‘আলীকদম’ নামকরণ কীভাবে হলো
বান্দরবান জেলার আরণ্য জনপদ ‘আলীকদম’ উপজেলা। পূর্বদিকে চিম্বুক রেঞ্জ এবং পশ্চিমে মিরিঞ্জা রেঞ্জের পর্বতসারির মাঝে সবুজাভ অরণ্যভ‚মি গিরিনন্দিনী ‘আলীকদম’। এ জনপদ অন্তবিহীন মৌণ নিস্তব্দ সৌন্দর্য আর দিগন্ত বিস্তৃত গ্রন্থিল পর্বতে ভরপুর।
সূদুর অতীতে খরস্রােতা মাতামুহুরীর এ উপত্যকায় জনবসতি গড়ে উঠেছিল। সবুজের অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কবে, কীভাবে এবং কাদের মাধ্যমে এই আরণ্যক জনপদের নাম ‘আলীকদম’ হলো! এ প্রশ্ন অনেকের।
‘আলীকদম’ নামকরণ নিয়ে একাধিক মতামত আছে। তবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং ইতিহাসনির্ভর মত হলো মোগল শাসনামলের সাথে সম্পৃক্ত ১৬৬০-১৬৬১ সালের একটি অধ্যায়।
আমরা মোগল ইতিহাস, স্থানীয় জনশ্রুতি ও তথ্য-উপাত্তের আঙ্গিকে ‘আলীকদম’ নামকরণ নিয়ে নিম্নে আলোচনা করবো।
১.
‘আলীকদম’ নামকরণের আদ্যোপান্ত জানতে হলে ১৬৬০-’৬১ সালের মোগল ইতিহাসের অন্যতম একটি অংশের সাথে আমাদের আগে ওয়াকিবহাল হতে হবে।
আমরা মোগল ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ শেষে ‘আলীকদম’ নামকরণ প্রসঙ্গে উপনীত হবো। এ বয়ান ছাড়া সুদূর অতীতে গহীন অরণ্যানীতে ‘আলীকদম’ নামকরণ কীভাবে হলো তা জানা যাবে না!
মোগল শাসনামলের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৬৫৭ সালে ভারতবর্ষের স¤্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর চার পুত্রের মধ্যে রাজ সিংহাসন দখলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
আওরঙজেব দিল্লীর সিংহাসন দখল করে প্রতিদ্বন্ধী ভাই শাহজাদা দারা ও মুরাদকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
শাহজাহান পুত্র বাংলার সুবেদার শাহ সুজাও জড়িয়ে যান দিল্লীর সিংহাসন দখলের এ যুদ্ধে।
কিন্তু ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলার কাছে শাহ সুজার বাহিনী হেরে যায়।
১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা পিতৃঐতিহ্য দিল্লীর সিংহাসন দখল নিয়ে আপনভাই সম্রাট আওরঙ্গজেবের ক্ষমতালিপ্সায় নিরাশ হয়ে পড়েন।
ফলে ৬ মে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি লক্ষাধিক সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র সমেত অনুগত বিশাল বহর নিয়ে আরাকান যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। পথিমধ্যে বহরের একটি অংশ রণেভঙ্গ দেয়।
১৬৬০ সালের ৩ জুন ফেনী নদী পার হয়ে আরাকান রাজ্যে প্রবেশ করেন শাহ সুজার বাহিনী। ঐ সময় ফেনী নদী পর্যন্ত ছিল আরাকান রাজ্যের সীমানা।১
আরাকান রাজ্যে প্রবেশ করার সময় শাহ সুজার অনুগত সৈন্য এবং মোগল বাহিনীতে ছিল সেনাপতি ফতে খাঁ, শেরমস্ত খাঁ, গোলাম হোসেন খাঁ, শের জব্বার খাঁ, নুরুল্লা খাঁ, শের দৌলত খাঁসহ ১৮ জন সেনাপতি।
১৬৬০ সালের ১৬ জুন (৬ রমজান) শাহ সুজা তাঁর অনুগত বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দর শহর দেয়াঙ-এ (বর্তমানে আনোয়ারা উপজেলা) প্রায় আড়াই মাস অবস্থান করেন।
আওরঙজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলা আরাকান রাজাকে এই মর্মে চাপ দেন যে, শাহ সুজাকে হস্তান্তর করতে হবে, নচেৎ আরাকান আক্রমণ করা হবে। ফলে শাহ সুজা দেয়াঙ-এ অবস্থানকালে তাঁর নির্দেশে মোগল সৈন্যরা পাহাড়ি জঙ্গল কেটে সড়কপথ তৈরী করেন। এ সড়কটি ‘শাহ সুজা সড়ক’ নামে পরিচিত ছিল।
উল্লেখ্য, ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা চট্টগ্রাম দখলের পর শাহ সুজার সড়কের নাম ‘আরাকান সড়ক’ নামকরণ করেন। কারণ ব্রিটিশরা মোগলবিরোধী ছিল।
রাস্তা তৈরী হলে শাহ সুজার অনুগত মোগল বাহিনী দু’দলে বিভক্ত হয়ে আরাকানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। অগ্রগামী দলে ছিলেন সেনাপতি ফতে খাঁ, সেনাপতি শেরমস্ত খাঁ ও সেনাপতি গোলাম হোসেন খাঁ।
অপর দলের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং শাহ সুজা। সাথে ছিল তাঁর আত্মীয়-পরিজন ও বিশাল মোগল বাহিনী। মোগল বাহিনী যাত্রাপথে কক্সবাজারের রামুতে অবস্থান নেন।
পরবর্তীতে নানান চড়াই-উৎরাই শেষে শাহ সুজা নিকটাত্মীয় ও গার্ড রেজিমেন্টের কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে নাফ নদীর তীরে উপস্থিত হন। ঐ সময় আরাকানের রাজা ছিলেন থিরিসান্দথুধম্মা (শ্রীচন্দ্রসুধর্মা)।২
আরাকান রাজা শ্রীচন্দ্রসুধর্মার শর্তানুযায়ী নাফ নদীর তীর থেকে ২০০ জন কারো কারো মতে ৮০ জন নিরস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে শাহ সুজা আরাকানের রাজধানী ¤্রােহং-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
সেখান থেকে বিদায় নেন সেনাপতি ফতে খাঁ সহ ১৮ জন সেনাপতি ও মোগল বাহিনী। ১৬৬০ সালে ২৬ আগস্ট শাহ সুজা নিরস্ত্র অবস্থায় আরকানের রাজধানী ম্রোহং-এ পৌঁছান।
রামুতে রয়ে যায় সেনাপাতি ফতে খাঁর নেতৃত্বে মোগল বাহিনীর ‘সৈয়দ দল’। তারা তথায় দুর্গ স্থাপন করে অপেক্ষমান ছিল।
উল্লেখ্য যে, ঐ সময় আরকানে চাকমারা বিতাড়িত হয়ে রামুতে ও খরস্রােতা মাতামুহুরীর উপনদী তৈনখাল উপকুলে মানবেতর জীবন যাপন করছিল। পরে এরা মোগল বাহিনীর অনুগত হয়ে পড়ে।
এদিকে, ম্রোহং-এ অবস্থানকালে মোগল রাজপুত্র শাহ সুজার রাজকীয় ঐশ্বর্য্য দেখে স্থির থাকতে পারলেন না আরাকান রাজা শ্রীচন্দ্রসুধর্মা। শাহ সুজার অপরূপ সুন্দরী কন্যা আমেনার রূপ দেখে আরাকান রাজা আরো অস্থির হয়ে উঠলেন।৩
এরপর শুরু হয় আরাকানের রাজধানীতে বাংলার সুবেদার নবাব শাহ সুজা ও তার পরিবারবর্গের করুণ অধ্যায়।
শাহ সুজার কাছে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব পাঠান আরাকান রাজা। কিন্তু মোগল বংশের কন্যা সম্প্রদানে শাহ সুজার পরিবার অসম্মতি জানান।
