স্বামী সন্তান হারা জমিলার জীবন-প্রদীপ নিভে যাচ্ছে বিনা চিকিৎসায় ও অনাহারে
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরাই একজন নারী-পুরুষের আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা। যদি কারো জীবনে এদের কেউই বেঁচে না থাকে তাহলে তার মতো অসহায় পৃথিবীতে কেউ নেই বললেই চলে। জীবনের এই মহাদূর্যোগের মধ্যে বিনা চিকিৎসায়, বিনা সেবাযত্নে পৃথিবীর আলো-বাতাস বঞ্চিত অন্ধকার, স্যাঁত স্যাঁতে ও অমানবিক পরিবেশে দীর্ঘ ৫ বছর মৃত্যুর প্রহর গুনছেন মানিকছড়ির জমিলা খাতুন(৭৭)! এখন শুধু শেষ নিঃশ্বাস বিদায়ের অপেক্ষা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ হরিনখাইন গ্রামের এজহার সওদাগর বাড়ীর আবদুল হাকীম ও তার স্ত্রী জমিলা খাতুন ২০০৮ পরবর্তী সময়ে মানিকছড়ি উপজেলার ছদুরখীল এলাকায় বসবাস শুরু করেন। গ্রামের বাড়ীতে থেকে যায় একমাত্র বিবাহিত কন্যা ৩ সন্তানের জননী মোমেনা খাতুন। হঠাৎ একদিন জমিলার স্বামী আবদুল হাকিম মৃত্যুবরণ করেন। নিঃসঙ্গ জমিলা নিরুপায় হয়ে বিবাহিত কন্যা মোমেনা খাতুনকে ১ ছেলে, ২ কন্যা সন্তানসহ নিজের পাশে নিয়ে আসেন। বছর দুয়েক যেতে না যেতে একদিন একমাত্র কন্যা মোমেনাও মারা যান! এর ফলে পৃথিবীতে জমিলার আর কেউ বেঁচে থাকলো না। শুধু রয়ে গেল ১ নাতী ও ২ নাতনী। ধীরে ধীরে ২ নাতনীরও বিয়ে হয়ে গেল। ২০১৬ সালে নাতী আবদুল মোতালেব ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। লেখা-পড়া না থাকায় আবদুল মোতালেব নানী ও স্ত্রী রুজিনা আক্তারকে মানিকছড়ি সদরস্থ মাস্টার পাড়া(অবকাশ সংলগ্ন) একটি ভাড়া বাসায়(কুঁড়ে ঘর) রেখে চট্টগ্রাম শহরে রিক্সা চালিয়ে সংসার চালায়!
এদিকে স্বামী আবদুল মোতালেব এর আয়ে অসুস্থ নানী শ্বাশুরীকে সংসার চালাতে কষ্ট হওয়ায় রুজিনা মানুষের বাসা-বাড়ীকে কাজ করেন। ঘরে প্যারালাইসিস’সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত জমিলা গত বছর দুয়েক বিনাচিকিৎসা ও অনাহার-অর্ধাহারে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দিনাতিপাত করছে! গত দু’বছরের মধ্যে এক মিনিটের জন্য জমিলা পৃথিবীর আলো-বাতাস নেওয়ার সুযোগ হয়নি! বেড়া ও টিনের একটি ছোট কক্ষে স্যাঁত-স্যাঁতে পরিবেশে মাটিতে সাড়া-শব্দ বিহীন পড়ে রয়েছে! এই অভাগীনির দূর্বিসহ, অমানবিক জীবনের তথ্য-তালাশ নেয়ার সুযোগ কারো জুটেনি বা কেউ নেয়নি!
অভাবের তাড়নায় নাতী যখন শহরে রিক্সা চালায় আর নাতী বউ মানুষের ঘরে কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত! ঠিক সে সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা জননী জমিলা খাতুন বিনা চিকিৎসা, বিনা সেবাযত্নে, দিনের পর দিন অনাহারে মৃত্যুর প্রহর গুনছে! এমনই দুঃসংবাদ পেয়ে ৩১ অক্টোবর সকালে মানিকছড়ি যুব রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের কর্মীরা ছুঁটে যান ওই জমিলার খোঁজে।
সরজমিন গিয়ে যুব ইউনিট প্রধান মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টকর এবং অমানবিক, দূর্বিসহ পরিবেশে জমিলা খাতুন এর জীবন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে! মাটির একটি কুঁড়ে ঘরে ছাটির ওপর ফেলে রাখা জমিলার শরীরে শুধু সামান্য শ্বাস-প্রশ্বাস উঠা-নামার দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই অনুমান করা যাচ্ছে না। শরীরে পাল্স নেই বললেই চলে! এমন পরিস্থতিতে দ্রুত জমিলাকে উন্নত চিকিৎসা ছাড়া কিছুতেই তাকে বাঁচানো যাবে না। আমরা যুব রেড ক্রিসেন্ট কর্মীরা এই মানবীর অমানবিক জীবন-মৃত্যুর দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়েছি। দ্রুত সংবাদ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রশাসনের দৃষ্টিতে জমিলার এই অমানবিক জীবন দশা তুলে ধরে তাকে বাঁচানোর অনুরোধ করছি।
এই নির্মম ও অমানবিক বয়োঃবৃদ্ধা জমিলার আশ্রয়দাতা নাতী বউ রুজিনা আক্তার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমার নানী শ্বাশুরীর আপন বলতে পৃথিবীতে নাতী ও নাতনী ছাড়া কেউই নেই! আমার স্বামী অভাব-অনটনের সংসার চালাতে শহরে রিক্সা চালায়। ২/৩ মাস পর আসে আবার চলে যায়। আমি ৩ বছর কন্যা সন্তান ও নানী শ্বাশুরীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় অল্প আয় দিয়ে চলতে না পেরে মানুষের ঘরে কাজ-কর্ম করতে হয়। ঘর আর কেউ না থাকায় ওনার সেবাযত্নে, চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না। প্যারালাইসিস হওয়ায় আজ এক দেড় বছর টানা মাটিতে শুইয়ে রাখতে হয়েছে। কী করবো গত কয়েক দিন ধরে স্বামীকেও মোবাইলে পাচ্ছি না! এভাবে মরে গেলেও কাউকে হয়তো পাবো না কবর দিতে! আমি এখন কী করবো ভেবে কূল পাচ্ছি না।