পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়েও সেরা পাকিস্তানি- চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়
ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহে চাকমা রাণী কালিন্দী সৈন্য ও সাহায্য দিয়ে বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেছেন। রাণী কালিন্দীর এই কর্মকাণ্ড ইতিহাসে তাঁর নামকে কিছুটা হলেও কালিমাযুক্ত করেছে। মগ ও কুকিদের আক্রমণ এবং ব্রিটিশদের তৎকালীন প্রভাব প্রতিপত্তি বিবেচনায় রাণী কালিন্দীকে কিছুটা হলেও Benefits of Doubt দেয়া গেলেও চাকমা জাতি এবং স্বীয় জন্মভূমির ঐতিহাসিক সব মুহূর্তে তাঁরই বংশধর প্রয়াত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এর বারংবার পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া গভীরভাবে মূল্যায়নের দাবি রাখে।
১৪ মে ১৯৩৩ সালে রাঙ্গামাটিস্থ চাকমা রাজ প্রাসাদে (যা বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে ডুবন্ত অবস্থায় আছে) জন্ম গ্রহণ করেন ৪৯তম চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায় ও রাণী বিনিতা রায় এর সন্তান ৫০তম চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। রাজা ত্রিদিব রায় লন্ডনে অধ্যয়নকারী একজন ব্যারিস্টার। পিতা নলিনাক্ষ রায় এর আকস্মিক মৃত্যুতে ২ মার্চ ১৯৫৩ তারিখে তিনি চাকমা সার্কেল চিফ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গোষ্ঠীর সাথে তাঁর সম্পর্ক এতোটাই গভীর হয়েছিলো যে, ১৪ আগস্ট ১৯৫৩ তারিখে স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তান সরকার তাঁকে সেনাবাহিনীর পদাতিক কোরের সম্মানিত ‘মেজর’ পদবিতে ভূষিত করে এবং একই সাথে গভর্নর জেনারেল এর Aid-De-Camp (ব্যক্তিগত সহকারী) নিয়োগ করে। আজ অবধি পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজা ত্রিদিব রায় হলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি একই সাথে এই বিরল সম্মানসমূহের অধিকারী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে রাজা ত্রিদিব রায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে রাজা ত্রিদিব রায় যুক্তফ্রন্টের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক আরো জোড়দার করেন। যুক্তফ্রন্ট ও পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিমলীগ/আওয়ামীলীগ এর একচেটিয়া জনপ্রিয়তা এবং পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অবর্ণনীয় অন্যায় ও অত্যাচারের পরও তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন আসলেই ব্যাপক গবেষণার বিষয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণসমূহের চাইতে হয়তো ব্যক্তি স্বার্থ এবং পারিবারিক স্বার্থ বড় নিয়ামকের ভূমিকা নিয়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ব্রিটিশ সামন্ত প্রভূ তোষণকে কোনভাবেই অবহেলা করা যায় না। যেমন আইয়ুব খানের ১৯৫৮ সালের ভূমি সংস্কার কমিশন একক নামে সর্বোচ্চ ৫০০ একর সেচের জমি এবং ১০০০ একর সেচ বিহীন জমি মালিকানা রাখার সুযোগ দিয়েছিলো। এতে পরিষ্কার বুঝা যায়, জুলফিকার আলি ভুট্টো বা রাজা ত্রিদিব রায় এর মতো লোকেরা প্রকৃত গণতন্ত্রের দিকে যাবেন না, বরং সামরিক জান্তার সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। ঐ ব্যবস্থার ফলে যে কোনো ব্রিটিশ জমিদার বা তালুকদার পরিবারের ৪/৫ জন সদস্য মিলিয়ে তালুক/জমিদারির অধিকাংশ জমির মালিকানা ধরে রাখা তেমন কঠিন হয়েছিলো বলে আমার মনে হয় না! এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ ভূমি জরিপ হতে দেওয়া হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব প্রথা ও রীতির নামে পাহাড়ি সামন্ত সমাজ আসলে কী ধরে রাখতে চাচ্ছে, সেটা বুঝার জন্য হয়তো এসব ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কাপ্তাই বাঁধের অমানবিক ঘটনা প্রবাহে রাজা ত্রিদিব রায় এর নিজ সম্প্রদায় এবং জনবিরোধী ভূমিকা প্রথম পর্বে আলোচিত হয়েছে আগেই। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাথে সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতায় রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবিরও চরম বিরোধিতা করেন। একমাত্র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি নিরব থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
১৯৬২ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজা ত্রিদিব রায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল এর ভাইস চেয়ারম্যান এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের নতুন প্রবর্তিত নিয়মে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ১৯৭০ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তেমন কিছু না করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের অপারেশন চিফ হিসেবে তিনি শাসকগোষ্ঠীর বক্তব্যকে নিঃশর্ত সমর্থন দেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এর বিরুদ্ধে জয়লাভকারী ২ জন প্রার্থীর মধ্যে ১ জন হলেন রাজা ত্রিদিব রায়। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত রাজা ত্রিদিব রায় ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সবচেয়ে বিশস্ত ও যোগ্য পাহারাদার। এরই ধারাবাহিকতায় রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালে রাঙ্গামাটিতে রাজাকার বাহিনী গঠন করেন এবং এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে রাজা ত্রিদিব রায় দেশত্যাগ করলে, এর কয়েক বছর পর এই পাহাড়ি রাজাকার বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত জনবল দিয়েই মূলত প্রাথমিকভাবে গঠিত হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী। অর্থাৎ কাপ্তাই বাঁধ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ পাহাড়িদের রাষ্ট্রের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পিছনে রাজা ত্রিদিব রায় এর কর্মকাণ্ডের অবদান অনস্বীকার্য। যেহেতু হালের পাহাড়ি এলিট সমাজের নীতি এখনো সামন্তবাদ বা রাজা ত্রিদিব রায় এর নীতির চেয়ে মোটেই ভিন্ন কিছু নয়, সেহেতু গত ছয় দশক আগে বপন করা অবিশ্বাস ও আস্থা সংকট অতিক্রম করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য মোটেই সহজ কিছু না। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসেই রাঙ্গামাটিতে সাধারণ পাহাড়িদেরকে বিজু উৎসব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের কল্পিত হামলার ভয় দেখিয়ে। ইতিহাসের চরম নগ্ন এক পুনরাবৃত্তি! ২০২৪ সালে এসেও সাধারণ পাহাড়িদের কাল্পনিক ভয় দেখিয়ে বাধ্য করা হয়েছে ‘দানোত্তম কঠিন চিবরদান অনুষ্ঠান’ বর্জনে। এমনকি সেনাবাহিনী কর্তৃক শতভাগ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার পরও!
১৯৭১ সালে রাজা ত্রিদিব রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি জনসভা করেন। যেগুলোর মধ্যে মে মাসে রিজার্ভ বাজার ও তবলছড়ির জনসভা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেগুলোতে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে বলে বক্তব্য শেষ করেন। ১৯৭১ সালে রাজা ত্রিদিব রায় পার্বত্য চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে সার্বক্ষণিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন এবং নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে সহায়তা করেছেন। ৯ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে রাজা ত্রিদিব রায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশসমূহে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান পোক্ত রাখার মিশনে গমন করেন। কিন্তু ব্যাংককে পৌঁছে জরুরি বার্তা পেয়ে তিনি চট্টগ্রামে ফেরত আসেন এবং জানতে পারেন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতি হতে পারে, তাই তাঁর জন্য আপাততঃ দেশ ত্যাগই সর্বোত্তম। ১১ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে রাজা ত্রিদিব রায় ঢাকা থেকে করাচি গমন করেন। ১২ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান তাকে রাষ্ট্রীয় বিশেষ প্রতিনিধি এবং দূত হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর আনুগত্য ফল দেওয়া শুরু করেছে, এটাকে এখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রমাণ করতে হবে। যদিও এটা তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক মিশন নয়, এর আগেই তিনি যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে গমন করেছিলেন। এবার তাঁর প্রথম মিশন হলো কলম্বো’তে পশ্চিম পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর রিফুয়েলিং বজায় রাখা এবং শ্রীলঙ্কার আকাশসীমা ব্যবহার চালু রাখা। যেহেতু ভারতীয় আকাশসীমা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে সমর্থন করে বলেছিলেন, “সেনাবাহিনীরা যখন যুদ্ধ করে, তখন তারা একে অপরকে ফুল ছুড়ে মারে না।” শ্রীলঙ্কা রিফুয়েলিং সুবিধা দিলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এটা ধরে রাখাতে পারার বিষয়ে সন্দিহান ছিলো। তাই আগাম ব্যবস্থা হিসেবে তারা রাজা ত্রিদিব রায়কে ২৮ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে নেপালে যাওয়ার নির্দেশনা দেন, তবে অজ্ঞাত কারণে সে সফর বাতিল করা হয়। এর পরিবর্তে তিনি বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) হয়ে ডিসেম্বর এর প্রথম সপ্তাহে থাইল্যান্ডে পৌঁছান। থাইল্যান্ডের তৎকালীন সামরিক জান্তা ফিল্ড মার্শাল কিত্তিকাচর্ন এর সাথে বৈঠক করে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর রিফুয়েলিং সুবিধা ও থাই আকাশসীমা ব্যবহার নিশ্চিত করেন রাজা ত্রিদিব রায়। ইতোমধ্যেই ভারতের সাথে পূর্ণ যুদ্ধ শুরু হওয়ায় শ্রীলঙ্কা সকল সহযোগিতা বন্ধ করায় এটাই তখন পশ্চিমা হানাদারদের জন্য যুদ্ধে টিকে থাকার একমাত্র লাইফ লাইন হয়ে এসেছিলো। তবে মাত্র সপ্তাহ খানেক পরেই জেনারেল এএকে নিয়াজির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় গভীর হতাশা এবং বিষণ্নতায় পতিত হন কিছু দিনের জন্য। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, মার্কিন ৭ম নৌবহর সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তাঁর সবচেয়ে মারাত্মক দুঃস্বপ্ন এখন বাস্তবতা, এতো সব অসাধ্য সাধন এখন বিফলে পতিত!
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৭তম অধিবেশনে যুগোস্লাভিয়া কর্তৃক রেজুলেশন ২৯৩৭ (XXVII) এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করা হবে অনুমান করে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীনের সহায়তায় সেটা রুখতে জুলফিকার আলি ভুট্টো রাজা ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের প্রধান করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করেন। বাংলাদেশ সরকারও চীনের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও নিজের কূটনৈতিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে রাজা ত্রিদিব রায় যাতে তাঁর জন্মভূমির আর নতুন কোনো ক্ষতি না করেন এবং ভুল সংশোধনের জন্য দেশে ফেরত আসেন সেটা বুঝানোর জন্য তার মাতা রাণী বিনিতা রায়কে প্রতিনিধি দলের সাথে প্রেরণ করে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও রাজা ত্রিদিব রায় স্বীয় মাতা এবং জন্মভূমির ডাক আবারও দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চীনের ভেটো প্রদানের ফলে রেজুলেশন ২৯৩৭ (XXVII) বিফল হয় এবং বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির প্রথম চেষ্টায় ১০০টিরও বেশি দেশের সমর্থন থাকার পরও ব্যর্থ হয়। এতে পুরো পশ্চিম পাকিস্তানই খুবই খুশি হয়েছিলো। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭২ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আসার সময় সকল প্রটোকল ভেঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টো বিমানবন্দরে রাজা ত্রিদিব রায়কে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির হন! চূড়ান্তভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশ সরকার রাজা ত্রিদিব রায়কে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলো ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায়। ১৯৭৭ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পতন হলে পাকিস্তান সরকার এর সাথে রাজা ত্রিদিব রায় এর সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে আসে। সেই থেকে তিনি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ও শ্রীলঙ্কায় একটানা রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তাঁকে আনুগত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ও আজীবন মন্ত্রী মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিলো। ১৯৯৬ এর পর থেকে ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানি বুদ্ধিস্ট কমিউনিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ১৯৭১ সালে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রাজা ত্রিদিব রায়ের তাঁর পরিবারের সাথে যোগাযোগ রক্ষার বিস্তারিত বর্ণনা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র হতে আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তবে লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এর “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন” বই থেকে জানতে পেরেছি, তিনি জীবদ্দশায় পিসিজেএসএস এর কার্যক্রম উৎসাহিত করেছিলেন।
মোটাদাগে রাজা ত্রিদিব রায় এর সামনে বারংবার নিজের জন্মভূমি ও জাতিগোষ্ঠীর জন্য অবদান রেখে ইতিহাসের অংশ হওয়ার সুযোগ আসলেও তিনি প্রতিবারই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য অবদান রেখেছেন। রাজা ত্রিদিব রায় প্রমাণ করেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জেদ ও মতামতের কাছে জন্মভূমি, মাতা, পরিবার ও জাতিগোষ্ঠী তুচ্ছ। নিজের জেদ এবং মতামত যথার্থ প্রমাণ করার জন্য তিনি নরপিশাচদের আনুগত্য করতেও দ্বিধাগ্রস্থ নন। এ ধরনের দৃষ্টান্ত মানব ইতিহাসে হয়তো খুব বেশি নেই, হয়তোবা এটাই একমাত্র দৃষ্টান্ত!
বই পর্যালোচনাঃ দ্য লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট পাকিস্তান
লন্ডন ভিত্তিক ভারতীয় লেখক প্রিয়জিত্ দেবসরকার আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও যুক্তরাজ্যের সর্বমোট ১৩ জন সাংবাদিক/আইনজীবী/লেখক/বুদ্ধিজীবীর সমন্বয়ে গঠিত দলের সমন্বিত গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানী প্রচেষ্টার ফলাফল হিসেবে তাঁর ‘দ্য লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট পাকিস্তান’ বইটি ২০১৫ সালে প্রকাশ করেন। একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নিজ জন্মভূমি ত্যাগী রাজাকে নিয়ে এই বিশাল গবেষণা ও অনুসন্ধানের মূল কারণ এবং এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অর্থায়নের উৎস কী আমি এখনো জানতে পারিনি। লেখক ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন পাকিস্তানি প্রয়াত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে কেন্দ্র করে তাঁর বইটি লিখলেও বইটিতে চাকমা জাতির সংক্ষিপ্ত নৃতাত্বিক ইতিহাস, ১৯৪৭ এর ভারতভাগ, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনামল, কাপ্তাই বাঁধ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বহু ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ ওঠে এসেছে রাজা ত্রিদিব রায়কে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। এই তথ্যানুসন্ধানী ও গবেষণা মূলক বইটি প্রায় ৩০০ এর অধিক নিবন্ধ/ঐতিহাসিক নথি/বই পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। বইটি পড়ে মনে হয়েছে, বইটিতে লেখক শতকরা ৮৫ ভাগ বস্তুনিষ্ঠতা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। জন্মগত কারণে লেখক ভারতভাগ ও ১৯৭১ এর ঘটনা প্রবাহে ভারতকে সকল অনুমানের সুবিধা প্রদান করেছেন ও মহান হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু এসব কিছুতে ভারতের লাভ-ক্ষতি বা কৌশলগত উদ্দেশ্যের সামান্যতম বর্ণনাও দেননি। প্রিয়জিত্ দেবসরকারের এই বইটি মনোযোগ সহকারে পড়লে এটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলে যায়, ভারত সরকার ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সব নথি ডিক্লাসিফাইড করলে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাসের বর্তমান ভার্সনগুলো হয়তো ওলট-পালট হয়ে যাবে এবং ১৯৭১ এর ঘটনা প্রবাহের কোন দাবি সঠিক ও কোনটি মিথ্যা আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারবো।
কাপ্তাই বাঁধ ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনায় একজন Onlooker হিসেবে লেখক এর কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বইটির ১১৫ নং পৃষ্ঠায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন বিশিষ্ট ও খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ করে তাদেরকে লেখক চাকমা বলে দাবি করেছেন। কিন্তু ঐ বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের নামগুলোই সাক্ষী দিচ্ছে তারা কেউ চাকমা নন। দুঃখজনকভাবে অন্যান্য সকল অনলুকার লেখকের মতো প্রিয়জিৎ দেবসরকারের এই বইটিতেও পার্বত্য বাঙালীর দুঃখ-দুর্দশা কোনো স্থান হয়নি। বিশেষ করে, পঞ্চম অধ্যায়ে কাপ্তাই বাঁধের বর্ণনায় যেটা অপরিহার্যভাবে স্থান পাওয়া উচিত ছিলো। এছাড়াও লেখক স্থানীয় চাকমাদের বুঝাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ইংরেজি Indigenous শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে তার বইয়ের বর্ণনায়ও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা বাংলাদেশের আদিম জাতি নয়। আমি ধরে নিচ্ছি, স্থানীয় বুঝাতে লেখক ইংরেজি ইন্ডিজেনাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন, নয়তোবা লেখক জাতিসংঘের United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (UNDRIP) ধারণার একজন সমর্থক। তবে এখানেও প্রশ্ন হলো, ভারতে যেখানে শত শত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী Scheduled Tribe (ST) হিসেবে স্বীকৃত, সেক্ষেত্রে একজন ভারতীয় লেখক আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে কেন ইন্ডিজেনাস সম্বোধন করবেন স্থানীয় বুঝানো ব্যতিত?
UNDRIP এর মাধ্যমে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অর্থাৎ Tribe শব্দটি বাদ দিয়ে এবং নৃতাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ ব্যতীত একটি সার্বজনীন রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে বিশ্বের সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষার জন্য সবাইকে স্থানীয় বা আদিবাসী হিসেবে Indigenous ধারণা ঘোষণা করা হয়েছে। যেটার ভয়াবহ কূটনৈতিক বাস্তবতা আমি আমার পূর্বের ২টি নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ইংরেজি Indigenous শব্দটি একটি আপেক্ষিক শব্দ। নৃতাত্ত্বিকভাবে আদিম জাতি বা আদিবাসী বুঝাতে সঠিক ইংরেজি পরিভাষা হলো Aborigine। উদাহারণ স্বরূপ যদি ইংরেজিতে লিখি ‘Bangladesh has able to make an Aircraft fully by indigenous technology’, এর বাংলা পারিভাষিক অর্থ দাড়াবে ‘বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে দেশীয়/স্থানীয় প্রযুক্তিতে একটি বিমান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে’, কোনভাবেই এখানে দেশীয় বা স্থানীয় এর পরিবর্তে আদিম বুঝাবে না। বর্ণিত কয়েকটি অসংগতি বা অনিচ্ছাকৃত ভুল বাদ দিলে ‘দ্য লাস্ট রাজা অফ ওয়েস্ট পাকিস্তান’ বইটি মোটাদাগে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সারসংক্ষেপ। পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে আমি প্রিয়জিত দেবসরকার ও তার দলের গবেষণায় বাদ পড়া অংশসমূহ-সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের কটি অধ্যায় পূর্ণাঙ্গ এবং সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে পাঠক সমাজের নিকট তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র এই দুই পর্বের নিবন্ধে।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম গবেষক
সূত্র:
Debsarkar, Priyajit ‘The Last Raja of West Pakistan’
লেখাটির আগের পর্ব দেখুন এখানে :