এতে আরাকান রাজা ও সুজার পরিবারের মধ্যে বিরোধ চরমে উঠে। যুদ্ধ হয়ে পড়ে অনিবার্য।
আরাকানের রাজা তিনদিনের মধ্যে শাহ সুজাকে ম্রোহং ছেড়ে আরাকান ত্যাগের নির্দেশ দেন।
ঘটনার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ম্রোহং-এ আশ্রয়ের ছয় মাসের মধ্যে বাংলার সুবেদার শাহ সুজার জীবন বিপন্ন হয়ে উঠে।
১৬৬১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে আরাকান বাহিনীর অভিযানে শাহ সুজা সস্ত্রীক প্রাণ হারান। আবার এমনও জনশ্রতি আছে আরাকান বাহিনী শাহ সুজা ও স্ত্রী পরিবানুকে ধরে নদীতে ডুবিয়ে মারেন।৪
এরপর রামুতে অবস্থানরত মোগল যোদ্ধাদের সাথে আরাকানী সৈনিকদের খন্ডখন্ড যুদ্ধ বেঁধে যায়। ফলে মোগল যোদ্ধারা কৌশল অবলম্বন করে ১৬৬১ সালে রামু ত্যাগ করে প্রায় ৬০ মাইল পূর্বে গভীর অরণ্যে দূর্গ স্থাপন করেন। এ সময় দূর্গম অরণ্যঘেরা এবং মাতামুহুরী উপত্যকাভ‚ক্ত এ জনপদের কোন নাম ছিল না।
রামু থেকে আগত মোগল যোদ্ধাদের বেশীরভাগই ছিলেন ইরান বংশোদ্ভুত শিয়া সম্প্রদায়ভ‚ক্ত। তারা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) কে ধর্মীয় নেতা হিসেবে প্রধান্য দিতেন।
যার কারণে তারা হযরত আলী (রাঃ) নামানুসারে এই অরণ্যঘেরা এলাকার নামকরণ করেন ‘আলীকদম’।
বর্তমনে বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলা বাংলার সুবেদার নবাব শাহ সুজার সহযোদ্ধা মোগলদের স্মৃতির স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।৫
উল্লেখ্য যে, ঐ সময় আরকান বিতাড়িত চাকমারা রামুর ‘চাকমারকুল’ থেকে মোগল যোদ্ধাদের সাথে আলীকদম চলে আসেন।
১৬৬১ সালের পর মোগল যোদ্ধারা আলীকদমে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আরাকান বিতাড়িত চাকমারা ছিলেন তাদের প্রজা। এভাবেই মোগল যোদ্ধারা সুদূর অতীতে হয়ে যান পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমিয়াদের ‘রাজা’।৬
সুতরাং মোগল ইতিহাসের এ অংশটির সাথে মিল রেখে বলা যায় যে, মোগল যোদ্ধাদের দ্বারা ‘আলীকদম’ নামকরণ হয়েছিল ১৬৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে।
কারণ ১৬৬১ সারের ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে আরাকান বাহিনীর অভিযানে শাহ সুজা সস্ত্রীক প্রাণ হারান। এরপরই মোগল যোদ্ধারা অরণ্য পাড়ি এ এলাকায় এসেছিলেন। ইতিহাস তাই বলে।
মোগল যোদ্ধাদের আলীকদম আগমন, নির্গমন ও জুমিয়াদের নিয়ে পার্বত্য এ জনপদে জমিদারি প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ইতিহসের পরবর্তী খন্ডচিত্র আমরা এ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য পর্বে বিধৃত করবো।
‘আলীকদম’ নামকরণ প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত মোগল ইতিহাসের পাঠ শেষে আমরা এবার অন্যান্য জনশ্রুতি নিয়ে আলোকপাত করছি।
২.
‘আলীকদম উপজেলা’ সদরে মাতামুহুরী নদী ও তৈনখলের মোহনা ঘেঁষে পূর্ব দক্ষিণ কোণে একটি পাহাড় আছে। যার নাম ‘আলীর পাহাড়’।
সাংবাদিক, গবেষক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বহুগ্রন্থ প্রণেতা আতিকুর রহমান তাঁর এক অনুসন্ধানী নিবন্ধে ‘আলীর পাহাড়’ নিয়ে ‘অনুসন্ধানঃ আলীকদম ও তৈনছড়ি’ শীর্ষক গবেষণা সন্দর্ভে কৌতিহলোদ্দীপক তথ্য উল্লেখ করেছেন।৭
ধারাবাহিকভাবে তাঁর এ সন্দর্ভ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ‘দৈনিক গিরিদর্পণ’ পত্রিকায়।
পার্বত্য গবেষক আতিকুর রহমানের মতে, ‘আলীর পাহাড়’ নামকরণ থেকে এতদাঞ্চলে মুসলিম ঐতিহ্যমন্ডিত সভ্যতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এককালের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে কি করে ‘আলীর পাহাড়’ নামকরণ হলো তা বিস্ময়কর। এ নামটি অবিকৃত অবস্থায় আছে।
‘আলীর পাহাড়’ এর সাথে সঙ্গতিশীল নাম হলো ‘আলীকদম’।
‘আলীকদম’ যদিও মঘী উচ্চারণে বিকৃত রূপ নিয়ে ‘আলোহক্যডং’ হয়েছে। আরকানী ভাষায় অনেক পাহাড় ও জায়গার নামের শেষে ডং, থং বা দং উপসর্গটি জুড়ে আছে। মার্মা ভাষায় সম্ভবত: ‘ডং’ মানেই পাহাড়।
তাই আলীর পাহাড়ই মঘী ভাষায় ‘আলেহ্ডং’। তা থেকে ‘আলেহকেডং’ বা ‘আলেহখেদং’ বিকৃতি।’৮
পার্বত্য রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার ২৫টি উপজেলার মধ্যে ‘আলীকদম’ নামটি আরবী এবং মুসলিম ঐতিহ্যমÐিত! ‘আলী’ এবং ‘কদম’ দু’টি আরবী শব্দ। শব্দ দু’টির মিলিত রূপ ‘আলীকদম’।
৩.
পর্তুগীজ পন্ডিত জোয়াও জে বারোজ (Joao De Barros) কর্তৃক ১৫৫০ সালে অংকন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রথম মানচিত্র (ঊহংবধ উবঃ ইবহমধষষধ) এ মানচিত্রে ‘আলীকদম’কে ‘লোভাস ডোকাম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
‘লোভাস ডোকাম’ তা ‘আলীকদম-’রই পর্তুগীজ ভাষ্য বলে ধরা হয়। আলেহক্যডং এর নয়।
আলীকদম এর মঘী উচ্চারণ ‘আলেহ ক্যডং’ হয়ে যাওয়া সম্ভব। মঘী ভাষায় এর অর্থ করা কষ্টকল্পনা মাত্র।
‘আলীর পাহাড়’ আর ‘আলীকদম’ উভয় নামই শব্দগত দিক দিয়ে মুসলিম ঐতিহ্যমন্ডিত।৯
৪.
অনেকে মতে, ‘আলোহক্যডং’ থেকে আলীকদম নামের উৎপত্তি। যার অর্থ পাহাড় ও নদীর মধ্যবর্তী স্থান।
এ নামের সঙ্গে পার্বত্য এলাকার অনেক পাহাড়ের নামকরণের সাদৃশ্য আছে। যেমন: কেউক্রাডং, মেরাংডং, পেরাইডং, তাজিংডং প্রভৃতি।
বান্দরবান বোমাং সার্কেলের বোমাং চিফের নথিপত্রে ও ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আঁকা মানচিত্রে এই ‘আলোহক্যডং’ নামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
৫.
ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি.এইচ. লুইন এর মতে, ‘Alley Kingdom’ থেকে ‘অষরশধফধস’ নামকরণ করা হয়েছে। তার মতে, Alley অর্থ দমন, Kingdom মানে রাজ্য।
প্রাচীন জনপদ আলীকদমের তৈনখালের তীরে মাতামুহুরী নদী অববাহিকায় তৈন সুরেশ্বরী নামে একজন রাজার শাসন ছিলো। এটি পরে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যশক্তিতে রূপ নিয়ে তৈনখাল-মাতামুহুরী তীরে রাজধানী স্থাপন করেছিল।
কথিত আছে যে, মোগল আমলের সুবেদারই বাংলার সম্রাট শায়েস্তা খাঁ সাধারণ এবং ক্ষুদ্র একটি রাজ্য শক্তিকে (রাজনৈতিক সুরেশ্বরী রাজ্যকে) করায়ত্ব বা দমন করেন।
এই ক্ষুদ্র রাজ্যশক্তির অবস্থান ছিল মাতামুহুরী এবং তৈনখাল তীরবর্তী এলাকা। সেখানে বাঁশ বেতের সিংহাসন পেতেছিলেন রাজা তৈন সুরেশ্বরী! তাই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে এ অঞ্চলের নাম হয় ‘Alleykingdom’ বা দমন করা রাজ্য।১০
৬.
আরকান ও সুলতানি আমলের ইতিহাস মতে জানা যায়, ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ একশত বছর বাংলার ইলিয়াস শাহী রাজ বংশের অধীনে ছিলো আরাকান। সেই সময় আরাকান রাজারা বাংলার শাসকদের নিয়মিত কর প্রদান করতো।
১৮ জন আরকানী রাজা তাঁদের শাসন কার্যের সুবিধার্থে মুসলিম উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
১৪৪০ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের যুব রাজ নরমিখলা বাংলার প্রথম রাজধানী গৌড়ীয় সৈন্যবাহিনীর সহায়তায় সোলাইমান শাহ নাম ধারণ করে ¤্রাউক-উ রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
বলা বাহুল্য, আরাকানের রাজা মাং খারি’র মুসলিম উপধি ছিল ‘আলী খান’ রাজা থাজাথা’র মুসলিম উপাধি ছিল ‘আলী শাহ্’। এ রাজাদ্বয়ের কারো প্রভাব প্রাচীন এ অরণ্যে পড়েছিল কিনা সঠিক তথ্যসূত্র নেই। তবে তাদের নামকরণের অংশ থেকেও ‘আলীকদম’ নামের সৃষ্টি হতে পারে।১১
৭.
অনেকের মতে, প্রাচীনকালে ‘আলী’ নামের কেউ এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। যার ফলশ্রæতিতে ‘আলী’ নামের সাথে ‘কদম’ শব্দটি যোগ হয়ে ‘আলীকদম’ হয়েছে।
আরবীতে ‘কদম’ অর্থ পা, যাকে পদচারণাও বলা যায়।
সুতরাং বলা যায়, আলী নামের কেউ সভ্যতার সূচনালগ্নে এখানে সর্বপ্রথম পদচারণা করেছিলেন।
এ ধারণা ১৬৬১ সালে মোগল আমলে শাহ সুজার সেনাপতি ফতে খাঁর নেতৃত্বে যে দলটি রামু থেকে পূর্ব দিকের পাহাড়ি অরণ্যে ঢুকে পড়েছিল সেই ইতিহাসকে প্রতিপাদ্য করে।
মোগল বাহিনীর শিয়া মতাবলম্বীরাই এ অরণ্য জনপদের নাম হযরত আলীর নামানুসারে ‘আলীকদম’ নামকরণ করেছিল বলে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
৮.
মতান্তর রয়েছে যে, ৩৬০ আউলিয়া উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। এঁদের একটি দল চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশান উড়িয়েছিলেন।
এঁদেরই মধ্যে হয়ত ‘আলী’ নামের কোন সাধক পাহাড়ি এ অঞ্চলে এসেছিলেন; যাঁর পদধুলিতে ধন্য হয়ে ‘আলীকদম’ নামকরণ হয়েছে।
চাকমা লোকগাঁথা সূত্রে বর্ণিত হয়, মাতামুহুরী তীরের বারটি গ্রামেই তারা প্রথমে স্থানীয় মুসলিম অধিপতিদের আনুকুল্যে বসতি স্থাপন করেন।
বলা হয়ে থাকে, তৈন সুরেশ্বরী বা তৈন শের আলী ছিলেন এতদাঞ্চলীয় চাকমাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রধান।
যেহেতুন তিনি ছিলেন তৈনখাল বা তৈনছড়িবাসী চাকমাদের প্রধান এবং তার আবাসস্থলও ছিলো তৈনখাল-মাতামুহুরীর সংযোগস্থল তীরবর্তী ‘আলীর পাহাড়ে’।
এ জনপদের আরেক সামন্ত চন্দন খান নিজের উপাধি ‘তৈন খান’ উপাধি ধারণের উদাহরণও বিদ্যমান।
একজন গর্বিত দলপতির অর্থহীন স্ত্রীবাচক নাম কোনমতেই মানানসই ও কাম্য নয়। …আভিজাত্যের সাথে মানানসই নাম ‘তৈন সুরেশ্বরী’ নয়, ১‘তৈন শের আলী’ হওয়া সম্ভব।১২
এ ধারণা থেকেও অনুমান করা যায় যে, ‘তৈন শের আলী’র আবাসস্থল ‘আলীর পাহাড়’ থেকেও ‘আলীকদম’ নামকরণ হতে পারে!
৯.
জনশ্রুতি আছে, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (র.) আলীকদম এসেছিলেন! তার নামানুসারে ‘আলীকদম’ নামকরণ হতে পারে। তবে এ দাবী ইসলামের ইতিহাস মতে সমর্থনযোগ্য নয়।
ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত মত হলো- মহানবী (সা.) জীবিত থাকা অবস্থায়ই এদেশে ইসলামের দাওয়াত এসে পৌঁছায়।
নবুওয়াতের সপ্তমবর্ষে (৬১৭ খ্রিস্টাব্দে) সাহাবী হজরত আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের (রা.) চীনে আগমনই এ কথার পক্ষে জোরালো প্রমাণ বহন করে।
সাহাবী হজরত কাসেম ইবনে হুজাইফা (রা.), উরওয়া ইবনে আসাসা (রা.), আবু কায়েস ইবনুল হারিসও (রা.) এ সফরে তার সঙ্গী ছিলেন।
ইতিহাস মতে, চীনে যাবার পথে এই সাহাবীরা চট্টগ্রাম ও সিলেট নোঙ্গর করেছেন। তাদের সান্নিধ্যে এসে কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এখান থেকেই বাংলাদেশ ইসলামের যাত্রা।১৩ সুতরাং পূর্বোক্ত জনশ্রুতির সত্যতাকে মেনে নেয়া যায় না।
সার্বিক পর্যালোচনায় বলা যায়, ‘আলীকদম’ নামকরণ হয়েছিল সুবেহ বাংলার সুবেদার শাহ সুজার আরাকানে করুণ পরিণতির পরবর্তী প্রেক্ষাপটেই।
রামু থেকে সেনাপতি ফতে খাঁর নেতৃত্বে যে দলটি দুর্গম পাহাড়ি অরণ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার ইতিহাসই অনেকখানি নির্ভরযোগ্য।
মোগল রাজবংশের ইতিহাসের এই অংশকে অনেক ঐতিহাসিকরাও মেনে নিয়েছেন।
সুতরাং বলা যায়, মোগল বাহিনীর শিয়াপন্থী অনুসারীরাই ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে এ জনপদের নাম ‘আলীকদম’ নামকরণ করেছিলেন!
তথ্যসূত্র:
১। জামাল উদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, একুশের গ্রন্থমেলা ২০১৯।
২। ড. আহমদ শরীফ, বাঙ্গালী ও বাংলা সাহিত্য (২য় খন্ড) [১৯৮৩]।
৩। পিয়ের ব্যাসনেত, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি (বঙ্গানুবাদ), পৃ.- ১১০।
৪। চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা, চট্টগ্রামের ইতিহাস, ভ‚মিকা, পৃ.-৭।
৫। জামাল উদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, একুশের গ্রন্থমেলা ২০১৯।
৬। প্রাগুপ্ত।
৭। মমতাজ উদ্দিন আহমদ, প্রেক্ষণ: পার্বত্য চট্টপগ্রাম গিরিনন্দনী আলীকদম, পৃ.-১৭, একুশে বইমেলা- ২০০৮।
৮। আতিকুর রহমান, অনুসন্ধান: আলীকদম ও তৈনছড়ি-৩, ২৮ নভেম্বর ১৯৯৯, দৈনিক গিরিদর্পণ।
৯। প্রাগুপ্ত।
১০। মমতাজ উদ্দিন আহমদ, প্রেক্ষণ: পার্বত্য চট্টপগ্রাম গিরিনন্দনী আলীকদম, একুশে বইমেলা ২০০৮।
১১। প্রাগুপ্ত।
১২। আতিকুর রহমান, অনুসন্ধান: আলীকদম ও তৈনছড়ি-৬, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯৯, দৈনিক গিরিদর্পণ।
১৩. ড. মোহাম্মদ হান্নান, প্রাচীন বাংলায় মুসলিম আগমন (১ম খন্ড), বইমেলা ২০১৯।