কল্পনা চাকমা স্বেচ্ছায় নির্বাসিত

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত একটি নাম হল কল্পনা চাকমা। প্রতি বছরের মত এ বছরও কল্পনা চাকমা অপহরণের সাজানো নাটক নিয়ে উপজাতি সন্ত্রাসী মহলের অপতৎপরতা দেখতে পাচ্ছি। কিছুদিন ধরে কল্পনা চাকমা ইস্যুকে কেন্দ্র করে তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে (ফেইসবুক) বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে। কে এই কল্পনা চাকমা? কেন তাকে নিয়ে এত মাতামাতি?

কল্পনা চাকমার সবচেয়ে বড় পরিচয় হল তিনি ছিলেন তৎকালীন শান্তিবাহিনীর অঙ্গ সংগঠন হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদিকা। রাজনৈতিক, আন্দোলন ও নেতৃত্বে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু  এই নেতৃত্ব কল্পনা চাকমা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে ১১ জুন মধ্যরাতে নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। অবশ্য কেউ কেউ বলে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান হয়েছেন। জেনে নেয়া যাক অনুসন্ধান কি বলে:

কল্পনা চাকমার প্রেমিক (পরবর্তীতে স্বামী) অরুণ বিকাশ চাকমা ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সাথে জড়িত ছিলেন। অরুণ চাকমা বেশ কয়েকবার কল্পনা চাকমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। কল্পনা এবং অরুণ দুজনের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। এই সম্পর্কের কথা কল্পনার বাড়িতে জানাজানি হলে কল্পনার পরিবার সে সম্পর্ককে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

অপরদিকে তৎকালীন তরুণ সেনা অফিসার লে. ফেরদৌস বেশ কিছু সফল অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন উগলছড়ি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার। নির্বাচনের উদ্দেশ্যে তার ঐ ক্যাম্পে আগমন। খুব তাড়াতাড়ি তার এই সফলতা শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির মধ্যে চিন্তার উদ্রেক করে। পরবর্তিতে তাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তার গাড়ির বহরের উপর বেশ কয়েকবার এম্বুশ করে পিসিপি এবং শান্তিবাহিনী। কিন্তু তার কোন ক্ষতি করতে পারে নি তারা। ফলে তারা ফন্দি আটতে থাকে কিভাবে লে. ফেরদৌসকে কোন বিতর্কে জড়িয়ে তাকে এলাকা ছাড়া করা যায়।

অপরদিকে কল্পনা চাকমা হিল উইমেন ফেডারেশানের সদস্য এবং তাদের নিজস্ব প্রার্থী বিজয় কেতন চাকমার প্রচার চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রচার চালাচ্ছিলেন। যার কারণে তিনি অতি দ্রুত সবার নজরে চলে আসেন। ফলে ‘সতীনের ছেলেকে বাঘ মারতে পাঠানোর‘ বাংলা প্রবাদের মতো তাকে ঘিরেই ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা সাজায় আঞ্চলিক সংগঠনটি। বিষয়টি টের পেয়ে তৎকালীন শান্তিবাহিনী ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)‘র কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীর সহায়তায় এবং পরিকল্পনায় প্রেমিক অরুণ বিকাশ চাকমার কাছে কল্পনা চাকমা পালিয়ে যান। যাকে অনেকটা স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান বলা যায়। বিষয়টি তার পরিবারের সকলেই জানে।

এ ঘটনায় প্লট পরিবর্তন করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য শান্তিবাহিনী এবং পিসিপি সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে মিথ্যা অপহরনের নাটক মঞ্চস্থ করে। যার প্রথম ধাপ ছিল ১২ জুন ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা চাকমার ভাই কালিন্দা কুমার চাকমা বাঘাইছড়ি থানার মামলা (মামলা নং-২/৯৬১)।

পরবর্তীতে কল্পনা চাকমা নিখোঁজের ব্যাপারটিকে নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। এক পর্যায়ে তদন্ত কমিশন কল্পনা চাকমার মাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কল্পনা চাকমার মা শান্তিবাহিনী ও পিসিপির চাপে পরে উপরোক্ত ঘটনাটি আড়াল করেন এবং তদন্ত কমিটিকে জানায়, যে রাতের বেলা কিছু লোক অস্ত্র হাতে, লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় তার বাড়িতে দরজা কেটে প্রবেশ করে কল্পনাকে নিয়ে যান। সাথে কল্পনার দুই ভাইকেও নিয়ে যায়। কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পর তার ভাইদের পাঠিয়ে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ তার মা তিনটি গুলির আওয়াজ পান। এখানে মজার ব্যাপার হল যে, গুলির আওয়াজ তিনি একাই পেয়েছিলেন। তার আশেপাশের কেউ এই আওয়াজ পান নি। তিনি আরো বলেন যে, ‘যারা এসেছিল তাদের কন্ঠস্বর নাকি সেনাবাহিনীর মত‘। যাই হোক, সময়ের সাথে চলতে থাকে তদন্তের কার্যক্রম।

এলাকাবাসীর মন্তব্য এবং কল্পনার পরিবারের কথায় যখন তদন্ত কমিটি সন্দিহান হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই ১ আগস্ট ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা তার মার সাথে যোগাযোগ করে এবং জানায় যে, সে ভাল আছে। (বিষয়টি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রকাশিত)

৮ আগস্ট ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা চাকমাকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গংগাছড়া মহাকুমার ৪ মাইলের শুক্রে নামক এলাকায় দেখা যায়।

৯ আগষ্ট ১৯৯৬ তারিখে বিভিন্ন পত্রিকায় কল্পনা চাকমা বেঁচে আছে বলে খবর প্রকাশিত হয়। এবং শুধু তাই নয়, কিছু কিছু পত্রিকায় সেনাবাহিনীর কোন সম্পৃত্ততা নেই বলে মত প্রকাশ করে।

২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ তারিখে অরুণাচল থেকে লিখিত একটি চিঠিতে কল্পনা চাকমা উল্লেখ করেন যে, প্রায় দেড় মাস খানেক আগে তিনি মা হয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, আত্মীয়দের স্বজনদের নিষেধ অমান্য করে বিয়ে করায় নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।

১৪ জুন ১৯৯৬ তারিখে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি লেখাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে হিল উইমেন্স ফেডারেশন একটি লিফলেট (১০ জুন ২০০৬) বিতরণ করে। যেখানে তারা দাবি করে, ত্রিপুরার এক সেনা কর্মকর্তা সাংবাদিক আবেদ খানকে নিশ্চিত করেছেন যে, কল্পনা চাকমাকে সেনাগোয়েন্দারা ত্রিপুরায় অক্ষত অবস্থায় দেখে এসেছে। এমনকি কল্পনা চাকমা অবশ্যই বেঁচে আছে এ খবর নিশ্চিত করেছেন।

তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটি যখন কল্পনা চাকমার বাসায় যায় তখন তার ব্যবহৃত কোন প্রকার ব্যবহার্য দ্রব্য পাওয়া যায় নি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, অপহরণকারীরা যদি অসৎ কোনো উদ্দেশ্যেই তাকে তুলে নিয়ে যাবে তাহলে তার ব্যবহার্য দ্রব্যাদি কেন নিয়ে যাবে?

শুধু তাই নয়, তদন্ত কমিটি এক পর্যায়ে কল্পনা চাকমার ভারতে থাকার সুত্র পান এবং তাকে দেশে ফিরে আসার জন্য চিঠি লিখেন। ফিরতি চিঠিতে কল্পনা চাকমা লিখেন, তিনি ফিরে আসতে চান। কিন্তু ফিরে আসলে শান্তিবাহিনী তাকে হত্যা করে ফেলবে। এই ভীতি থেকেই তিনি দেশে আসেন না।

উপরক্ত বিষয়গুলো পর্যালচনা করলে দেখা যায়, কল্পনা চাকমা আসলে নিজে নিজেই পালিয়ে গিয়েছিলেন। যার কারণ দুইটি। একটি হল তার ভালবাসাকে তার পরিবার বিবাহের সম্পর্কে আবদ্ধ করতে চান নি এবং শান্তিবাহিনীর একটি চাপ। কারণ এখন সে যদি দেশে ফিরে আসে তাহলে শান্তিবাহিনীর সকল বানোয়াট ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ নিয়ে শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির সকল প্রকার প্রচারণাই ভুল এবং বানোয়াট। তাই সকলের উচিত এই ভুল প্রচারণাকে উৎসাহিত না করা। কেননা, কল্পনা চাকমা এখনো বেঁচে আছেন এবং বেশ ভাল আছেন।

♦ লেখক- খাগড়াছড়ি থেকে

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কল্পনা চাকমা, কল্পনা চাকমা অপহরণ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন