১২ বছর জমির খাজনা নেয় না ১০১ নং ঘিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান পুষ্পল

ভূমি হারানোর শংকায় কাউখালীর ১৫০ বাঙ্গালি পরিবার

fec-image

১২ বছর পূর্নবাসিত ১শত ৫০ বাঙ্গালি পরিবারের ৩ শত একর জমির খাজনা নিচ্ছেন না রাঙ্গামাটির কাউখালীর ১০১ নং ঘিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান পুষ্পল কুসুম তালুকদার।

আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান এসোসিয়েশনের নির্দেশে উল্লেখিত এলাকার খাজনা নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন এ মৌজা হেডম্যান। ফলে দেশের একজন বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে ঘিলাছড়ির দেড় শতাধিক পরিবার।

উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ঘাগড়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডজুড়ে ঘিলাছড়ি মিয়াপাড়া এলাকার অবস্থান। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সরকার দেশের বিভিন্ন অবস্থান থেকে এসব ভুমিহীনদের ঘিলাছড়ি মিয়াপাড়া নামক স্থানে পূনর্বাসন করে। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত শান্তিবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান অনেকে। এসব বাঙ্গালি পরিবারকে বিতাড়িত করতে এহেন কোন নির্যাতন বাকী রাখেনি তৎকালীন শান্তিবাহিনী।

গুলি, জালাও পোড়াও এবং পাশবিক নির্যাতন সইতে না পেরে ঐ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে অনেক পরিবারকে। ৪৪ বছর বিভিন্ন প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বর্তমানে টিকে আছে ১৫০ পরিবার। ২০০০ সালের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে ঐ এলাকার পাহাড়ি-বাঙ্গালির মাঝে সৃষ্ঠ বৈরী পরিবেশ কাটিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরী হতে থাকে। বসবাসকৃত বাঙ্গালি এলাকায় বর্তমানে ভূমি বিরোধ খুব একটা নেই বলে চলে।

বিরোধমুক্ত থাকার ফলে ১৯৮০ সাল থেকে ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত ১০১ নং ঘিলাছড়ি মৌজার তৎকালীন হেডম্যান জগদিশ চন্দ্র তালুকদার ঘিলাছড়ি মিয়াপাড়া এলাকায় বসবাসরত ১৫০ বাঙ্গালি পরিবারের ৩০০ একর জমির নিয়মিত খাজনা গ্রহণ করেন। জগদিশ চন্দ্র তালুকদারের বাধ্যক্যজনিত কারণে ২০১১ সালের ২৫ এপ্রিল পিতার স্থলাভিসিক্ত হন ছেলে পুষ্পল কুসুম তালুকদার। বিপত্তির শুরু হয় তখন থেকেই। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)র মদদপুষ্ট কট্টর বাঙ্গালি বিদ্বেষী এ হেডম্যান দায়িত্ব গ্রহণের পর ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিগত ১২ বছর বাঙ্গালি অধ্যুষিত ১৫০ পরিবারের ৩০০ একর জমির খাজনা নেয়া বন্ধ করে দেন বলে অভিযোগ করেন ঐ এলাকার মানুষ।

তত সময়ে খাজনা রশিদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবা পাওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় খুব একটা সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি পরিবারগুলোকে। বর্তমানে জমির খাজনা দিতে না পারায়, খাজনা রশিদের অভাবে ব্যাংক ঋণ, জমি ক্রয়/বিক্রয়সহ নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। এমনকি হেডম্যান রিপোর্ট না পাওয়ায় ওয়ারিশান সূত্রে পৈত্রিক সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে অনেক পরিবার। ফলে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অপরদিকে নানাবিদ ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে ভুমি হারানোর শংকায় রয়েছে ১৫০টি বাঙ্গালি পরিবার।

২০১২ সালে খাজনা প্রদান, জমি বিক্রয়ের মিউটেশনে সুপারিশ না দেওয়ার অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসক বরাবরে গণ স্বাক্ষর নিয়ে অভিযোগ দেয় ভুক্তভোগীরা। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টরকে এম সালাহউদ্দিন ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে খাজনা আদায় ও জমি ক্রয়/বিক্রয়ের আবেদনে সুপারিশ প্রদানে অনিহা। মৌজা হেডম্যান কার্যক্রমের পরিপন্থি উল্লেখ করে ২৭ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখের মধ্যে জবাব দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।

একই বিষয়ে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর এ এস এম রিয়াদ হাসান গৌরব উভয় পক্ষকে শুনানীর জন্য নোটিশ জারি করেন।

চিঠির পর শুনানীর জন্য ধার্য্যকৃত তারিখে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত জবাব দেন হেডম্যান পুষ্পল। তাতে তিনি লিখেন তার নিয়োগ পাওয়ার পূর্বে ২০০৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সর্বশেষ তিন পার্বত্য জেলার ভূমি বন্দোবস্ত ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নির্দেশনা থাকায় খাজনা আদায় থেকে বিরত আছে। সেখানে তিনি আরও লিখেন ভুক্তোভোগীদের পার্বত্য অঞ্চলের আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ না করে মৌজা হেডম্যান এর সুপারিশ ব্যতীত বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক অস্থায়ী/অ-উপজাতীদের নিকট হতে বিতর্কিত/বিধি বহিভূতভাবে বন্দোবস্তকৃত জমির মিউটেশনসহ খাজনা/কর আদায় স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসককে পাঠানো চিঠিকে মিউটেশনসহ খাজনা আদায় স্থগিত রাখার নির্দেশনা উল্লেখ করে মিউটেশনের সুপারিশ প্রদানসহ খাজনা কর আদায় করা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন।

অথচ হেডম্যানদের নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপক্ষ উপজেলা ও জেলা প্রশাসন থেকে এধরনের খাজনা আদায় বা মিউটেশনে সুপারিশ না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এছাড়ও উপজেলার অন্যান্য এলাকার সকল হেডম্যান নিয়মিত ভাবেই পাহাড়ী বাঙালী উভয়ের কাছ থেকে খাজনা আদায় করছেন। দিচ্ছেন মিউটেশন সহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশও।

ঘিলাছড়ি ও মিয়াপাড়া এলাকার সমাজ কমিটির সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মজিবর রহমান ও সমাজ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, হেডম্যান ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘ এক যুগ ধরে আমাদেরকে রাষ্ট্রের সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। ১০/১২ বছর আগে বাবা মারা গেলেও বাবার নামে থাকা জায়গা এখনো নিজেদের নামে আনতে পারি নাই। হেডম্যানের সাথে বহুবার আলাপ করছি। হেডম্যান সাফ জানিয়ে দেয় তার পক্ষে হেডম্যান রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব না। খাজনা দিতে চাইলে আঞ্চলিক পরিষদের দোহাই দিয়ে তাও নিচ্ছে না।

এবিষয়ে জানতে চাইলে ১০১ নং ঘিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান পুষ্পল কুসুম তালুকদার জানান- আঞ্চলিক পরিষদ হচ্ছে সরকারের একটা অংশ, ওটাতো সরকারের সাথে সম্পৃক্ত। পার্বত্য জেলার সকল হেডম্যানদের আঞ্চলিক পরিষদ থেকে একটা নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো। যার দরুন বাঙ্গালীদের খাজনা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সকল হেডম্যানদের আঞ্চলিক পরিষদ এমন নির্দেশনা দিয়ে থাকলে উপজেলার অন্যান্য হেডম্যানরা কিভাবে খাজনা নিচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালান।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দা সাদিয়া নূরীয়া জানান, আমারা বিষয়টি শুনেছি । তবে এখনো কেউ লিখিত কোন অভিযোগ করেনি । লিখিত অভিযোগ করলে বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিবো ।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কাউখালী, পরিবার, বাঙ্গালি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন