এই বর্ষায় নির্ধারিত হবে মিয়ানমার জান্তা ও বিদ্রোহীদের পরিণতি?

fec-image

মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় দাওনা পাহাড়ের জঙ্গলে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যোদ্ধারা সামরিক বাহিনীর নতুন মোতায়েন করা সেনাদের আটকে রাখতে লড়াই করছে। বিদ্রোহীদের দখল করা মিয়াবতী শহর পুনরুদ্ধারে এসব সেনাদের পাঠিয়েছে জান্তা। থাইল্যান্ড সীমান্তে এই শহরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়াবতী ও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থানগুলোকে ঘিরে আগামী কয়েক সপ্তাহে যা ঘটবে তাতে হয়ত তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলমান রক্তাক্ত সংঘাতের পরিণতি এবং মিয়ানমার জান্তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো এখন জাতিগত বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে জান্তার বিরুদ্ধে লড়ছে। এসব জাতিগত গোষ্ঠীর কয়েকটি দশকের বেশি সময় ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম করে আসছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জান্তা ও প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সামনে এগিয়ে যাওয়া কিংবা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার সীমিত সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে জুনের শুরুতে মিয়ানমারজুড়ে মৌসুমি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এমন আবহাওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। কেননা, বাহিনীটিকে একাধিকস্থানে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। এই আবহাওয়ার কারণে জান্তার বিমান হামলার সুবিধাও কমে যেতে পারে।

সংঘাতরত দুই পক্ষের ভারসাম্য এখন নির্ভর করছে মিয়াবতীসহ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও সামরিক ফাঁড়িকে ঘিরে। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে শক্তিশালী আরাকান আর্মি জান্তার বিরুদ্ধে লড়ছে। থাইল্যান্ড ও চীন সীমান্তের প্রদেশগুলোর একাধিকস্থানেও লড়াই হচ্ছে।

ইউএস ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ জাচারি আবুজা মনে করেন, বৃষ্টি শুরুর আগেই জান্তা এসব এলাকার কিছু পুনরুদ্ধার বা ধরে রাখতে চাইবে। আর বিদ্রোহীরা নিজেদের এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখতে চাইবে।

তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহগুলোতে সেনাবাহিনীর জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত লক্ষ্য রয়েছে।

গত বছর অক্টোবর থেকে রণক্ষেত্রে একাধিক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সমন্বিতভাবে যা অর্থনীতির ক্ষতি করছে। ক্ষমতা দখলের পর জান্তা সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস (ইউএসআইপি)-এর তথ্য অনুসারে, মিয়ানমার জান্তা ৫ হাজার ২৮০টি সামরিক অবস্থান হারিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফাঁড়ি, ঘাঁটি ও আঞ্চলিক সদর দফতর। রয়েছে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলের ৬০ শতাংশ ভূখণ্ড।

এক থাই কর্মকর্তা ও কূটনৈতিক সূত্র চলমান সংঘাতের পর্যালোচনায় বলেছেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেনাবাহিনী হয়ত বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী সব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। বিস্তৃত রণক্ষেত্রের সম্মুখভাগ ধীরে ধীরে তাদের হাতছাড়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো পুনরুদ্ধারে অগ্রাধিকার ও সামরিক শক্তি সংগঠিত করতে পারে সেনাবাহিনী।

কিন্তু তারা বলছেন, জান্তা দুর্বল হলেও এবং সেনারা আত্মসমর্পণ বা পক্ষ বদল করলেও, বিদ্রোহীদের ক্ষতি সাধন করার মতো যথেষ্ট সামরিক শক্তি রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার গোষ্ঠী অধ্যুষিত সমতল এলাকা।

ব্যাংককভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক থিতিনান পঙ্গসুধিরাক বলছেন, এমনকি কোণঠাসা হলেও সরকারি বাহিনী শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও সংঘাত দীর্ঘায়িত করতে পারে।

তিনি বলেন, আমি মনে করি এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে জান্তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা মুশকিল। রণক্ষেত্রে পরাজয়, বিদ্রোহীদের সাফল্য ও জনসমর্থন হারানো এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মিয়াবতী শহর বিদ্রোহীরা দখলের পর তা পুনরুদ্ধারে পাল্টা হামলা জোরদার করেছে সেনাবাহিনী। এই সীমান্ত শহরে বছরে ১০০ কোটি ডলার মূল্যের বাণিজ্য হয়।

মিয়ানমারের পুরনো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) সেনাবাহিনীর কাছ থেকে মিয়াবতী দখলের অভিযানে নেতৃত্ব দেয়। এখন তারা সেনাবাহিনীর শহরটি পুনরুদ্ধার ঠেকাতে লড়াই করছে।

কেএনইউ-এর মুখপাত্র সাও তাও নি রয়টার্সকে বলেছেন, মিয়াবতীর দিকে সহস্রাধিক সেনা এগিয়ে আসছে। কিন্তু কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ)- এর যৌথ বিদ্রোহী বাহিনী তাদের প্রতিহত করতে কঠোর চেষ্টা এবং হামলা করছে। প্রতিদিন তুমুল লড়াই হচ্ছে।

মিয়াবতী থেকে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার পশ্চিমে আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই করছে জান্তা বাহিনী। বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক দফতর আন-এর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে।

৭৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মিয়ানমার-চীন গ্যাসের পাইপলাইনটি এই আন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে গেছে। শহরের পাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাম্প স্টেশন রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাবাহিনী অঞ্চলটি ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।

ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র মিয়ানমার বিষয়ক উপদেষ্টা রিচার্ড হর্সে বলছেন, বৃষ্টির মওসুমে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা কঠিন হবে সেনাবাহিনীর জন্য। এটি ছিল সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সুবিধা। আকাশে বৃষ্টি কম থাকলে বিমানবাহিনী এগুলো দিয়ে সাধারণত বোমা ফেলে থাকে।

তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালে হেলিকপ্টার চালানো কঠিন ও বিপজ্জনক। বিশেষ করে সেনা পরিবহন, ঘাঁটিগুলোতে সরঞ্জাম সরবরাহ করা–বিশেষ করে যেসব ঘাটি জান্তাবিরোধীরা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের আবুজা বলেছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশজুড়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পক্ষ বদল ইঙ্গিত দিচ্ছে সেনাদের খাবার, পানি, অস্ত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে ব্যর্থ হচ্ছে জান্তা। যা সেনাদের মনোবলে ধস নামাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সুবিধা বয়ে আনবে বৃষ্টি। একাধিক জয়ে তারা এখন চাঙা রয়েছে। কিন্তু তারা এখনও বিচ্ছিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর একটি বাহিনী এবং তৃণমূলে গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।

ইউএসআইপি-এর ইয়ে মিয়ো হেইন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছেন, এসব গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কৌশলগত সমন্বয় বাড়াতে সময় লাগবে। কিন্তু মিয়ানমার সংঘাতের ফল নির্ধারণে এটি একটি নির্ধারক বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

মিয়ানমারের জান্তাবিরোধীদের বিপ্লবী সরকারের মুখপাত্র কিয়াও ঝাও বলেছেন, মূল ভূখণ্ডের বড় শহরগুলোই কেবল জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমনকি এসব শহরেও তারা হুমকির মধ্যে পড়ছে।

সূত্র: রয়টার্স

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন