পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তম ৯ সেপ্টেম্বরের পাকুয়াখালী গণহত্যার খুনিদের বিচার হবে কি?
মনিরুজ্জামান মনির
‘জীব হত্যা মহাপাপ, অহিংসা পরম ধর্ম’, যারা এই কথা বলে, তাদেরই একাংশের হাতে বর্বর হানাদার পশুর মত জীবন দিয়েছে বাঘাইছড়ির শতাধিক বাঙালি কাঠুরিয়া। অথচ আজ পর্যন্ত পাহাড়ের কোন ধর্মগুরু এই বাঙালি হত্যার বিরুদ্ধে নূন্যতম প্রতিবাদ করেন নাই। তারা শান্তিবাহিনীকে লালন পালন করছেন এবং মদদ দিয়ে যাচ্ছেন। আজও পাহাড়ে চলছে বাঙালি বিরোধী হিংসা ও নির্যাতনের নিষ্ঠুর চর্চা। ত্রিশ হাজার বাঙালি জীবন দিয়েও পাহাড়ে তাদের স্বকীয় ধর্ম-সংস্কৃতি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই। এর দায়দায়িত্ব কি শুধুই পার্বত্যবাসী বাঙালিদের? দেশের ১৬ কোটি মানুষের কি এজন্য কি কোন দায়-দায়িত্ব নেই?
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম উপজেলা লংগদু, তার চেয়েও আরো দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলা। এখানে বসবাসরত অধিকাংশ বাঙালি শ্রমিকের পেশা গাছ-বাঁশ কাটা। হতভাগা এসব কাঠুরিয়াদের বড় অংশ থাকে লংগদুর মাইনীমুখ, গুলশাখালী তেমাথা, কালাপাকুজ্জাসহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে। ১৯৯৬ সালের প্রথম দিক থেকেই স্থানীয় গাছ ব্যবসায়ীদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের সাথে। দীর্ঘদিন তারা দালালের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে চাঁদা নিত। কিন্তু হঠাৎ করে তৎকালীন শান্তিবাহিনী (জেএসএস) চাঁদার পরিমাণ ৩/৪ গুণ বাড়িয়ে দেয়। নতুবা গাছ-বাঁশ-কাঠের ব্যবসা বন্ধ করে দেবে বলেও হুমকি দেয়। ফলে নিরীহ দরিদ্র বাঙালি কাঠুরিয়াদের পেটে লাথি পড়ে। অনাহারে অর্ধাহারে জর্জরিত জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ঘনছায়া। তদুপরি জীবন বাজি রেখে মাঝে মধ্যে গহীন জঙ্গলে গিয়ে তারা কাঠ কাটতো, দুর্গম পাহাড় বেয়ে অনেক সময় হাতির সাহায্যেও বড় বড় গাছের গুড়ি টেনে এনে লেকের পানিতে ভাসিয়ে নৌকার সাহায্যে শহরের বড় বড় কাঠ গুদামে আহরণ করা হতো। সেই হতভাগা কাঠুরিয়াদের উপরই ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ।
উপজাতীয় শান্তিবাহিনী কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা বৃদ্ধির আবদার মেটাতে ব্যর্থ হয়ে নিরীহ গরীব কাঠুরিয়াদের উপর চরম প্রতিশোধের জাল আটে। বাঙালি কাঠুরিয়াদেরকে আলোচনার ফাঁদে ফেলে দালালের মাধ্যমে জড়ো করা হয় বাঘাইছড়ি থানার পাকুয়াখালীর গহীন অরণ্যে। সেদিন সরল বিশ্বাসে ও পেটের তাগিদে জীবিকার অন্বেষণে নানারূপ সন্দেহ ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে শতাধিক কাঠুরিয়া জড়িত হয় পাকুয়াখালীতে। বাড়ীতে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও ছোট শিশুটিও হা করে আছে অন্নের আশায়। বাবা কাঠ কেটে আসবে, রোজগারের টাকা পেলে তবেই বাজার থেকে চাহিদা মতো কিছু কেনাকাটা হবে। কিন্তু ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাঠুরিয়াদেরকে চাঁদা নির্ধারনের অজুহাতে নেয়া হলেও কেউই ফেরত আসছেনা। অজানা আশঙ্কায় কাঠুরিয়াদের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল। স্বজনরা কেন জানি আপনহারা ব্যথায় কেঁদে উঠলো। বাঘাইছড়ির লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক এই হত্যাকান্ড প্রথমে ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় সাবেক এমপি দীপংকর তালুকদার ও তার দলীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এই হত্যাকান্ডকে গুজব এবং সরকার বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলেও প্রচার করেছিল। এমনকি, এমপি সাহেব, রাঙামাটির ডিসি, এসপি, সেনাবাহিনীসহ সবাইকে গুজবে কান না দিয়ে যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন।
কিন্তু মানবতার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাদেরই একটি অংশ এগিয়ে আসে স্বজনহারা বাঙালিদের ডাকে। দুই-তিনদিন ধরে নিখোঁজ আপনজনের জন্য কোন সন্ধান না পেয়ে থানার ওসি এবং সেনাজোনের কাছে ছুটে যায় তারা। এদিকে খুনী শান্তিবাহিনীর মৃত্যুকূপ থেকে পালিয়ে আসা একজনকে সন্দেহজনকভাবে আটক করা হয়। কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর সকাল বেলা যখন লংগদু জোনের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গভীর জঙ্গল এবং পাহাড়ের খাঁদ থেকে দু-চারটি করে লাশ আনতে শুরু করলো, তখনি বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডের রহস্য বেরিয়ে গেল। কাটা, ছেঁড়া গলিত লাশগুলো দু-তিন দিনে পচে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে গেছে। তাদের চেহারাও চেনা মুশকিল। দা, কুড়াল, বেয়নেট, ছুড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং তিল তিল করে অমানুষিক অত্যাচার করে তাদেরকে হত্যা করেছিল হানাদার উপজাতীয় শান্তিবাহিনী।
বর্বর হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীও ১৯৭১ সালে এভাবে পশুর মতো নির্যাতনের মাধ্যমে বাঙালি হত্যা করে নাই। অথচ, সন্তু লারমা বাহিনী তার চেয়েও জঘন্য পাশবিক আচরণে বাঙালি হত্যা করেছে। তারপরও রাঙামাটির ডিসি সাহেবকে এমপি দীপংকর তালুকদার বলেছিলেন- “আমি চাই না, এই ঘটনার জন্য পাহাড়ে কোন উপজাতির একটি পশমও কেউ যাতে ছিড়তে পারে”। প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়, যাতে উত্তেজিত বাঙালিদেরকে কঠোরভাবে দমন করা হয়। অন্যদিকে, প্রতিদিনই ঢাকা থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা লংগদু আসতে থাকেন। আমু, তোফায়েল, রাজ্জাক, হাসনাত, মহিউদ্দিনসহ ডজন খানেক মন্ত্রীরা পাহাড়ে ছুটে আসেন। স্তম্ভিত হতবিহবল হয়ে যান এই বীভৎস হত্যাকান্ড দেখে। মানুষ এত বড় নিষ্ঠুর হতে পারে, এত জঘন্য হতে পারে, তা সেদিনের সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশদ বিবরণও তুলে ধরেছিলেন। চীন যাত্রার প্রাক্কালে অশ্রুসজল কন্ঠে সেদিন সাংবাদিকদের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে খুনিদের বিচার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাছাড়া চার পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল যার রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জাতিকে জানানো হয়নি।
কিন্তু দীর্ঘ ১৯ বছরেও বাঘাইছড়ি কাঠুরিয়া হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তথাকথিত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে খুনি শান্তিবাহিনীকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। পাহাড়ী সন্ত্রাসীদেরকে কঠোরভাবে দমন না করে বিদেশী চাপের মুখে সন্ত্রাসপূজার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত করেছিল লীগ সরকার। দীর্ঘ ৪০ বছর পর যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতে পারে, তবে ১৯ বছর পরও কেন বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডের বিচার হবে না? খুনি শান্তিবাহিনীর এটা হল গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ, যার বিচার যে কোন সময় করা যেতে পারে। এই বিচারে কোন বাধা নাই। হিটলার- মুসোলিনীর বিচার যদি হতে পারে, তবে ঘাতক শান্তিবাহিনীর নেতা সন্তু লারমার বিচার হবে না কেন? আজ তাকে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান পদে রেখে জনগণের খাজনা- ট্যাক্সের টাকায় প্রতিমন্ত্রীর মতো বেতন-ভাতা সুবিধাদি দেয়া হচ্ছে। জনগণ কেন এই বেতন দেবে? এরপরও সন্তুলারমারা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অজুহাতে পাহাড়ে হাট-বাজার বন্ধ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সাথে অসহযোগ আন্দোলন করার হুমকি দিচ্ছে। আদিবাসী চক্রান্তের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের মত স্বাধীন জুম্মল্যান্ড করার জন্য জাতিসংঘ, ব্রিটিশ নেতা লড এরিক এভিবুরি, সুলতানা কামালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন, রাশেদ খানের কাপেং ফাউন্ডেশন, গারো উপজাতি নেতা এবং তথাকথিত আদিবাসী অধিকার ফোরামকে ব্যবহার করে চলছেন। এজন্য দেশবাসীকে সদা সজাগ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ড আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিষফোঁড়া হয়ে আছে। জাতি এই কলঙ্কের বোঝা কতকাল বহন করবে? নিরীহ মানুষের হত্যাকান্ড এই জাতি কিভাবে সহ্য করছে? দেশের অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি পাহাড়ে, জঙ্গলে-অরণ্যে, খালে-বিলে, নদী-নালায়, হাট-বাজারে বহু বাঙালিকে জীবন দিতে হয়েছে। এটা কোন স্বাভাবিক হত্যাকান্ড নয়, এটা হল রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ঠান্ডামাথায় বাঙালি হত্যাকাণ্ড। এ রাষ্ট্রদ্রোহিতার ন্যূনতম শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। আজও পর্যন্ত পাহাড়ে বাঙালিরা উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত নিপিড়িত হচ্ছে। অথচ মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে দারুণ নিরবতা পালন করছে। কিন্তু কেন? দেশের প্রচলিত আইনেই বাঘাইছড়ির খুনিদের বিচার করতে হবে। নয়তো নিরীহ সেসব কাঠুরিয়াদের অশরীরি আত্মা কখনো এই জাতিকে ক্ষমা করবে না। সভ্য সমাজ, সুধী সমাজ, আধুনিক বিশ্বের দাবীদার বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ যেদিন এই খুনিদের বিচারে জেগে উঠবে, সেদিনই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে, পরিশুদ্ধ হবে দেশের জণগোষ্ঠী। নতুবা সভ্য সমাজ হিসেবে আমরা বিশ্ববাসীর কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। সন্তুবাবুরাও পাহাড়ে ত্রিশ হাজার বাঙালির অশরীরী আত্মার আর্তনাদ থেকে মুক্তি পাবেন না। ক্ষুধামুক্ত সবুজ শ্যামল উপজাতি-বাঙালিদের বাসস্থান হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এ জন্যই চাই খুনিদের বিচার।
♦ লেখকঃ মহাসচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন, কেন্দ্রীয় কমিটি ।
মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার জন্য পার্বত্যনিউজের সম্পাদকীয় নীতিমালা প্রযোজ্য নয়।