পার্বত্য চুক্তিতে যে কথা বলা হয়নি

fec-image

আমরা সবাই জানি, পার্বত্য শান্তি চুক্তি করে শেখ হাসিনা ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার হাতিয়ে নিয়েছিলেন। হাতিয়ে’ শব্দটি ব্যবহার করছি এজন্য যে তিনি খুবই পুরস্কার লোভী বা খুব প্রচারলোভী ছিলেন। তিনি তার সমকক্ষ কাউকে তার পাশে রাখতেন না। যদি শান্তি চুক্তি একটি ভালো কাজ হয়ে থাকে তবে তো চুক্তির দু’পক্ষই সে ভালো কাজের অংশীদার। সে বিবেচনায় সন্তু লারমাও তো চুক্তি করার জন্য একই ভাবে পুরস্কৃত হওয়ার কথা।

এই যেমন প্যালেস্টাইন ইসুতে ইটঝাক রবিন ও ইয়াসীর আরাফাত নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।

আমরা যদি মেজর জেনারেল ইব্রাহিমের ‌‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি: পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’ বইটি কে দলিল হিসাবে নিই তাহলে দেখতে পাই বিএনপি সরকারের নেওয়া শান্তি আলোচনা একটা চূড়ান্ত (১৩ তম বৈঠকের পর) পর্যায়ে পৌঁছার পর হঠাৎ করে সন্তু লারমা যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

রাশেদ খান মেনন এবং অলি আহাদের সেই খসড়া চুক্তিটি শান্তি বাহিনী আর এগিয়ে নেয়নি। কারণ তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীটি যথেষ্ট জোরালো হয়েছে। আওয়ামী লীগ আত্মবিশ্বাসী ছিলো সেরকম নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় আসবে। সন্তু লারমাকে এই বার্তা দেওয়া হয় যেন শেষ সময়ে তারা বিএনপি সরকারের সাথে কোন চুক্তি না করে। কারণ তা হলে আওয়ামী লীগ সেই চুক্তি বাস্তবায়ন নাও করতে পারে। ভারতের দিক থেকেও চাপ ছিলো অপেক্ষা করার জন্য। সন্তু লারমা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

শেখ হাসিনা চাইছিলেন দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত হানাহানি বন্ধ করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজের একটা ভালো ইমেজ তৈরী করতে। শেখ হাসিনার দিক থেকে এটা ছিলো একটা স্মার্ট মুভ। আর কে না জানে পুরস্কার এবং ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি এসবের প্রতি তার ঝোঁকের কথা।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই গঙ্গা পানিচুক্তি করে দেশ-বিদেশে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার বৈদেশিক নীতির কার্যকরী শক্তি তিনি দেখান।

সন্তু লারমাও দেখলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইসূতে ভারত যেহেতু একটা ফ্যাক্টর অতএব ভারতের ছায়া যদি আওয়ামী সরকারের উপর থাকে তবে চুক্তি বাস্তবায়নে তা একটা গ্যারান্টর হিসাবে কাজ করবে।

ফলাফল দাঁড়ালো দীর্ঘ এক দশকের যোগাযোগ আলোচনা নানান বাধা বিপত্তি পেরিয়ে চূড়ান্ত ফলাফলের সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাকে আর সময় ক্ষেপণ করতে হলো না। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে চুক্তির ঘোষণা এলো। শেখ হাসিনার ম্যাজিক দেখলো দেশবাসী।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইসূতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইসূ ছিলো ভূমি : বসতিকারী বাঙালিদের সরিয়ে নেওয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে বিস্তৃত থাকা সেনাবাহিনীর ছাউনিগুলো সরিয়ে ছয়টি নির্দিষ্ট সেনানিবাসে স্থিতু করা। ‘সেনাবাহিনীর ক্যাম্প নেই ‘ এই দৃশ্যপট পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীকে একটা বিজয়ের সূচক হিসাবে দেখাতে চেয়েছিলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটা দখলদার বাহিনী ছিলো ওরা লেজ গুটিয়ে তাদের জন্য সীমিত একটা স্থানে আবদ্ধ করা গেছে- ওরা ওখানে লেফট-রাইট করবে, ভলিবল খেলবে। বাইরে আসবে না, প্রবল শক্তিধর ক্ষমতার আইকনকে আলাদীনের দৈত্যের মতো বোতলে ভরা গেছে!  কি দারুন এক বিজয়!

কিন্তু শেখের বেটীর কুটচাল সন্তু লারমা বুঝতে পারেনি বা পারলেও ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে জেএসএস আর সুবিধা করতে পারেনি তাকে কোন গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়াই চুক্তি করতে হয়। ভরসা শুধু ভারতের আশ্বাস।

বিপুল পাহাড়ি জনগণের ধারণা বা প্রত্যাশা ছিলো চুক্তির পরপরই পাহাড়ের বসতিকারী বাঙালীরা সুর সুর করে ট্রাক ভরে ভরে লোটা-বাক্স সহ পাহাড় থেকে বের হয়ে যাবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর দেখা গেল তেমন কিছু নেই।

পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের ব্যানার নিয়ে তখন মাঠে নামলো ইউপিডিএফ।

বাঙালি প্রত্যাহার সেনাবাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার এসব কোন কিছুর টাইম লাইন দেওয়া নাই।

সুচতুর শেখ হাসিনা নাকি কানে কানে আজন্ম বাম ধুরন্ধর রাজনৈতিক নেতা কৌশলী গেরিলা সন্তু লারমাকে কান পড়া দিয়ে চুক্তি করিয়ে নেন।

শেখ হাসিনার কৌশল ছিলো মৌখিক আশ্বাস: ‘দেখ বাঙালী প্রত্যাহার তো খুব স্পর্শ কাতর বিষয় ওসব লিখলে বিএনপি এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করবে, তার চেয়ে অল্প ক’জন বাঙালীই তো ওদের রেশন বন্ধ করে দিলে ওরা না খেতে পেরে এমনিতেই চলে যাবে। আর ওদের জন্য পূনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। তোমাদের পাহাড় তোমাদেরই থাকবে।

কট্টর বাম সন্তু লারমা শেখ হাসিনার ফাঁদে পা দেন: “দেখিনা কি করে”! চুক্তির দু’বছরের মাথায় সন্তু তার “বেকুবি” বুঝতে পারেন।

‘সাপ্তাহিক ২০০০’ এর নির্বাহী সম্পাদক গোলাম মুর্তজাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সন্তু লারমাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি ক্ষোভে ফেঁটে পরেন: “অবশ্যই বাঙালীদের ফিরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকারের কথা ছিলো, সব কিছু কি লিখে করতে হয়, ঈমান থাকতে হয়।”
(সূত্র: শান্তি বাহিনীর গেরিলা জীবন – গোলাম মুর্তজা)

২৪ বছর ধরে দেশের মানুষ শেখ হাসিনার ঈমানের পরিচয় পেয়েছে। সন্তু লারমার আত্মীয় (ভবদও চাকমা পানছড়ি থানা সভাপতি জেএসএস) এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা সুপন চাকমাকে (নিহত) আমি ২০০৩ সালে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা কি করে ভাবলো পাহাড়ের বিপুল সংখ্যক বাঙালীকে কিভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার মতো একটা চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল নিবে। যাদের ৮০ শতাংশ তখন পাহাড়ে জন্ম নেওয়া আর দশজন পাহাড়ির মতো মাটির মধ্যে শিকড় গড়ে উঠেছে।
আমি অবাক হতাম তাদের জবাব শুনে -কেন নয়? আজ ২৪ বছর পর অনেক পাহাড়ি কে বলতে শুনি -‘তারা আর বিশ্বাস করেন না, বাঙালীদের এখান থেকে আর সরানো সম্ভব।

১৯৭৮-৮২ সাল পর্যন্ত যেসব বাঙালী বসতি করার জন্য এসেছিলো তাদের অনেকেই বিরূপ পরিস্থিতি ম্যালেরিয়া শান্তি বাহিনীর হামলার কারণে পাহাড় থেকে চলে যায়। আজ ৪০/৪২ নিম্ন জনগোষ্ঠীর  যা পাহাড়ের বাঙালী সংখ্যার ৮০-৮৫% তারা সব পাহাড়ে জন্ম নেওয়া বাঙালী।

বাংলাদেশের মতো অতি জনবহুল একটি দেশের এই বিপুল জনসংখ্যাকে (৮লক্ষ) কোন ভাসান চরে স্থানান্তর করা হবে সেই হোম ওয়ার্ক বোধহয় সন্তু লারমা করেননি।
তাই মাঝে মাঝেই তিনি তার হতাশার কথা বলেন হুমকি দেন, ‘আবার পাহাড় অশান্ত হবে! তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলেন।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় পাহাড় থেকে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কমানো মোটেই  সম্ভব নয়। এটা সন্তু লারমা নিজেও জানেন। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি শুধু কোন পাহাড়ের চূড়ায় ঘর বানিয়ে থাকা নয়। রাতের বেলায় সেনাবাহিনীর বুটের শব্দ পাহাড় থেকে ভূত-প্রেতের উপস্থিতি কমায় এটা সন্তু লারমা প্রকাশ্যে না হলেও ব্যক্তিগত আলাপকালে স্বীকার করেন।

১৯৫৬ সাল থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী নাগাল্যান্ডে বিদ্রোহ দমনে বিশেষ ক্ষমতা (Armed Forces Special Power Act) সহ নিয়োজিত আছে।  আমাদের সেনাবাহিনী তার মূল কাজে মনোনিবেশ করলে তার সক্ষমতা বাড়বে।

পাহাড় থেকে যারা বাঙালী বিতাড়নের স্বপ্ন দেখেন তাদের উদ্দেশ্যে বৈষম্য বিরোধী সেই গানটা নিবেদন করে লেখাটার ইতি টানছি:

“দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো ছলা-কলা
কিছু বলতে গেলেই ধরছো টিপে গলা,,,,

ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চিতে বাঙালী-পাহাড়ি সবাই থাকবে।

রক্ত দিয়ে দেশ পেয়েছি, আমরা কেউ আরাকান থেকে সেটেল্ড হইনি। আমরা সবাই বাংলাদেশী।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন