পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে অবহেলিত সম্প্রদায় খুমী জনগোষ্ঠী
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবারত বিভিন্ন পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত ও বঞ্চিত হচ্ছে খুমীরা।২০১৪ খ্রিস্টাব্দে দ্যা সোসাইটি ফর এনভারনমেন্ট এন্ড হিউম্যান ডেভেলাপমেন্ট (সেড) একটি বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত খুমীদের আর্থ-সামাজিক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে খুমীদের সংখ্যা ২,৮৯৯জন।খুমীরা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানছি, রুমা এবং রোয়াংছড়ি উপজেলায় বসবাস করে।
সেডের এই জরিপের তথ্যনুযায়ী থানছি উপজেলায় ২৩টি, রুমা উপজেলায় ১৩টি রোয়াং ছড়িতে ৫টি এবং রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ১টি পাড়ায় ১০টি পরিবার বসবাস করে। এখানে মোট ৪৮৭টি খুমী পরিবার রয়েছে। খুমী মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫১.২২ ভাগ পুরুষ এবং ৪৮.৭৮ ভাগ নারী।
তাদের সাক্ষরতার হার শতকরা ২৮.২০ ভাগ বাকি ৭১.৮০ ভাগ নিরক্ষর। তারা প্রায় সবাই কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে যা স্থানীয় ভাবে ‘জুম চাষ’ নামে অধিক পরিচিত। তারা শিক্ষা-দীক্ষায় ও আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অত্যন্ত প্রান্তিক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৪৯ বছর পরও অত্যন্ত প্রান্তিক এই জাতিগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে অবহেলিত হয়ে আসছে। প্রাতিষ্ঠানিক জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগ না থাকাই তাদের অনগ্রসরতার অন্যতম একটি কারণ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ কিংবা আঞ্চলিক পরিষদের মত গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতিনিধিত্বকারী কোন প্রতিষ্ঠানেই খুমীদের কোন প্রতিনিধি নেই। নিজেদের প্রতিনিধি না থাকার কারণে কোন সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনা বা প্রকল্প প্রণয়নে তারা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ। আর যারা তাদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত তারা কখনো এই অবহেলিত খুমীদের উন্নয়নে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। ফলে এই অধিকতর সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীরা শিক্ষা-দীক্ষায় এবং আর্থ-সামাজিকভাবে যুগের পর যুগ পিছিয়ে রয়েছে এবং দেশের চলমান উন্নয়নে অংশীদার হতে পারছে না।
সংখ্যায় নগন্য কিংবা-প্রতিনিধিত্ব না থাকার কারণে কাউকে অবহেলা না করে উন্নয়নের সোপানে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ধর্ম-বর্ণ কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেদের নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সর্বক্ষেত্রে সকলের উন্নয়নে সকল জনপ্রতিনিধিদেরকেই এগিয়ে আসা দরকার বলে আমি মনে করি।
যে কোন উন্নয়নমূলক কর্মকারণ্ডে সকল জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা কিংবা কোন জাতি গোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াটা বিচক্ষণ নীতি-নির্ধারকদেরই নৈতিক দায়িত্ব। অপর দিকে, কোন অবহেলিত জাতিগোষ্ঠীদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাওয়াটা তাদেরই অধিকার। কারোর করুণায় পাওয়া বা দেওয়ার বিষয় নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নীতি-নির্ধারনী পর্যায়ে যারা রয়েছেন, অধিকতর সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীদের উন্নয়নের প্রতি তাদের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। তা না হলে এই অবহেলিতরা সমাজ ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে না। বরং বিগত বছর গুলোতে যে তিমিরে ছিলো, সেই মিতিরেই থেকে যাবে। যা কারো কাম্য নয়।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিংবা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত অধিকতর জাতিগত সংখ্যা লঘুদের উন্নয়নে তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ‘বিশেষ পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করে তা-বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দবি। যে পরিকল্পনায় এই অধিকতর অবহেলিত জাতিগোষ্ঠীদের প্রতিনিধিত্বসহ আর্থ-সামাজিক এবং শিক্ষার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট রূপকল্প তৈরি করে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা গেলে জাতি, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
তারাও নিজেদের বেঁচে থাকা, টিকে থাকা এবং উত্তরণের স্বপ্ন দেখতে পারবে। জাতি, সমাজ ও দেশ গঠনে তাদের ভূমিকা রাখার স্বপ্ন এবং তাদের উন্নয়নে অংশীদারিত্ব হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাত, ধর্ম-বর্ণ এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে সর্ব ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকদের এগিয়ে আসতে হবে।
অবহেলিতদের প্রতি ‘বিশেষ দৃষ্টি’ দিয়ে ‘বিশেষ পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করে তাদের উন্নয়ন অংশীদার করে দেওয়ার দায়িত্ব যতটুকু না সেই জাতিগোষ্ঠীর, তার চেয়েও বেশি উদার মনে সহানুভুতিশীল হয়ে অগ্রসর জাতি গোষ্ঠীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বঞ্চনা, বৈষম্য ও শোষণ দূর হবে সমাজ থেকে, এগিয়ে যাবে জাতি ও দেশ।
লেখক. দৈনিক ভোরের আলো, রুমা প্রতিনিধি, বান্দরবান