পার্বত্য আলোচনায় মেজর জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সকলকে পার্বত্যকোটাসহ সকল বিষয়ে সমান সুবিধা দিতে হবে

fec-image

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম সম্প্রতি এসেছিলেন পার্বত্যনিউজের অফিসে। পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালন করা এই কর্মকর্তা পার্বত্যনিউজের  লাইভ অনুষ্ঠান ‘পার্বত্য আলোচনা’-য় অংশ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করেছেন। তিনি বিভিন্ন সমাধানের উপায় নিয়েও আলাপ করেন।

পার্বত্যনিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আশির দশকে পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করেছি। সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন জেনারেল এরশাদ। এরশাদ বলেছিলেন, পাহাড়ে শান্তি চাই। শান্তি আনয়নে কি করা যায়। তখন আমরা সেখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তাবাহিনী সবাইকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে শান্তি আনার চেষ্টা করেছি। কারও সঙ্গে কোন ঝগড়ায় যাইনি। সেনাবাহিনী, পাহাড়ি-বাঙালিদের প্রতিনিধিদের নিয়ে, প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সবাইকে নিয়ে চেষ্টা করেছি কিভাবে শান্তি আনা যায়। আমরা শান্তির জন্য পরিশ্রম করেছি।

পার্বত্যনিউজ আয়োজিত লাইভ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পত্রিকাটির সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশ

সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, পাহাড়িদের গ্রামগুলোতে গিয়ে সেখানে সবাইকে নিয়ে আলোচনা সভা করেছি। একসময় ’৮৯, ’৯০, ’৯১ সালের দিকেও পাহাড়ি উপজেলায় এতিমখানা, স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উড়ত না, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হতো না। সে সময় সবাইকে নিয়ে শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছি। আমরা প্রচেষ্টার মাধ্যমে পাহাড়িদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে এনেছি।

আপনার সময়ে পার্বত্য অঞ্চলে একটি বৈষম্যমূলক জেলা পরিষদ আইন করা হয়েছে সেখানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কখনোই একজন বাঙালি হতে পারবেনা। এটাকে সঠিক মনে করেন কিনা- এক দর্শকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের এক বা একাধিক রায় বেরিয়েছে গত ১০-১২ বছরে। এখানে বলা আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে অঞ্চলে কোন আইনটা প্রযোজ্য। এটার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়।

তিনি বলেন, একদিকে আমরা জেলা পরিষদ আইন বাস্তবায়ন করছি। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ চালাচ্ছি। একদিকে হেডম্যান কারবারি প্রথা চালু রেখেছি। একদিকে আমরা রাজা মহারাজার জন্য খাজনা দিচ্ছি। উদ্দেশ্য ছিলো ১৯০০ সালের শাসনবিধিকে রহিত করা। কিন্তু শান্তিচুক্তির সময় এই আইনকে রহিত করা হয় নাই।

খাগড়াছড়ির বিগ্রেড কমান্ডার হিসেবে আমি সবাইকে নিয়ে বসেছি। আমরা সবাইকে নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেই আমাদের সবাইকে একটি ত্যাগ করতে হবে। যে পার্বত্য জেলা পরিষদে কোন বাঙালি চেয়ারম্যান থাকতে পারবে না। সংখ্যায় কম হলেও আমরা বলেছি সমান সমান থাক। কিন্তু এরপরও জেলা পরিষদে দুইজন বাঙালি কম আছে। এখানে অতিসত্বর একজন বাঙালি ভাইস চেয়ারম্যান সৃষ্টি করা হোক।

আপনার সময়ে বাঙালিদের যে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর ফিরিয়ে আনা হয় নাই- এমন প্রশ্নের জবাবে জেনারেল ইবরাহিম বলেন, আজকের গুচ্ছগ্রামে বাঙালিদের যে সমস্যা এই সমস্যা বুঝতে হলে ২০ বছর আগে যেতে হবে। কেন শান্তিবাহিনী সৃষ্টি হয়েছিলো। কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এটা আমরা করতে পারিনি। আমরা শান্তিবাহিনীর সমস্যা দূরীকরণ বা শান্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারিনি।

তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে শুরু করে ৫ মে পর্যন্ত যে হত্যাকান্ড শান্তিবাহিনী বাঙালিদের উপর চালিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এরশাদ খাগড়াছড়িতে এসে বলেছিলেন, এটা কেন হয়। সে সময় বঙ্গভবনে আমরা গিয়ে বলেছিলাম- বাঙালিদের জন্য এখানে যে জমি দেওয়া হয়েছে, তখন এই প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ছিলো। কোন কোন সময় বাঙালিদের জমি পাহাড়িদের কাছে চলে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া জমি বাঙালিরা সঠিকভাবে পেয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বাঙালিরা পাহাড়িদের জমি খালি দেখে চাষ করতে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পাহাড়িরা তাদের জমি ফেরত নিতে গেছে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছে। সে সময় বাঙালিদের গ্রামগুলো দুরে দুরে ছিলো। অনেক ক্ষেত্রে পাহাড়িরা বাঙালিদের উপর হামলা করতো। বাঙালিদের নিরাপত্তার জন্য আমরা বলেছিলাম যে যদি একসাথে করে রাখা যায় তাহলে তাদের নিরাপত্তা দেওয়া যাবে। তখন বাঙালিদের বসতি ছিলো দূরে দূরে। যার কারণে তাদের উপর পাহাড়িরা সহসাই আক্রমণ করতো।

বাঙালিদের একসাথে করার কারণে শান্তিবাহিনী বলেছিলো, ওদের সবাইকে অস্ত্র দেবে। প্রশিক্ষণ দিবে আমাদের মারার জন্য। কিন্তু সেটি ছিল ভুল। আমরা বাঙালিদের নিয়ে গেছিলাম তাদের রক্ষা করার জন্য। সেটি ছিল একটি সাময়িক ব্যবস্থা। সে সময় এরশাদ বলেছিলেন তাদের রেশন দেওয়া হবে। এরশাদ তিন বছর সময় চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন আমরা ভূমি জরিপও করাবো। কোন পাহাড়ির জমি যদি বাঙালি নিয়ে থাকে সেটা ফেরত দেব। বাঙালিদের সরকারি জমি দিবো। যাতে পাহাড়ি-বাঙালি দের মধ্যে দ্বন্ধ না থাকে। কিন্তু পরে সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। এ সমস্যা সমাধানে এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী অনেক কিছু এডজাস্ট করছেন। এখন এটাও এডজাস্ট করতে হবে। ২৬ হাজার বাঙালি গুচ্ছগ্রামে আটকে আছে। এ সব গুচ্ছগ্রামের বাঙালিদের জায়গা জমির সমস্যা সমাধান না করে যদি তাদের পূর্বের জায়গায় নেয়া হয় তাহলে আবার ১৯৮৮ সালে আপনি আবার ফিরে যাবেন। আবার রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

আশির দশকে উপজাতীয় শরণার্থী সমস্যার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার দায়িত্ব পালনকালে নয় ৮২তে, ৮৯তে শরণার্থী সমস্যা হয়েছে। ’৮৬ এর গন্ডগোলের পরও এ সমস্যা হয়েছে। আমার সময়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শরণার্থী সমস্যা হয়ছে। শান্তিবাহিনী এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে সরকারের দূর্বল দিক চিহ্নিত করে। তারা জানতো সরকারের দূর্বল দিক নিরস্ত্র বাঙালি। বাঙালিদের গ্রামে গিয়ে তারা আক্রমন করতো। ক্ষুদ্ধ বাঙালিরা নিকটতম পাহাড়ি গ্রামগুলোতে গিয়ে পাল্টা আক্রমন করতো। সেই পাহাড়িরা পালিয়ে ভারতে যেত। শান্তিবাহিনী সেখানে গিয়ে তাদের বর্ডার পার করাতো।

সে সব শরণার্থীরা বিপদে পড়েই যেত। কিন্তু তাদের এ জন্য প্রলুব্ধ করতো শান্তিবাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা আন্তর্জাতিকীকরনের জন্য শান্তিবাহিনী এটা সৃষ্টি করেছে। এর সাথে বাঙালি বা সেনাবাহিনীর কোন সম্পর্ক নেই। এটি পার্বত্য সমস্যা।

শান্তিচুক্তির প্রভাব নিয়ে জেনারেল ইব্রাহিম বলেন- এখন তো পার্বত্য অঞ্চলে চলাচল অবাধ হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোনো স্থানে চলাচলে বাধা নিষেধ নেই। ব্যবসা বাণিজ্যে বাধা বিভেদ নেই। আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি স্থাপন হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী উদ্যোগ নিয়েছে বলে এটি সম্ভব হয়েছে। চলাচলের আরও সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিকে পর্যটন স্পট হিসেবে তুলে ধরতে হবে। যদিও ওরা বলছে পাঁচ দফা বাস্তবায়ন হয়নি। জুম্মল্যান্ড বাস্তবায়ন হয়নি। তবে আমরা এমন কোন জায়গা নাই যেখানে গিয়ে বলিনি শান্তি চাই।

আমরা বলেছি, বাঙালিদের ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে। চাঁদাবাজি কমাতে হবে। যৌথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন সবাইকে মিলে একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি সুনামগঞ্জ থেকে অনেক উন্নত। কিন্তু এই উন্নয়নকে আমরা বাঙালিদের জন্য ব্যবহার করতে পারি নি। প্রবাসী বাঙালিদের রেমিটেন্সের উপর নির্ভর না করে যদি আমরা আমাদের ট্যুরিজম সেক্টরকে উন্নত করতে পারি। পার্বত্য অঞ্চল এক্ষেত্রে বড় একটি ভূমিকা রাখতে পারে। এতে পাহাড়িরাও উপকৃত হবে। বাঙালিরাও উপকৃত হবে। শেখ হাসিনা ইচ্ছা করলেই এটা পারেন। ভূমি সমস্যার জন্য ভূমি জরিপ হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ সরকার কিভাবে ভূমি জরীপ করতে পারে- সে ব্যাপারে তিনি বলেন, একটা দ্বন্দ্ব আগে থেকেই আছে। পাহাড়ি ভাইয়েরা বলছে পার্বত্য অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। রাষ্ট্র বলছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ জন্য ভূমি জরিপ করতে হবে। প্রথমে একটু মাপতে হবে। মাপার পর বলতে হবে এত অংশ পাহাড়ি ভাইদের ছেড়ে দিতে হবে। বাকিটুকু সরকার নিয়ে বাঙালিদের দিবে। এই সার্ভে করার অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জরিপ করতে গেলে সেই লোকদের তারা ধরে নিয়ে গেছে। এটাকে বাধা দিলে আপনারা আগাতে পারবে না। বিষয়টি সন্তু লারমার নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের চিন্তা করতে হবে। ১৯০০ সালের ধারা দিয়ে ২০১৯ সাল বিচার করলে হবেনা।

তিনি বলেন, এদিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যারা আছেন তাদের দায়িত্ব নেওয়া বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব। পাহাড়ের ঐতিহ্য রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেখানে যে বাঙালিরা আছে, তাদের সেখানে সম্মানজনকভাবে রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। পার্বত্য কোটা, পার্বত্য সুযোগ সুবিধা সকল জনগোষ্ঠীকে একসাথে দিতে হবে। আগে শুধু উপজাতি পাহাড়িদের ব্যবসা করার লাইসেন্স দেয়া হতো। সুযোগ সুবিধা দেয়া হতো। এখন এটা সকল পার্বত্যবাসীকে দিতে হবে।

কি করলে শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এরকম শান্তিচুক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে যে মনিটরিং সেল লাগে সেটা আমাদের নেই। এখন যে কমিটি আছে এখন তারা কয়বার সেখানে গেছেন। কি করেছেন তদন্ত করেন। সরকার বলছে শান্তিচুক্তি ৭০ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু সন্তু লারমা বলছে ৩০ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। এই যে বিরোধ এ জন্য এখন একটি জাতীয় কমিটি করেন। সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যদের নিয়ে, বিচারপতিদের মধ্যে একজন নেন তাদের নিয়ে করেন।

জেনারেল ইব্রাহিম পাহাড়ে শান্তি আনতে একটি পদক্ষেপের কথাই তুলে ধরেন তাহলো, শান্তি আনতে একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি আনয়নে কোন এর কোন সমন্বয়কারী নেই। একজন সমন্বয়কারী দরকার। যে সবার মধ্যে সমন্বয় করবেন। আজ বলতে হবে বাঙালি থাকবে, কি থাকবে না। থাকলে ভূমি সমস্যার সমাধান করতে হবে। এটি না করলে শান্তি আসবেনা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন