কক্সবাজারে মোরশেদ হত্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ

fec-image

কক্সবাজার সদরের পিএমখালীর চাঞ্চল্যকর মোরশেদ আলী ওরফে বলী মোরশেদকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনায় চিহ্নিত ‘১১ জনের সিন্ডিকেট’ নেতৃত্ব দেয়। ইফতার পর্যন্ত প্রাণে না মারার আকুতি জানিয়েও খুনের শিকার আলোচিত মোরশেদ আলী ওরফে মোরশেদ বলি হত্যায় মামলা হয়েছে

ঘটনাস্থলে উপস্থিত মানুষদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে খুনিরা বলেছিলেন, ‘উপরের নির্দেশে মোরশেদকে মেরে ফেলা হচ্ছে, তোমরা কেউ বাঁচাতে আসবে না।’

বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পিএমখালী চেরাংঘর বাজারে ইফতারি কিনতে গেলে শত শত মানুষের সামনে মোরশেদকে কুপিয়ে, পিটিয়ে হত্যা করে বীরদর্পে চলে যায় সঙ্ঘবদ্ধ ঘাতকের দল।

এ ঘটনায় গত শনিবার (৯ এপ্রিল) কক্সবাজার সদর থানায় মামলা দায়ের করেন নিহতের ছোট ভাই জাহেদ আলী। মামলায় ২৬ জনের নাম উল্লেখ ও ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১৬ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। মামলায় এ পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এদিকে, মোরশেদকে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে আলোচনায় এসেছেন দেশব্যাপী আলোচিত কক্সবাজারের ছৈয়দ মোহাম্মদ আলি ওরফে পাওয়ার আলি।

পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলাল ও ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক জয়নাল আবেদীন সরাসরি হত্যার নির্দেশদাতা বলে এজাহারে উল্লেখ আছে।

এজাহারের ভাষ্য অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত শত শত মানুষকে উদ্দেশ্য করে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তারা বলেছেন, ‘তোমরা মোরশেদ বলিকে বাঁচাতে কেউ আসবে না। তাকে মেরে ফেলার জন্য ওপরের নির্দেশ আছে।’

ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গ সংগঠনের দুই তৃণমূল নেতা ‘ওপরের নির্দেশ’ প্রাপ্ত হয়ে একজন নিরীহ ব্যক্তিকে শত শত মানুষের সামনে পৈশাচিকভাবে হত্যার ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে। পবিত্র রমজান মাসে একজন রোজাদার মানুষকে ইফতারি কেনার সময় প্রকাশ্য দিনের বেলায় এমন নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে।

আলোচিত এ মামলার ১নং সাক্ষী, বাংলাবাজারের বাসিন্দা আলি আহমেদ কোম্পানি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানা কন্ট্রাক্ট করে মোরশেদ আলিকে হত্যা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘মোরশেদ আলীকে হত্যার জন্য যে ওপরের নির্দেশের কথা বলা হচ্ছে, তিনি হলেন পাওয়ার আলী। মোরশেদ হত্যায় জড়িত সবাই দখলবাজ, ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের সদস্য। আর তাদের মূল শক্তি ও গডফাদার হলেন পাওয়ার আলী। তার নির্দেশ ছাড়া পিএমখালীর গাছের পাতাও নড়ে না, এমন অবস্থা।’

আলি আহমেদ কোম্পানি আরও বলেন, ‘ঘটনার পর যে তিনজনকে আটক করা হয় সেখানে পাওয়ার আলীর ভাই দিদারুল আলমও আছে। তার দোকান থেকে মোরশেদকে হত্যার জন্য রাখা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয় সিসিটিভি ফুটেজ।

নিহত মোরশেদের চাচাতো ভাই আবুল কালাম বলেন, ‘মোরশেদকে হত্যার আগে পাওয়ার আলীর ভাই যিনি কক্সবাজার সদর থানা কন্ট্রোল করেন বলে আলোচনা আছে, সেই মাহমুদুল করিমের সাথে খুনিদের বৈঠক হয়। মোরশেদকে হত্যার সময় থানা পুলিশ সামাল দেওয়ার জন্য মাহমুদুল থানায় বসে থাকবেন, বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা যেন ঘটনার খবর না পাই সেজন্য মাহমুদুল করিম আমার এক ভাইয়ের সাথে ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ রাখেন। যখন জেনেছেন মোরশেদ মারা গেছে তখন থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।’

আবুল কালাম আরও বলেন, ‘খুনিরা মূলত ভূমিদস্যু, দখলবাজ সিন্ডিকেটের সদস্য। যার নেতৃত্ব দেন পাওয়ার আলির ভাই মাহমুদুল করিম। তাদের সাথে রয়েছে সদর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মাহমুদুল করিম মাদু। তাদের পেছনে পাওয়ার আলী রয়েছে এমন ধারণা থেকে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস করে না। কিন্তু মোরশেদ তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে, রুখে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরো হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে। স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক মেম্বার মোহাম্মদুল হকের হাতও রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, রাজনীতির আদর্শে বিভক্ত হলেও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের পিএমখালী এলাকার নেতাকর্মীরা খুনোখুনিতে একাকার হয়ে পড়েছেন। তাও আবার হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য বিএনপি নেতা মোহাম্মদুল হকের দুই ভাই মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ ও ছৈয়দুল হক সৌদি আরব থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

