ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী উদ্যোক্তার সফলতার গল্প
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের মণিপুরী সম্প্রদায়ের মেয়ে লাংজ্জাম পুষ্পি। অনলাইনে ব্যবসা করছেন ঘরে বসেই। মণিপুরি কাপড়ের জমজমাট ব্যবসা তার। অনলাইন প্লাটফর্মে ‘নুংশি ফিজোল’ দিয়ে নুংশি কন্যা হিসেবে মণিপুরি কাপড়ে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। পথচলার শুরুটা যেভাবেই হোক না কেন, এখন তিনি মণিপুরি সম্প্রদায়ের সফল নারী উদ্যোক্তা।
মণিপুরি সম্প্রদায়ে নারী উদ্যোক্তা হওয়া মোটেও সহজ নয়। পদে পদে কাঁটা বিছানো। তবু তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। কোনো বাধাই তাকে আটকাতে পারেনি। পড়াশোনার পাশাপাশি কোচিং সেন্টার খোলেন এবং ব্যাংক এশিয়ায় চাকরি করতেন। বিএসএস ফাইনাল পরীক্ষার সময় তিনি জব ছেড়ে দেন। বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে বিএসএস পাস করেও আর চাকরি করেননি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, নারীরা শুধু রান্না-বান্নাই পারে না, প্রয়োজনে পরিবারের হালও ধরতে পারে।
২০২০ সালে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণে তার পরিবারের ওপর নেমে আসে অর্থনৈতিক সংকট। করোনার মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও প্রত্যয় নিয়ে নুংশি কন্যা লাংজ্জাম পুষ্পি দেখেছেন, টিকে থাকার লড়াইয়ে সফলতার সঙ্গেই তিনি হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। সবাই শুধু সফলতার গল্পই শোনেন। এর পেছনের কষ্টটা কেউ দেখেন না। দীপ্ত পদচারণায় মণিপুরি নারীরা এখন জয় করতে শিখেছেন। নারীরা পড়াশোনা করছেন, চাকরি করছেন। এমনকি স্বাধীন ভাবে উদ্যোক্তাও হচ্ছেন।
উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ও পরিবারের সাপোর্ট প্রসঙ্গে নুংশি কন্যা লাংজ্জাম পুষ্পি বলেন, আমার উদ্যোক্তা হওয়ার জার্নি সহজ বলব না। কারণ অনেকেই আমার কাজে সার্পোট করতেন। আবার অনেকেই কাজটিকে ছোট করে দেখতেন। তবে এখানে আমার পরিবার, মা, বাবা ফুল সাপোর্ট করতেন। আমি বসে থাকতে পছন্দ করি না। এটি আমার বাবা ভালোভাবেই বুঝতেন। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি বসে না থেকে কিছু করার চেষ্টা করতাম। মূলত অবসর সময় কাটানোর জন্য অনলাইন বিজনেস জগতে পা দিয়েছিলাম। যখন উই গ্রুপে যুক্ত হয়েছি; তখন থেকেই নারী উদ্যোক্তাদের পথচলার গল্প পড়ে অবসর সময়কে নিজের করে নিলাম।
ব্যবসা শুরুর যত সমস্যা
ব্যবসা শুরু প্রসঙ্গে পুষ্পি বলেন, মাত্র ২ হাজার টাকা দিয়েই কাজটি শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে যে সমস্যা হয়েছিল, সেটি ছিল পুঁজির দিক দিয়ে। তখন আমার পুঁজি ছিল খুব কম। মণিপুরি শাড়ি বা ওড়নার দাম বেশি। এ অল্প পুঁজি দিয়ে কাজ করা বেশ কষ্টের। তারপরও পরিবারকে না জানিয়ে কাজটি শুরু করা। তাই পুঁজি নিয়ে বেশ হিমশিম খাচ্ছিলাম। যখন পরিবারকে জানালাম, বাবা এ কাজে সহযোগিতা করেন ৫,০০০ টাকা দিয়ে। তখন মণিপুরি ওড়নার পর ক্রেতারা আস্তে আস্তে মণিপুরি শাড়ির সঙ্গে অন্য পণ্য চাইছিলেন। তাই বাবা আবারও ১০,০০০ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন। সেই টাকা দিয়ে মণিপুরি কিছু শাড়ি, ওড়না কিনে রাখি। তারপর আস্তে আস্তে হ্যান্ড পেইন্টের কাজও শুরু করি।
মণিপুরি ঐতিহ্য তুলে ধরার সুযোগ
উই গ্রুপে যুক্ত হওয়ার এক বছর পর সম্ভাবনাময় নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে আয়োজনে কানাডার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা টিভি চ্যানেল দেশে বিদেশের লাইভ অনুষ্ঠান ‘কাঞ্চন কন্যা’য় অংশ গ্রহণ করার সুযোগ পান। উইয়ের ৬৪ জেলার নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মিলনমেলায় ফ্যাশন শোতে নিজের পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পান পুষ্পি। তার লক্ষ্য ছিল, যাতে দেশীয় মণিপুরি পণ্য সারাদেশের মানুষ চিনুক। সামিটের ফ্যাশন শোতে ছিল হ্যান্ড পেইন্ট পাঞ্জাবি। তা-ও আবার মোইরাং পাড়ে কাজ করা। আরও ছিল মণিপুরি পোশাক, লৈফানেক, ফিদুপ এবং লৈইতারেং আর নিজের ডিজাইন করা হ্যান্ড পেইন্ট মিক্স কুর্তি।
নুংশি ফিজোলের কথা
প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে লাংজ্জাম পুষ্পি বলেন, নুংশি ফিজোল পেজের নামটি আমাদের মণিপুরি ভাষায় রেখেছি। এর অর্থ ভালোবাসার পোশাক বা পছন্দের পোশাক! অনলাইন বিজনেস পেজের বয়স প্রায় ৩ বছর। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ভোক্তারা আমাদের ও আমাদের পণ্যের প্রতি সন্তুষ্ট। আমরা তাদের সন্তুষ্টির জন্য প্রতিনিয়ত নতুন উদ্যমে কাজ করে যাচ্ছি।
পণ্যের ধরন
অনলাইনের মাধ্যমে ‘নুংশি ফিজোলে’ সব রকমের মণিপুরি পণ্য পাওয়া যায়। মণিপুরি শাড়ি, ওড়না, শাল, মাফলার, মণিপুরি ইন্নাফি। আরও আছে নিজের করা হ্যান্ড পেইন্টের পোশাক, শাড়ি, মণিপুরি কুর্তি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট। এসব জিনিসের প্রচুর সাড়া পান সামাজিক মাধ্যমে। এভাবেই পরিচিতি বাড়ে।