পাহাড় পথে, আগামীর রথে
হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে গঙ্গা ভারতের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে নবাবগঞ্জ জেলার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে এটি গোয়ালন্দের কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়ে আরও ভাটিতে চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নবাবগঞ্জ থেকে মেঘনার সঙ্গমস্থল পর্যন্ত ধারার নাম পদ্মা। দীর্ঘ যাত্রা পথে গঙ্গা-পদ্মা সৃজন করেছে বহু সভ্যতা, শহর বন্দর। শুধু গঙ্গাই নয় পৃথিবীর সব নদ-নদীর উৎপত্তিস্থল পর্বত। আজকের পৃথিবীর সভ্যতার যে পটভূমি তা রচিত মূলত নদীকে ঘিরে। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ইশতেহার কবিতায় বলেছেন, ‘আমরা ভূমিকে কর্ষণ করে শস্য জন্মাতে শিখেছি’। এই শস্য জন্মানোর জন্য যে জলধারা প্রয়োজন তার উৎসও কিন্তু পর্বত। পাহাড়ের অবিরাম জলধারা বন্ধ হয়ে গেলে অস্তিত্ব হারাবে সব নদীনালা আর সুপেয় পানির উৎস। আমরা কী পর্বত বিহীন পৃথিবীর কথা ভাবতে পারি? আমাদের জীবন রক্ষাকারী ঔষধ তৈরির জন্য যে কাঁচামাল প্রয়োজন হয় তার বিরাট অংশের যোগান দেয় পর্বত। আমরা যে ফলমূল খেয়ে পুষ্টি ও তুর্ষ্টি পেয়ে থাকি তারও বিশাল অংশ আসে পাহাড় থেকে। অর্থাৎ জীবন বাঁচাতে ও জীবন সাজাতে পর্বতের ভূমিকা বিশাল, বিরাট ও ব্যাপক।
পৃথিবীর স্থলভাগের প্রায় এক চতুর্থাংশ জায়গা জুড়ে আছে বিস্তৃত পর্বতমালা। এ পর্বতমালার প্রত্যক্ষ উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা প্রায় ২২ শতাংশ এবং পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ পরোক্ষভাবে পর্বত সংশ্লিষ্ট সম্পদ হতে প্রাপ্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, জনসংখ্যার আধিক্য, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, বৃক্ষরাজি ধ্বংস ইত্যাদি নানাবিধ ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ফলে সত্যিকার অর্থেই প্রকৃতি সৃষ্ট পর্বতমালা আজ নানামুখী নেতিবাচক চাপের ভারে অনেকটা ক্লান্ত । তাই প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি, অমূল্য উপহার পাহাড় পর্বত সুরক্ষা করে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস পালন করা হয়। পর্বত দিবসের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকে। যতদূর জানা যায় ১৮৩৮ সাল থেকে নানাভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্বত দিবস পালন হতো। তবে জনজীবনে পর্বতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০০২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতিবছর ১১ ডিসেম্বর “আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস” পালনের ঘোষণা দেয়। সেই থেকে বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস পালিত হচ্ছে। আমাদের দেশে দিবসটি সরকারিভাবে পালনের উদ্যোগ নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Sustainable Mountain Tourism’।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের প্রাণ প্রিয় বাংলাদেশ। এ দেশটাকে নানান রঙ্গে নানাভাবে আরও শতগুণে সমৃদ্ধ করেছে আমাদের পার্বত্য অঞ্চল। দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত তিন পার্বত্য জেলার আয়তন সারা দেশের আয়তনের এক দশমাংশ। এছাড়াও দেশের অন্য কিছু জেলায় পার্বত্য এলাকা রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি অঞ্চল, আমাদের গর্বের এলাকা। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল শাকসবজি, বনজ উদ্ভিদ, ঔষধি উদ্ভিদ, বিভিন্ন ধরনের মাছ, পাখ-পাখালি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এসব এলাকাকে সমৃদ্ধ করেছে এতে কোনো সন্দেহ নাই। বাংলাদেশ যদিও অধিক জনসংখ্যা সংবলিত একটি দেশ তবুও এখানে রয়েছে জীববৈচিত্রের অপরুপ সমাহার। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে রয়েছে ১৯৫২ প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণি, ৬৫৩ প্রজাতির মাছ, ৫০ প্রজাতির উভচর প্রাণি, ১৪৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৬৬ প্রজাতির পাখী এবং ১২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীবজন্তু। (এ.এইচএম আলী রেজা এবং মো: কামরুল হাসান কর্তৃক ৪ নভেম্বর, ২০১৯ সালে প্রকাশিত তথ্য)। এছাড়াও বাংলা পিডিয়ার সূত্র মতে রয়েছে ৬০০০ এর অধিক প্রকারের ফলদ, বনজ ও ভেষজ উদ্ভিদ। এসবের অধিকাংশই পাহাড়ি এলাকায় এনে দিয়েছে জীববৈচিত্রের এক অভাবনীয় দৃশ্যপট, তৈরি করেছে উন্নয়নের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক পর্বত দিবসে আমাদের সবার অঙ্গীকার হবে পাহাড়ের পরিবেশ, ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র ধরে রাখা এবং এ অঞ্চলের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের ধারাকে বজায় রাখা।
‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ, সেই পাহাড়ের ঝর্ণা আমি একলা জেগে রই’ সত্যিই ঘণ সবুজ মেঘে ঢাকা পাহাড়, ঝর্ণা ঝিরি বৃহৎ পাহাড়ি অঞ্চল বাংলাদেশের পর্যটনের অন্যতম সম্ভাবনাময়খাত। পর্যটনের অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল; যা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এটি যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ বদলানোর খেলা। এখানে শীতে যেমন একরূপ ধরা দেয় ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে, ঠিক তেমনি বর্ষায় অন্য একরূপে হাজির হয়। শীতে পাহাড় কুয়াশা আর মেঘের চাদরে যেমন ঢাকা থাকে, তার সঙ্গে থাকে সোনালি রোদের মিষ্টি আভা। আবার বর্ষায় চারদিক জেগে ওঠে সবুজের সমারোহ। এ সময় প্রকৃতি ফিরে পায় আরেক নতুন যৌবন। বর্ষায় মূলত অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিস্টদের পদচারণা সবচেয়ে বেশি থাকে এ পার্বত্য অঞ্চলে। আমাদের পার্বত্য এলাকায় পর্যটন এখনো পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের সংখ্যা প্রায় ১৪৫ কোটি। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ২০০ কোটির বেশি হবে। এই খাতে ২০২৩ সাল নাগাদ প্রায় ৩০ কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। আর এ পর্যটকদের একটি বড়ো অংশ ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশ গুলোতে। বাংলাদেশকে এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে। ভ্রমণ পিপাসু এসকল পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে আন্তর্জাতিকমানের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো পর্যটনকে প্রাধান্য দিয়ে দেশি অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। অথচ আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটন থেকে আসে। এখাতে ভারতের বার্ষিক আয় প্রায় ১০ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আর আমাদের বার্ষিক আয় প্রায় ৭৮.১৯ মিলিয়ন ডলার, যা সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। বাংলাদেশর পর্যটন শিল্পে সরাসরি কর্ম প্রায় ১.৮ মিলিয়ন মানুষ, পরোক্ষভাবে জড়িত আছে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন জনবল। করোনাকালে পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আসার কথা বর্তমানে এইখাত আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ বর্তমান পর্যটন স্পটের উন্নয়ন ও নতুন পর্যটন স্পট চিহ্নিত করতে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন রিসোর্ট ও সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে; অধিকাংশ এলাকায় মোবইল নেটওয়ার্ক এবং বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। যার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াত এবং অবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ১১টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর জনগণ বসবাস করে। তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। তাছাড়া পার্বত্য এলাকার জীববৈচিত্র রয়েছে। পর্যটন বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবেশ, জীববৈচিত্র ও উপজাতীয় ঐতিহ্য যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য, দেশের পার্বত্যাঞ্চলে প্রায়ই পাহাড় কাটার খবর মিডিয়ায় আসে। যা খুবই উদ্বেগজনক। পাহাড় কাটার ফলে বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে, ভূমি ধসের ঘটনাও ঘটছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাছাড়া, পাহাড় পর্বত ধ্বংসের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে, পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশার কথা সরকার এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। পাহাড়, নদীসহ যে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সজাগ, সচেতন ও তৎপর।
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে সকলের সঙ্গে নিরলস কাজ করছে সরকার। স্বপ্লোন্নত দেশ থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে রুপান্তরিত হয়েছি। পাহাড়ি অঞ্চলের এই জীববৈচিত্র ও অপার সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, অত:পর ভিশন-২০৪১ অর্জন, সর্বোপরি ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের লক্ষ্য অর্জনে আমরা সক্ষম হবো এটা হোক আমাদের অঙ্গীকার। আমরা পাহাড়ে যেতে সবসময় উদগ্রীব। সে জন্যই আমাদের উচ্চারণ কবে যাবো পাহাড়ে, আহা রে।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়