আমার প্রথম ইউনিট বেবি টাইগার্স প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পূর্তিতে

হিল খাটা ছাড়া অপূর্ণ থেকে যায় পদাতিকের জীবন

fec-image

আমার হিল ট্র্যাক্টসে পোস্টিং (১৯৯১) হয়েছে শুনে আমার খালু আঁতকে উঠে আমার মাকে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করেন,
‘ওর কী কারণে পানিশমেন্ট হলো?’

ফাইলটা সই না হলে ওভার নাইট বান্দরবন পাঠানোর একটি হুমকিযুক্ত এড কিছুদিন আগেও টিভিতে বেশ সরবে প্রচার হতে দেখেছি। অর্থাৎ হিলে যাও, পচে মর!

হিলকে আমাদের সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের ক্যারিয়ারে এক কলঙ্ক তিলকই মনে করেন। যেকোন উপায়ে এই আন্দামান দ্বীপে কালাপানি (শাস্তি)  হওয়া ঠেকাতে হবে। ২০০৩ সালে পানছড়ির ওসি সন্তোষ রায়ের কথা খুব মনে পড়ে। তার সাথে নানা বিষয়ে আমাদেরও আলোচনা হতো। বাবাও এক সময়ে থানার ওসি ছিলেন জেনে আমাকে মোটের উপর একটু ‘এক্সট্রা’ সমীহ করতেন। আমারও তাই।  থানার একমাত্র পুরাতন পিকআপটি প্রায়ই অচল থাকে। এখানে ওখানে যেতে তার চাঁন্দের গাড়ি ভাড়া করতে হয়। লাশ পড়লে তা উদ্ধারে সেনাবাহিনীর মুখাপেক্ষী থাকা, থানার কোন প্রভাব পাহাড়ে না থাকা, মামলা কম হওয়ায় থানা প্রাঙ্গণে শুনশান নীরবতা। (এক মাসে তিনটি জিডি)। থানার লজিস্টিকস যে খুবই অপর্যাপ্ত তা তো শৈশবে দেখেছি।

সন্তোষ বাবু খুব আফসোস করে বললেন, ‘আমি হিন্দু বলে আমাকে হিলে পোস্টিং দিছে- আমার ডিআইজিকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম আমাকে কুমিল্লায় দেন।’

তিনি বললেন, ‘আপনি কুমিল্লার ওই এলাকার এমপি থেকে ‘এনওসি’ নিয়ে আসেন!’

এমপি সব শুনে বলেন, ‘আপনি হিন্দু মানুষ আপনাকে নিই কেমনে?’

‘আমার নিজ বাড়ি মানিকছড়িতে, ফটিকছড়িতেও দিতে পারতো- দিলো পানছড়িতে পোস্টিং,-আর ভয় করি না। এরপর আর কোথায় দেবে, সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরাতে তো আর পোস্টিং দিতে পারবে না।’

মাস তিনেক হলো এসেছেন, কিন্তু জোরদার চেষ্টা চালাচ্ছেন হিলের এই ‘কালাপানি (শাস্তি)’ এড়াতে।

কিন্তু আমাদের সমতলেও এরকম আন্দামান দ্বীপসম লোকালয় ছিলো। যেমন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। চারিদিকে জলের বেষ্টনীর মাঝে খালিয়াজুড়ির থানা বছরের বেশির ভাগ সময় আন্দামান দ্বীপের মতই। দুর্গম, চিকিৎসা সেবার নূন্যতম ব্যবস্থাহীন এই প্রান্তরেই আমার অগ্রজ বোন ‘টিনা’ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় শিশু বয়সে মৃত্যুবরণ করে। মাকে প্রায় সময়ই দেখতাম তার মৃত সেই কন্যার জন্য আহাজারি করে কাঁদতে।

পাহাড়েও শিশুরা ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়ায় মরে কিন্তু পাহাড়ের পোস্টিং সমতলের দুর্গমতাকে ছাড়িয়ে এক স্থায়ী আতঙ্কে পরিণত হয়েছে/ (ছিলো)।
ইউনিটের মাসিক সৈনিক দরবারে প্রায়শই ব্যক্তিগত আবেদন নিয়ে অনেকেই হাজির হতেন।

‘স্যার, তিন বার হিল ‘খাটছি’ এখন একটু ‘পেলে ডিস্‌ট্রিক্ট চাকরি করতে চাই, পরিবারের কাছাকাছি থাকতে চাই।’
তাদের বর্নায় ‘জেল খাটা’ আর ‘হিল খাটা’ যেন সমার্থক!

মাতৃত্বের স্বাদ ছাড়া যেমন নারী জীবন স্বার্থক হয় না, পাহাড়ের জীবন ছাড়া পদাতিকের জীবন অপূর্ণ থেকে যায়। সবাই মা হতে পারে না, তেমনই সব সেনাই পাহাড়ে নিয়োগ পায়না বা তার দরকার হয় না।

সত্যি  বুলেটের শব্দে প্রকম্পিত পাহাড়ের গায়ে সে শব্দ কীভাবে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরত আসে সে অভিজ্ঞতা যার নেই তার জীবন পাবজি গেমসের নায়কের মত।

পাহাড়ের জীবন ও সংঘাত যে সেনা দেখেনি তার জীবন সুটেড বুটেড কর্পোরেট চাকরিজীবীর মতই ইউনিফর্মে সাটাঁ বুটেড সোলজার। হিলের কঠিন জীবন ও পরিস্থিতি ‘পেপার টাইগার’ আর সত্যিকার ‘নেতার’ মধ্যে পার্থক্য করে দেয়।

ইউনিফর্মের প্রতি আসক্তি আনার জন্যই কিনা মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার রাব্বানী বেশ তেজস্বী কণ্ঠে প্যারেড গ্রাউন্ডে ডায়াসে বজ্রমুষ্ঠির আঘাত ফেলে ভাষণ দিতেন,
‘You are the cream of this nation.The Nation deserves your service in Chittagong Hill Tracts.
Sovereignty of this country depends on your valor.’

-মাথার মধ্যে হাতুড়ির আঘাত!

সময়টা ১৯৮৬। শান্তিবাহিনী বাঙালি বসতিগুলোর উপর ব্যাপকহারে আক্রমণের মাধ্যমে পাহাডকে উত্তপ্ত করছে। পাহাড় শীতল করার জন্য দরকার দীপ্ত তরুণের তপ্ত রক্ত।
কমিশন প্রাপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণে (জুন ১৯৮৭) ‘আর্মস এন্ড সার্ভিস’ চয়েসের তিনটি ঘরেই পদাতিক লিখে পাশে ইউনিট হিসাবে হিলে থাকা ইউনিটগুলোর নাম লিখে সেই কবিতার পঙ্খিতে কান পেতে থাকলাম,
‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়!’

ফলাফল ঘোষণা হলো-
‘দ্য বেবি টাইগার্স- ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঘাটাইল সেনানিবাস- আমার ইউনিট।
হা হতোস্বী কোথায় সেই হিল!
একাডেমির কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার রাব্বানী যার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে বলেছেন??

” আধা হিল” বা “হিল ইউদ আউট হিল মানি”। টিলা ভূমির ঘাটাইল সেনানিবাস পেয়ে উচ্ছ্বাসটা স্তিমিত হয়ে গেল। ইউনিট মাত্র হিল ফেরত, আরো পুরো তিন বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে ‘এক শত্রু এক বুলেট’ ট্রেনিংয়ের প্রমাণ দিতে।

১৯ জানুয়ারি ১৯৯১ সালে হিলের প্রথম অপারেশনের প্রথম দিনে সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দের প্রতিধ্বনি শুনলাম।

‌‌‘এনিমি কনট্রাকটেড এট গ্রিড রেফারেন্স ৯৬০৮৬০ লোকেশন -বন্দুক ভাঙা’- বেতার যন্ত্রে মেসেজ যাচ্ছে।

শত্রুর পলায়ন পথে পাথুরে ছড়ার পথে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ দেখে বুঝলাম ট্রেনিং বৃথা যায়নি। সেই যে মগজে ঢুকলো হিল খাটার নেশা!!!
“Kill Them All and Come back Alone”
হলিউড ছবির সেই পোস্টার মনের খুব গভীরে গেঁথে গেল।
আমার সেই  প্রথম ইউনিট বেবি টাইগার্স তার প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর (১০ ফেব্রুয়ারি) পূর্তি করতে যাচ্ছে। আমিও মধ্য ‘৫০’। কিন্তু এখনো হিলের নেশাটা ‘বায়োস্কপের’ নেশার মতোই মনে হয়।

বেবি টাইগার্স ৭ম বারের মতো হিলে ( দীঘিনালা)  আছে।  আমি নেই, কারণ আমার আর সে  যৌবন নেই যুদ্ধে যাবার। নতুন তরুণ বাঘ এখন দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে হিল। আমরা কেউ হিল খাটি না, আমরা হিল নিয়ে বাজি ধরি। সীমান্ত রেখার ত্রিকোনা পিলারে হাত রেখে আমরা অনুভব করি ‘এই আমার দেশ, ইনহাস্ত ওয়াতানাম!!’

হিলে আবার নতুন নেকড়ের দেখা মিলেছে। রং বদলিয়ে পুরানো নেকড়ে (  JSS>JLA) আর নতুন নেকড়ে ( KNF) খামচে ধরেছে দেশের সীমান্ত রেখা।

হিল আমরা নেকড়েদের কাছে কখনোই ছাড়বো না।

লেখকের আরো লেখা:

সীমান্ত সড়ক কারো জন্য স্বস্তির, কারো জন্য অস্বস্তির কারণ কেন?

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন