দূর্গম সাজেক ভ্যালিতে ‘রুম্ময়’ ও থ্রি স্টার হোটেল হাতছানি দিয়ে ডাকছে রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকদের
মো: সানাউল্যাহ , সাজেক থেকে ফিরে:
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালির খাড়া পাহাড়ি রাস্তা ধরে উঠতে উঠতে হঠাৎই ঢালের শুরু। জিপ কিংবা মোটরবাইকে চড়ে সাজেকে পৌঁছাতে পথে পড়বে বুকে হিম ধরানো উঁচু-নিচু সড়ক। ক্ষণে ক্ষণে মনে হতেই পারে রোলার কোস্টারে চড়ছেন। তবু চার পাশের সবুজ পাহাড় ডিঙিয়ে রুইলুই উপত্যকায় (ভ্যালি) পৌঁছে মনে হবে স্বর্গে আসার জন্য এটুকু ঝক্কিতো পোহানো যেতেই পারে।
সাজেক ভ্যালিতে উঠেই আকাশপানে তাকালে মনে হয় কালো মেঘগুলোকে যেন সরিয়ে দিয়ে সাদা মেঘের আনা গোনা শুরু হয়। এমন সাদা মেঘ আকাশে এসে জমে, মনে হয় শিমুল তুলার খন্ড আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। পায়ের নিচে মেঘের দল। মাথার উপরেও মেঘ। মেঘের এ দৃশ্য সবার মনকে উতাল উদাস করে তোলে, মনের গভীরে সুখময় আনন্দের কোমল পরশ ছুঁয়ে যায়। সমতল থেকে তিন হাজার ফুট ওপরে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই ভ্যালি।
এখানে দাঁড়ালে নিচে ভাসমান মেঘ দেখা যাবে। কখনো মেঘ এসে ভিজিয়ে দেবে শরীর। প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যের টানে বহু পর্যটক এখন সাজেক আসছেন। প্রকৃতির সাথে মিতালি করতে এসে পর্যটকরা যাতে আরো স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারে তার জন্য সেনাবাহিনী গত কয়েক বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে গত বছরের নভেম্বর মাসে সেনাবাহিনী পর্যটনের নানা অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। সুদৃশ্য সড়ক, কটেজ, বিশ্রামাগার, সড়কবাতি, ক্লাবঘর, শিব মন্দির, পাবলিক টয়লেট, বিদেশি ঘরের স্টাইলে তৈরি রিসোর্ট “রুম্ময়”ও থ্রি স্টার মানের হোটেলও এ পাহাড়ে তৈরি করা হয়েছে।
আগে পর্যটকরা দিনে এসে রাতযাপনের ব্যবস্থা না থাকায় আবার দিনেই ফিরে যেতে হতো। এখন পরিবার নিয়েও রাতযাপন করা যাবে। নতুন বিবাহিত দম্পতিরা তাদের হানিমুনের জন্য পাহাড়ের ওপর এই স্থানটিও পছন্দ করতে পারেন। লুসাই ও পাংখোয়া উপজাতিদের বাস এখানে। রুইলুই এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সেনাবাহিনীর উদ্যোগে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর পাল্টে গেছে রুইলুই ভ্যালির চেহারা।
এলাকাবাসীদের শিক্ষার উন্নয়নে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির জন্য উন্নতমানের ট্যাংক তৈরি করা হয়েছে। ফুটপাথে টাইলস বিছানো হয়েছে। ফুটপাথে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সড়ক বাতি নির্মাণ করা হয়েছে। এলাকার অধিবাসীরা তাদের ধর্মীয় চর্চা করার জন্য সেনাবাহিনী বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দিয়েছেন। সংস্কৃতি চর্চার জন্য ক্লাবঘরও তৈরি করা হয়েছে। প্রকৃতির সাথে মিল
রেখে এলাকাবাসীদের ঘর তৈরি করা হয়েছে। যারা আগে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন তারা ঐ এলাকায় তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পাচ্ছে। এজন্য সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন।
খাগড়াছড়ি থেকে দিঘিনালা, কাচালং হয়ে সড়ক পথে তিন থেকে চার ঘন্টার মধ্যে পৌঁছানো যায় সাজেকের রুইলুই ভ্যালিতে। অপর দিকে রাঙামাটি থেকে প্রথমে নৌযানে কাপ্তাই হ্রদ পাড়ি দিয়ে ছয়-সাত ঘন্টায় বাঘাইছড়ি, সেখান থেকে দেড় থেকে দুই ঘন্টার মধ্যে পৌঁছানো যায় রুইলুইয়ে। উপত্যকার প্রথম পাড়া রুইলুইয়ে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড় সারি ও সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মোহনীয় দৃশ্য উপভোগ করা যাবে। পথে যেতে রিজার্ভ ফরেস্টের গভীর ঘনবন, সুউচ্চ পাহাড়ী বৃক্ষ আপনার মনে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে। এরপর লুসাই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত কংলাকপাড়া পর্যন্ত যাওয়া যাবে। হেঁটে যেতে সময় লাগবে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। পথে পড়বে বিজিবি ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প, হ্যালিপ্যাড, ঘন বনে আচ্ছাদিত নির্জন পাহাড়, কমলালেবু বাগান। উপত্যকা জুড়ে কংলাকের পর আরও বহু পাহাড়ি পাড়া পর্যন্ত হেঁটে যেতে সময় লাগবে দেড় থেকে দুইদিন। তবে দুর্গম হওয়ায় এখনো পর্যটকেরা সে পথে খুব একটা পা মাড়ান না। পাঙ্খো ও লুসাই উপজাতির প্রাকৃতিক জীবনপ্রণালী ও সৌন্দর্যবোধ, সংস্কৃতি মুহুর্তেই মুগ্ধ করবে যেকোনো পর্যটককে।
সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রুইলুই ভ্যালিতে পর্যটকদের ভিড়। রুইলুই পাড়া থেকে কংলাক পাড়া পর্যন্ত দল বেঁধে ঘুরছিলেন অনেকে।
কথা হয় ঢাকা থেকে আসা মোঃ আমজাদের সাথে। তিনি বলেন, আমরা ৩০ বন্ধু মিলে সাজেকের উইন্ড মিলসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছি। এতো সুন্দর জায়গা বাংলাদেশের আর কোথাও দেখিনি। ভবিষ্যতে সময়-সুযোগ মিললেই আবার ছুটে আসব এখানে।
খাগড়াছড়ি সদর থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যাওয়া শান্তি পরিবহনে সাজেকের মাচালং পর্যন্ত যাওয়া যাবে। সেখান থেকে জিপ, মোটর সাইকেল, সিএনজি ভাড়া করে সাজেক ভ্যালিতে যাওয়া যাবে। রুইলুই মৌজার হেডম্যান লাল থাঙ্গা লুসাই বলেন, সাজেকের সৌন্দর্যের টানে দেশের নানা স্থান থেকে প্রতিদিনই পর্যটকেরা আসছেন। রুইলুই ভ্যালিতে প্রতি দিন শত শত পর্যটক আসছেন। সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের পর আসার হার বাড়ছে।
তবে সকল অবকাঠামো নির্মাণ সমাপ্ত হলে পর্যটকদের পদচারণা আরও বাড়বে বলে তিনি জানান।
মারিশ্যা জোন কমান্ডার লে.কর্নেল মো: রবিউল ইসলাম বলেন, সাজেকের রুইলুই ভ্যালিতে এখন বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসা শুরু করেছেন। পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে এখানে ‘রুম্ময়’ নামে একটি মনোমুগ্ধকর রিসোর্ট ও থ্রি স্টার মানের একটি হোটেল নির্মাণ করা হয়েছে।
নির্মিত রিসোর্ট ও হোটেল দু’টি আগামী ৪ সেপ্টেম্বর সেনাপ্রধান সাজেক সফরকালে উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। তবে তারিখটি এখন চুড়ান্ত হয়নি। সেই সাথে হোটেলের রুম ভাড়া, বুকিং সিস্টেম এখনো চুড়ান্ত করা হয়নি।