মোরশেদ এক দশক ধরে পরিবার নিয়ে সৌদি আরবে প্রবাস জীবন কাটানোর পর দুই বছর আগে গ্রামে ফিরেন। তিনি গ্রামে এসে মাছের ঘেরসহ ক্ষেত-খামার শুরু করেন। এলাকায় আসার পর থেকে পানি সেচ প্রকল্প নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক মেম্বার মোহাম্মদুল হকের সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হয়।

ঘটনার সময় নিহত মোরশেদ বলী যখন চেরাংঘর স্টেশনের তরকারি দোকানের সামনে এসে কেনাকাটা করছিলেন তখনই আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল মোস্তফা আলাল এবং যুবলীগ নেতা জয়নাল আবেদীন গলিটি ঘিরে লোকজনের আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়।

এসময় দুজনই সমস্বরে বলতে থাকেন-ওপরের নির্দেশ আছে মোরশেদ বলীকে মেরে ফেলার জন্য। এমন হুঁশিয়ারির সঙ্গে সঙ্গেই মামলার এক নম্বর আসামি আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক তার হাতের লম্বা কিরিচ নিয়ে প্রথমে মোরশেদের মাথা লক্ষ্য করে কোপ মারে।

এরপর সৌদি আরব থেকে হত্যার মিশন নিয়ে আসা আসামি মোহাম্মদ আলী প্রকাশ মোহাম্মদ হাতুড়ি দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মোরশেদের অন্ডকোষে বারবার আঘাত করে। ঘটনার অন্যতম প্রধান নায়ক আসামি মোহাম্মদুল হক এ পর্যায়ে ধারাল কিরিচ দিয়ে মোরশেদের ডান হাতের কব্জিতে কোপ দিয়ে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

এরপর জাহাঙ্গীর আলম, মতিউল ইসলাম, ছৈয়দুল হক, হামিদুল হক, তাহেরুল ইসলাম, ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও মেম্বার আরিফুল্লাহ, আক্কাস, শাহিন, খোরশেদ আলম, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী প্রকাশ আলী ভাইয়ের ভাই মাহমুদুল করিম ও গ্রেফতার হওয়া দিদারুল আলম, আবদুল্লাহ, আবদুল আজিজ, আবদুল হাই, উমর ফারুক, ইয়াছিন, সাইফুল ইসলাম, ওসমান, আজহারুল ইসলাম ও জাহেদুল ইসলামসহ অন্যান্যরা ছোরা, লোহার রড দিয়ে মোরশেদকে উপর্যুপরি আঘাতে আঘাতে ঝাঝরা করে ফেলে। এলাকার লোকজনের মতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু নিশ্চিত করে সংঘবদ্ধ খুনির দল এলাকা ছাড়ে।

নিহত মোরশেদ বলীর ছোট ভাই, মামলার বাদী শিক্ষানবিশ আইনজীবী জাহেদ আলী জানান, স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ১১ জনের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এলাকাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছিল। তারাই আমাদের পরিবারের সেচ পাম্পটি দখলে নিয়ে কৃষকদের জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছিল। এমনকি সিন্ডিকেট সদস্যরাই এলাকায় করছিলেন ভূমিদস্যুতা থেকে যাবতীয় অপকর্ম।

তিনি বলেন, মোরশেদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন। তিনি সিন্ডিকেটের অবৈধ কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়েই খুনের শিকার হলেন।
মামলার বাদী জাহেদ আলী জানান, সাবেক ইউপি মেম্বার ও বিএনপি নেতা মোহাম্মদুল হক সেচ পাম্পটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তার চাচাতো ভাই এবং ইউনিয়ন যুবলীগের সহ সভাপতি আবদুল মালেকের মাধ্যমে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে সিন্ডিকেটটি গঠনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, সদর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মাহমুদুল করিম মাদু নিহত মোরশেদের জানাযার সময় খুনিদের আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করার কথা জানালেও উল্টো পিএমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা আলালল ও পাওয়ার আলির ভাইদের মামলা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদুল করিম মাদু বলেন, ‘মামলায় পাওয়ার আলীর ভাই নিরীহ মাহমুদুল করিমসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করেছে তারা। যা অন্যায় হয়েছে। নিরীহ কাউকে আসামি না করলেও পারতেন তারা।’ হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাদের বহিষ্কার করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলার কপি হাতে পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে সদর মডেল থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াস বলেন, ‘এখন আমাদের কাজ হচ্ছে খুনের সাথে জড়িতদের ধরে আইনের আওতায় আনা।’

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, মোরশেদ, হত্যা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন