ত্রিপুরা গরয়া নৃত্যে পাহাড়ের বৈসুক

fec-image

ত্রিপুরাদের প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বৈসুক কেন্দ্র করেই এখন পাহাড়ে চলছে ঐতিহ্যবাহী গরয়া বা গরিয়া নৃত্য। চিনি হুকুমু, চিনি সিনিমুং (আমাদের সংস্কৃতি আমাদের পরিচয়) ও “ঐক্য শিক্ষা সংস্কৃতি ও প্রগতি” এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ কর্তৃক আয়োজিত বৈসু উৎসব -১৪৩২ ত্রিং ও য়ামুক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্যবস্থাপনায় খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে  বৈসুক উৎসবে অলশগ্রহণ করেন ৭টি দল।

অংশগ্রহণকারী ৭টি দল হলো, ১.আলমনি পাড়া ২.সাম্বারি পাড়া ৩.মাইজ্যা পাড়া ৪. হেডম্যান পাড়া ৫.চম্পাঘাট ৬.ছেট কাতারং ৭.হাজা পাড়া। সাধারণত গরয়া নৃত্যে অংশগ্রহণকারীদের খেরেবাই বলা হয়। এদিন গরাইয়া বা গরয়া নৃত্য শিল্পীদের পরিবেশনায় অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত ও মুখরিত হয়ে উঠে।

জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বৈসাবি (বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু)। পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম ত্রিপুরা। ত্রিপুরারা বর্ষবরণ উদযাপন করে বৈসুক উৎসবের মধ্যদিয়ে। এ উৎসবের অংশ হিসেবে কয়েকশ বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গরয়া নৃত্য।

রোববার (১০ এপ্রিল) বিকেলের দিকে খাগড়াপুর জে.বি রেস্টুরেন্ট প্রাঙ্গণে এ গরয়া নৃত্য উৎসব উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সভাপতি সুশীল জীবন ত্রিপুরা’র সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি সদর দপ্তর ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড জোন কমান্ডার পিএসসি লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন।

গরয়া বা গরিয়া নৃত্য উৎসবে আয়োজক কমিটির প্রতিনিধির তথ্যানুযায়ী, বৈসু উৎসবের সময় যেহেতু গরয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়, সেহেতু বৈসু উৎসব চলাকালীন সময় গরয় বা গরিয়া নৃত্য উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ নৃত্য উৎসব প্রতি বছরের ন্যায় এই বছর হচ্ছে, আগামীতেও হবে। এ উৎসবে দূর-দূরান্ত ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত গরয়া নৃত্য অংশগ্রহণকারী গরয়া বা গরিয়া দলসমূহকে পুরস্কৃত করার অর্থ হচ্ছে এ নৃত্যকে সুসংগঠিত ও বিকশিত করার লক্ষে উৎসাহিত করা। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বৈসু উৎসব ও গরয়া নৃত্য যে একে-অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটা বহুলভাব বা বৃহৎ আকারে প্রচার করার লক্ষে এ গরয়া নৃত্য উৎসবের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী, খাগড়াছড়ি রিজিয়ন (জিএস-২ আই), ও এসপি মোহাম্মদ জাহিদ হাসান, উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শানে আলম, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা, খাগড়াপুর মহিলা কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক শেফালিকা ত্রিপুরা, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও কার্বারী সুধাকর ত্রিপুরা, য়ামুক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সভাপতি প্রমোদ বিকাশ ত্রিপুরা , মেজর মো. হাসনাত, প্রেস ক্লাবের সভাপতি জিতেন বড়ুয়া প্রমুখ।

এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নারী উদ্যোক্তা ও সমাজ-কর্মী শাপলা দেবী ত্রিপুরা, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ত্রিনা চাকমাসহ আরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

জানা যায়, ত্রিপুরা জাতির আদি ধর্ম ও সংস্কৃতির চেতনাবোধের সাথে প্রাচীন জীবন -জীবিকা প্রণালী বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। এ জীবিকা প্রণালীর আদিন্তর ছিল জুমভিক্তিক কৃষি চাষ পদ্ধতি। তাই গরয়া বা গরিয়া দেবতাকে এক কথায় কৃষি দেবতাও বলা হয়। ত্রিপুরাদের বিশ্বাস গরয়া পূজা করলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পায়, কীট পতঙ্গের উপদ্রব কমে ও মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এ চেতনা নিয়ে বছর শেষান্তে বর্ষের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনাকে পেছনে ফেলে নতুন বছরে নতুন উদ্যমে কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে গরয়া পূজা ও নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো তাঁদের প্রধান দেবতা গরয়া বা গরিয়া দেবের খেরাবই নৃত্য। গরিয়া পূজায় যারা নাচে তাঁদেরকে বলা হয় খেরাবই। গরিয়া দেবের প্রতিমূর্তিকে বহন করে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায়, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে গিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। যাকে খেরবাই দল হিসেবে বেশিরভাগ অভিহিত করা হয় । এটি শুধু দেখানো হয় না, এটি ত্রিপুরাদের জীবন-জীবিকার উপর খেলা ও অভিনয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন