে বনজদ্রব্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, জুমে উৎপাদিত ধান, তুলা, সরিসা, মিষ্টিকুমড়া, জুমকুমড়া, ধানিয়া মরিচ, মারফা, চিনার ও তিলসহ হরেক রকম কৃষিপণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে এবং তারা আর্থিকভাবে দ্রুত স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে বলে মতপ্রকাশ করেছেন।তা ছাড়াও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। এতে এসব মানুষের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার আলো পাবে।

আলীকদম উপজেলার সদর ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বলেন, পাহাড়ের দুর্গম এলাকাসমূহের সাথে সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। এখন আর পিছিয়ে পড়া কোন অঞ্চল নয় এ দুই উপজেলার পাড়া-গ্রামগুলো। তিনি বলেন, ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ থানছি-আলীকদম পাহাড়ি সড়কপথ নির্মিত হওয়ায় এলাকার প্রায় ৮০ হাজার পাহাড়ি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হল। সড়ক নির্মাণের ফলে দুই উপজেলার সাধারণ লোকজনের জীবনযাত্রায় নতুন দিগন্তের সূচনা হল।

এ সড়কের জিরোপয়েন্ট থেকে মাঝখানে অবস্থিত অন্যতম পর্যটন স্পট ‘ডিমপাহাড়’। এ ডিমপাহাড়কে সাজানো গেলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্যে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করবে। সবুজ পাহাড়ের মাঝখানে উঁচু-নিচু আঁকা-বাঁকা এ সড়কপথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেই দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও দেখার সুযোগ পাবেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment
আরও পড়ুন